‘ডিবি পরিচয়ে ছিনতাই’ তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে পুলিশ
নগরীর কোতয়ালি থানাধীন সিআরবির আটমার্চিং রোডে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্য পরিচয়ে ছিনতাইয়ের একটি মামলার তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে পুলিশ। গত বছরের ২৬ অক্টোবর নগরীর রিয়াজুদ্দিন বাজারের এক মোবাইল ব্যবসায়ী মামলাটি দায়ের করেছিলেন।
নূর মোহাম্মদের রিয়াজুদ্দিন বাজারের তামাকুমন্ডি লেনের রেজোয়ান মার্কেটে নিউ মোবাইল টাচ নামে একটি দোকান রয়েছে।
চলতি বছরের ৮ মে কোতয়ালি থানার সিআরবি ফাঁড়ির ইনচার্জ পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. রবিউল ইসলাম অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে উল্লেখ করেছেন। তবে সর্বাত্মক চেষ্টা করে আসামিদের পুর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করতে না পারায় এবং গ্রেপ্তার সম্ভব না হওয়ায় চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেন।
সূত্র জানিয়েছে, আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হলেও তাতে উপযুক্ত প্রমাণের ঘাটতি রয়েছে। এ নিয়ে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশেও আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, 'পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাইয়ের' অভিযোগগুলো বিশেষভাবে ও আলাদাভাবে গুরত্ব দিয়ে তদন্ত করে পুলিশ। অনেক সময় পুলিশের নাম ভাঙিয়ে টাকা আত্মসাতের জন্য 'নাটক' সাজানো হয়। যে কারণে কোনো বাহিনীর পরিচয়ে ছিনতাইয়ের অভিযোগ এলে তা অধিকতর তদন্ত করে এর সত্যতা যাচাই ও আসামি শনাক্তের চেষ্টা করা হয়। তাই এ ধরনের মামলায় অভিযোগ সত্য বলে প্রতিবেদন দিতে হলে যথেষ্ট প্রমাণ থাকতে হবে।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, মামলার বাদী নূর মোহাম্মদের বাড়ি কুসুমবাগ আবাসিক এলাকায়। গত বছরের ২২ অক্টোবর বিকেলে নিউ মার্কেট থেকে বাসে করে তিনি বাসায় ফিরছিলেন। বিকেল ৫টার দিকে কদমতলী ফ্লাইওভারের নিচে আটমার্চিং মোড় পেট্রোল পাম্পের বিপরীতে পৌঁছালে অপরিচিত একজন বাসের ভেতরে প্রবেশ করে নিজেকে ডিবি পুলিশ পরিচয় দেন এবং নূর মোহাম্মদকে বাস থেকে নামিয়ে নেন। পরে একটি সিলভার রঙের প্রাইভেটকারে উঠিয়ে তাকে টাইগারপাস মোড় দিয়ে লালখান বাজারের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে নূর মোহাম্মদকে মারধর করা হয়। সেইসঙ্গে ছুরির ভয় দেখিয়ে তার কাছে থাকা ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা, একটি ফিচার্ড ফোন ও একটি কলিংবেল ছিনিয়ে নেয়। প্রাইভেটকারে ২ জন দুর্বৃত্ত ছিলেন। তাদের একজন গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তারা সব কিছু কেড়ে নিয়ে নূর মোহাম্মদকে নগরীর মুরাদপুরে নামিয়ে দেয়।
পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং বাদী ও সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আইএমইআই নম্বরের মাধ্যমে মামলার বাদীর ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোনের অবস্থান খোঁজার চেষ্টা করা হয়। সিডিআরে কোনো তথ্য না থাকায় সেটা সম্ভব হয়নি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, থানায় রক্ষিত নথিপত্র এবং সিডিএমএসের মাধ্যমে অতীতে পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাইয়ের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের ছবি দেখানো হলেও বাদী আসামিকে শনাক্ত করতে পারেননি।
'সর্বাত্মক চেষ্টাকালেও অজ্ঞাতনামা আসামিদের কোনো তথ্য না পাওয়ায় তাদের শনাক্ত করা এবং গ্রেপ্তার সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া বাদীর সঙ্গে আলোচনাকালে তিনিও অজ্ঞাতনামা আসামিদের শনাক্ত করার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য উপাত্ত দিতে পারেননি। আমার সার্বিক তদন্তে প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণে এবং ঘটনার পারিপাশ্বিকতায় অত্র মামলার ঘটনাটি অজ্ঞাতনামা ২ জন আসামির বিরুদ্ধে অপরাধ সত্য বলে প্রমাণিত হলেও তদন্তকালে সর্বাত্মক চেষ্টা করে আসামিদের পুর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করতে না পারায় এবং গ্রেপ্তার সম্ভব না হওয়ায় চূড়ান্ত রিপোর্ট সত্য বলে জমা করলাম'— উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোতয়ালি থানার সাবেক এক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রেয়াজুদ্দিন বাজার-নিউ মার্কেট কেন্দ্রিক চোরাই মালামাল, হুন্ডি, স্বর্ণ পাচারের মতো অনেক ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়। অনেক সময় প্রতিপক্ষের অর্থ আত্মসাৎ করতে বা অন্য কোনো ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাইয়ের নাটক সাজানোর অনেক নজির আছে অতীতে। সে ক্ষেত্রে সিসিটিভি ফুটেজ, পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ, মালামাল উদ্ধার বা আসামি গ্রেপ্তার করলে ছিনতাই হয়েছে কি না তা বোঝা যায়। এ ধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে যদি বস্তুনিষ্ট প্রমাণের অভাব থাকে তাহলে "চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিথ্যা" বা "চূড়ন্ত প্রতিবেদন তথ্যগত ভুল" বলে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া হয়।'
এ বিষয়ে কোতয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নেজাম উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ছিনতাইয়ের ঘটনার আগে পরে সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যায়নি, অনেক জায়গার সিসিটিভি ফুটেজও নেই। এ ছাড়া, বাদী নিজেও কোনো আসামিকে শনাক্ত করতে পারেননি।'
সিসিটিভি ফুটেজ ছাড়া ও পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে অভিযোগ সত্য বলে আদালতে জমা দেওয়া কতটুকু সঙ্গত— জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য করতে চাননি। এ বিষয়ে সিএমপির দক্ষিণ জোনের উপকমিশনার বিজয় বসাকও কোনো মন্তব্য করেননি।
তবে ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠার পর শুরুর দিকে যে কয়েক জন পুলিশ কর্মকর্তা প্রাথমিক তদন্ত করেছেন, তারা বলছেন বাদীর দেওয়া তথ্য ও সাক্ষ্য-প্রমাণে অনেক অসঙ্গতি রয়েছে।
উল্লেখ্য, মামলা দায়েরের আগের দিন গত বছরের ২৫ অক্টোবর কেবলমাত্র মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পুলিশের উপপিরিদর্শক (এসআই) রবিউল আসামি সন্দেহে সিএমপির পুলিশ পরিদর্শক আফতাব হোসেনকে মারধর করেন এবং হাতকরা পরিয়ে থানায় নিয়ে যান। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তদন্ত শেষে আফতাবকে ছেড়ে দেন এবং জানান এটি ভুল বোঝাবুঝি ছিরর।
তদন্ত শেষে সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর জানিয়েছিলেন, যে সময় ছিনতাই হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। সে সময় আফতাব সেখানে ছিলেন না। আর এসআই রবিউল বলেন, তিনি আফতাবকে চিনতে পারেননি।
মারধরের ঘটনায় আফতাব সিএমপি কমিশনারের কাছে রবিউলের বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ করলে কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয়। সিএমপি সূত্র জানায়, প্রায় এক বছর হলেও কমিটি এখনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি।
Comments