হাজীগঞ্জের সহিংসতাও একই ছকে

সম্প্রতি দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর সংঘটিত সহিংস ঘটনাগুলোর মতোই গত ১৩ অক্টোবর শারদীয় দুর্গোৎসবের অষ্টমীর দিন ফেসবুকে ঘুরে বেড়ানো একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জেও হামলার সূত্রপাত হয়।
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

সম্প্রতি দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর সংঘটিত সহিংস ঘটনাগুলোর মতোই গত ১৩ অক্টোবর শারদীয় দুর্গোৎসবের অষ্টমীর দিন ফেসবুকে ঘুরে বেড়ানো একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জেও হামলার সূত্রপাত হয়।

ওই পোস্টে দাবি করা হয়, কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআনের 'অবমাননা' করা হয়েছে। ছড়িয়ে পড়া ওই গুজবের পরিপ্রেক্ষিতে হাজীগঞ্জের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

সেদিন এশার নামাজের কিছুক্ষণ আগে হাজীগঞ্জ পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের একদল কিশোর-তরুণ বিশ্বরোড মোড় এলাকায় জড়ো হয়ে কথিত ওই ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল বের করে।

সেখান থেকে মিছিলটি রাত ৮টার দিকে সোজা প্রায় ১ কিলোমিটার দূরের হাজীগঞ্জ বড় মসজিদে পৌঁছায়। সে সময় নামাজ শেষ করে লোকেরা মসজিদ থেকে বের হচ্ছিল। দ্রুত ওই কিশোর-তরুণদের নেতৃত্বে মিছিলে বহু মুসল্লিসহ কয়েকশ মানুষ যোগ দেয়।

মিছিলটি আবার বিশ্বরোড মোড় পর্যন্ত গিয়ে ইউটার্ন নিয়ে মসজিদের দিকে ফিরে আসে।

মিছিলটি যখন বিশ্বরোড মোড় থেকে ২০০ গজ দূরের শতাব্দীপ্রাচীণ লক্ষ্মী নারায়ণ আখড়া অতিক্রম করছিল, তখন তারা আখড়ার ফটকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে শুরু করে।

তখন আরও অনেক লোক হামলাকারীদের সঙ্গে যোগ দেয়। কয়েক মিনিট ধরে এই হামলা চলে। এ সময় মসজিদ থেকে বেশ কয়েকজন মুসল্লি উত্তেজিত জনতাকে থামানোর চেষ্টা করলেও তারা তা পারেননি।

একই সময়ে আখড়ার উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে ছোড়া ইটের টুকরো শামিয়ানার উপর দিয়ে মণ্ডপের মধ্যে পড়ে। মণ্ডপের ভেতরে থাকা হিন্দু ভক্তরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাদের কয়েকজন আহত হন।

মণ্ডপে একটি সিসিটিভি ক্যামেরা থাকলেও সামনের ফটকের কারণে হামলার দৃশ্য ধারণ হয়নি।

হামলা শুরুর ১০ মিনিটের মধ্যেই পুলিশ তৎপর হয়ে ওঠে। প্রথমে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে তারা টিয়ারগ্যাসের শেল ও ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে। কিন্তু মণ্ডপের গেটে অবস্থান নেওয়া হামলাকারীরা পুলিশের দিকে পাল্টা ইট নিক্ষেপ করতে শুরু করলে অন্তত ১৫ জন পুলিশ সদস্য আহত হন।

এক পর্যায়ে পুলিশ হামলাকারীদের হটাতে গুলি ছোঁড়ে। এতে ৩ জন মারা যান। আহতদের মধ্যে ২ জন পরে মৃত্যুবরণ করেন। এর মধ্যে গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১ জনের মৃত্যু হয়।

স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি মন্দির ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য, রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে এবং ভিডিও ক্লিপ দেখে দ্য ডেইলি স্টার সেদিনকার এই ঘটনাক্রম একত্রিত করেছে।

এ ব্যাপারে হাজীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) সোহেল মাহমুদের ভাষ্য, 'হামলাগুলো অবশ্যই পূর্ব পরিকল্পিত।'

ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'দুর্বৃত্তরা কেবল ওই মণ্ডপে (লক্ষ্মী নারায়ণ আখড়া) ঝাঁপিয়ে পড়েই থেমে থাকেনি। পরে রাত ১টা পর্যন্ত উপজেলার ১৩টির বেশি মণ্ডপে তারা হামলা চালায়।'

উপজেলায় মোট মণ্ডপ ছিল ২৮টি। সোহেল মাহমুদের মতে, পরবর্তী হামলাগুলো লক্ষ্মী নারায়ণ আখড়ার মতো মারাত্মক ছিল না।

সেদিন রাত ৯টা ২০ মিনিটের দিকে উত্তেজিত জনতা হাজীগঞ্জ থানাতেও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। তখন থানার বেশিরভাগ সদস্য বিভিন্ন মণ্ডপ পাহারা দিচ্ছিলেন।

হাজীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হারুন-অর-রশীদ জানান, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রায় ২ হাজার লোকের বিরুদ্ধে ৩টি মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ১৫ জনকে।

২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে, ২০১৩ সালে পাবনার সাঁথিয়ায় ও ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক হামলার ক্ষেত্রেও একই ছক অনুসরণ করা হয়। সব ক্ষেত্রেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পোস্ট দেখে আক্রমণ চালায় উত্তেজিত জনতা।

১৩ অক্টোবর কুমিল্লার ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১৩ জেলার হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়েছে।

ফেসবুক পোস্ট

কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননার দাবি করা পোস্টটি আপলোড করা হয় আরিয়ান সাজ্জাদ নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে। ওই পোস্টে আরও কয়েকজনকে ট্যাগ করেন সাজ্জাদ।

প্রোফাইলে দেওয়া তথ্য অনুসারে সাজ্জাদ হাজীগঞ্জ পৌর ছাত্রলীগের সদস্য। অবশ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভাতৃপ্রতিম এই সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়, সাজ্জাদের সঙ্গে ছাত্রলীগের কোনো সম্পর্ক নেই।

ছাত্রলীগের হাজীগঞ্জ পৌর ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাব্বি বলেন, সাজ্জাদ ছাত্রলীগের কেউ না। সে সংগঠনের নাম ব্যবহার করেছে।

রাব্বির দাবি, হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি এএসপির নির্দেশে সাজ্জাদ ও হৃদয় হাসান জাহিদ নামের আরেক যুবককে সোহেল মাহমুদের কাছে নিয়ে যান। পরে পুলিশ তাদের তিরস্কার করে ছেড়ে দেয়।

জানতে চাইলে এএসপি সোহেল মাহমুদ বিষয়টি স্বীকার করেন। বলেন, 'আমরা দুই কিশোরের ফেসবুকের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পাই যে, পোস্টটি আপলোড করেছে সাজ্জাদ। আর অন্যজন তাতে লাইক দিয়েছে।

'কিন্তু আমরা তাদের ছেড়ে দেই। কারণ তারা ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক। আর আমাদের সামনেই তারা পোস্টটি মুছে দেয়। এ ছাড়া আমরা দেখি, ফেসবুকে একই পোস্ট অন্যরাও আপলোড করেছে।'

তবে পোস্টটি প্রথমে কে আপলোড করেছিল, তা দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষে যাচাই করে দেখা সম্ভব হয়নি।

সাজ্জাদ ও হৃদয়কে হাজীগঞ্জে পাওয়া যায়নি। তাদের এক বন্ধুর দাবি, তারা পুলিশ হেফাজতে আছে।

এই দাবিও যাচাই করা যায়নি।

মিছিল

পুলিশ ও স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায়, মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়া যুবকদের বেশিরভাগ পৌরসভার উপকণ্ঠে অবস্থিত ১১ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার।

তাদের ভাষ্য, এই এলাকায় বিএনপি-জামায়াতের সমর্থকদের আধিপত্য আছে।

বাসিন্দারা দাবি করেন যে, সেই রাতের মিছিলে তারা বিএনপি কর্মীদের দেখেছেন।

পুলিশ এখন পর্যন্ত হামলাকারীদের ব্যাপারে চুপচাপ আছে। তবে তারা বলছে, তারা কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। সহিংসতায় জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

সহিংসতায় নিহত ৫ জনের মধ্যে ৩ জনের বাড়ি ১১ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন রান্ধুনিমোড়া গ্রামে। তারা হলো হৃদয় (১৪), আল আমীন (১৮) ও শামীম (১৮)।

হৃদয়ের বাবা ফজলুল হক বলেন, 'আমি আমার ছেলেকে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টের নিউজ ফিড স্ক্রল করতে দেখি। মাগরিবের নামাজের পর সে তার বিছানায় শুয়ে ছিল। সন্ধ্যা ৭টার দিকে তার এক বন্ধু এসে তাকে বিশ্বরোড মোড়ের মিছিলে নিয়ে যায়।

'আমি তাকে যেতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু সে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কথা বলেছিল।'

রাতে সাবেক কুয়েত প্রবাসী ফজলুল জানতে পারেন যে হৃদয়ের মাথায় গুলি লেগেছে। তিনি বলেন, 'সবকিছুর জন্য আমি ভাগ্য ছাড়া আর কাউকে দোষ দেই না।'

অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments

The Daily Star  | English

Foreign airlines’ $323m stuck in Bangladesh

The amount of foreign airlines’ money stuck in Bangladesh has increased to $323 million from $214 million in less than a year, according to the International Air Transport Association (IATA).

13h ago