নারায়ণগঞ্জে স্কুল বন্ধ করতে প্রধান শিক্ষিকার বাড়িতে হামলার অভিযোগ আ.লীগ নেতার বিরুদ্ধে

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায় চরাঞ্চলের সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের স্কুল বন্ধ করতে প্রধান শিক্ষিকার বাড়িতে হামলা চালিয়ে শিশুসহ ৫ জনকে পিটিয়ে আহত করেছে দুর্বৃত্তরা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বারদী ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হাশেমের নেতৃত্বে এ হামলা হয়েছে।
হামলায় আহতরা সোনারাগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন। ছবি: স্টার

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায় চরাঞ্চলের সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের স্কুল বন্ধ করতে প্রধান শিক্ষিকার বাড়িতে হামলা চালিয়ে শিশুসহ ৫ জনকে পিটিয়ে আহত করেছে দুর্বৃত্তরা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বারদী ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হাশেমের নেতৃত্বে এ হামলা হয়েছে।

গতকাল শনিবার রাত সাড়ে ৯টায় উপজেলার নুনেরটেক গ্রামের মায়াদ্বীপ চরে 'মায়াদ্বীপ শিশু পাঠশালা' নামে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মরিয়ম আক্তার পাখির বাড়িতে ওই হামলা করা হয়। হামলায় আহত হয়েছেন, স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মরিয়ম আক্তার পাখি  (২৬),  তার ১৫ মাসের মেয়ে পারিশা আক্তার, মা নাসিমা বেগম (৫০), ছোট ভাই মো. শরিফ (২৪) ও মো. রাশেদ (২০)। তাদের সোনারাগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

একইসঙ্গে আসবাবপত্র ভাঙচুর করে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট এবং বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে।

এ ঘটনায় রোববার সকালে সোনারাগাঁ থানায় ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করলেও বিকেল ৫টা পর্যন্ত মামলা হয়নি।

প্রধান শিক্ষিকা মরিয়ম আক্তার পাখি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গতকাল শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে বারদী ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হাশেমের নেতৃত্বে আনোয়ার, মেহেদী, শাহজালাল, শাহাপরান, দ্বীন ইসলাস, ফয়সাল, রাকিব, রহিম আলী, রমজান, শরিফ, ফাহিম, মাসুদ, মঙ্গল আলী, ইউছুফসহ অজ্ঞাত আরও ৭ থেকে ৮ জন সন্ত্রাসী লাঠিসোটা, দেশীয় অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে আমার বাড়িতে হামলা চালায়। তারা সেসময় আমার ২ ভাই, আমাকে এবং আমার মাকে মারধর করে। আমাকে ঘুষি দিতে গেলে আমার ১৫ মাসের মেয়ের মাথায় লাগে। আমাদের চিৎকার শুনে আশেপাশের লোকজন আসলেও কাউকে ঘরে ঢুকতে দেয়নি সন্ত্রাসীরা।'

তিনি আরও বলেন, 'মারধরে আমরা যখন মাটিতে পড়ে যাই তখন তারা আমার ও মায়ের গলার স্বর্ণের চেইন ও ভাইয়ের বিকাশের লেনদেনের জন্য রাখা দোকানের নগদ ৫০ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় বলে যায় স্কুলে পড়াতে গেলে পরিবারের সবাইকে তারা জবাই করে মরে ফেলবে। আমরা যেন নদী পার হয়ে হাসপাতালে না যেতে পারি সেজন্য সকল নৌকার মাঝিকে নিষেধ করে দেয়, তাদেরকে হুমকি দেওয়া হয়। এজন্য কেউ এগিয়ে আসে না। আমরা হাসপাতালে আসলে খালি বাড়িতে রাত আড়াইটায় আগুন দেয় সন্ত্রাসীরা। পরে স্থানীয়রা আগুন নিভিয়ে ফেলে। কিন্তু আমাদের আসবাবপত্র পুড়ে গেছে।'

প্রধান শিক্ষিকা মরিয়ম আক্তার পাখির ভাই শরীফ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কেন আমাদের ওপর হামলা করা হচ্ছে জানতে চাইলে তারা বলেছে, আমার বোন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা তাই আমাদেরকে মেরেছে। আমরা এ ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু সন্ত্রাসীরা ক্ষমতাসীন দলের লোক হওয়ায় পুলিশ মামলা নেয়নি। তারা বলেছে তদন্ত করে মামলা নেবে।'

জানতে চাইলে সোনারগাঁ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা অভিযোগ পেয়েছি। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। অপরাধী যেই হোক অবশ্যই মামলা হবে।'

হামলার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষিকা মরিয়ম আক্তার পাখি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ২০০৭ সালে কবি ও মানবাধিকার কর্মী শাহেদ কায়েস 'মায়াদ্বীপ শিশু পাঠশালা' নামে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে কৃষক, জেলে ও নিম্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সুবিধা বঞ্চিত শিশুরা পড়াশোনা করে।

তিনি বলেন, '২০০৯ সালে আমি স্কুলে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে পড়ানো শুরু করি। ২০১০ সালের জুন থেকে স্থানীয় প্রভাবশালী হাশেম, আনোয়ার ও মেহেদীসহ আরও অনেকে অবৈধভাবে বালু কাটায় চরের তিন ভাগের এক ভাগ নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। তখন থেকে শাহেদ কায়েস গ্রামবাসীদের নিয়ে চর রক্ষায় "মায়াদ্বীপ রক্ষা আন্দোলন" নামে আন্দোলন গড়ে তুলেন। ফলে কিছুদিনের জন্য বালু কাটা বন্ধ হয়। এতে বালু সন্ত্রাসীদের ক্ষোভের মুখে পড়েন শাহেদ কায়েস। যার প্রেক্ষিতে ২০১২ সালে ২ বার মাঝ নদীতে শাহেদ কায়েসের ওপর হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। ২০১৩ সালে ২৫ জূলাই তাকে হত্যার উদ্দেশে নদীর মাঝখান থেকে অপহরণ করা হয়। সে যাত্রায় প্রশাসনের সহযোগিতায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান।'

তিনি আরও বলেন, 'তারা দীর্ঘদিন স্কুলটি বন্ধের পায়তারা করে আসছিল। এর আগে একবার স্কুলের বেঞ্চসহ আসবাবপত্র লুট করে নিয়ে দরজায় তালা দিয়ে দেয়। কিন্তু পরে গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় স্কুল চালু হয়। করোনায় ১৬ মাস বন্ধ থাকার পর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন করে স্কুল চালু হয়। এরপর থেকেই শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ শাহেদ কায়েসকে বিভিন্ন ভাবে স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার জন্য হুমকি দিয়ে আসছিল। স্কুল বন্ধ না করলে প্রাণে মেরে ফেলাসহ স্কুলে আগুন দেওয়া হবে বলে তারা হুমকি দেয়। এমনকি শাহেদ কায়েসকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলবে বলেও হুমকি দেয়। এসব হুমকির পরও আমরা স্কুল চালু রাখি।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন গ্রামবাসী দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, হামলাকারীরা সবাই এক সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। এখন নারায়ণগঞ্জ- ৩ আসনের এমপি লিয়াকত হোসেন খোকার সমর্থক ও জাতীয় পার্টির কর্মী। এমপির নাম ব্যবহার করেই সব অপকর্ম করে তারা। বারদী ইউনিয়নের ৬নং ওয়াড আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হাশেমের নেতৃত্বে এ হামলা হয়েছে বলে জানান তারা। এছাড়া হামলাকারী মেহেদী বারদী ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ওসমান মেম্বারের ছেলে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কবি শাহেদ কায়েস দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ওরা আগে বালু সন্ত্রাসী ছিল। এখন মাদক বিক্রিসহ নানা অপকর্মে জড়িত। এখানে স্কুল থাকায় অনেক বাচ্চারা শিক্ষিত হচ্ছে। তাদের অপকর্মে বাধা দিচ্ছে। তারা ভাবছে স্কুল না থাকলে আমি বা প্রশাসনের কেউ সেখানে যাবো না। তারা সকল অপর্কম করতে পারবে। এজন্যই স্কুলটা বন্ধ করতে চায়। স্কুল বন্ধের জন্য ৪ জন শিক্ষককে তারা হুমকি দিচ্ছিল। এর মধ্যে শনিবার রাতে এ হামলা হয়েছে।'

হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন তিনি।

এদিকে অভিযোগের বিষয়ে জানতে বারদী ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাশেমের মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলে মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।

বারদী ইউনিয়নের ৬ নং ওয়াড আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি ওসমান মেম্বার অভিযোগ অস্বীকার করে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্কুল বন্ধের জন্য হামলা করা হয়নি। শিক্ষিকার ভাইয়ের সঙ্গে হাতাহাতি হয়েছে। আমার ছেলে অপরাধী হলে বিচার হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Sajek accident: Death toll rises to 9

The death toll in the truck accident in Rangamati's Sajek increased to nine tonight

7h ago