মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে কেন অবনতি?

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১০ ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এ বছর ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬২তম। গত বছর এই অবস্থান ছিল ১৫২তম।

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১০ ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এ বছর ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬২তম। গত বছর এই অবস্থান ছিল ১৫২তম।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের (আরএসএফ) তথ্য মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে। সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে ভারত (১৫০), পাকিস্তান (১৫৭), শ্রীলঙ্কা (১৪৬), আফগানিস্তান (১৫৬), নেপাল (৭৬), মালদ্বীপ (৮৭) এবং ভুটান (৩৩)।

মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১০ ধাপ পিছিয়ে যাওয়ার কারণ এবং এর ফলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কোন দিকে যাচ্ছে তা জানতে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সাবেক তথ্য কমিশনার ও আজকের পত্রিকা সম্পাদক মো. গোলাম রহমান, সিনিয়র সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের সঙ্গে।

তারা বলছেন, সূচকে অবনতির পেছনে সবচেয়ে নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইনটি সাংবাদিকদের হেনস্তা, দমন ও গ্রেপ্তারে ব্যবহৃত হচ্ছে।

তারা মনে করেন, এই আইনটির অপব্যবহার হচ্ছে এবং আইনটির অপপ্রয়োগ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।

সাবেক তথ্য কমিশনার ও আজকের পত্রিকা সম্পাদক মো. গোলাম রহমান বলেন, 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের কারণে এই অবনতি হয়েছে। এই আইনের ব্যাপক অপব্যবহার হচ্ছে এবং প্রকৃত বিচার হচ্ছে না। পুলিশ যে কাউকে এই আইনের অধীনে ধরে নিয়ে যেতে পারে।'

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১০ ধাপ পেছানোর ফলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে মনে করেন ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক এই শিক্ষক।

তবে তিনি মনে করেন, যেসব নির্দেশক দিয়ে মুক্ত গণমাধ্যম সূচক নির্ধারণ করা হয় তার বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়।

তিনি বলেন, 'আরএসএফ মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলতে শতভাগ স্বাধীনতাকে বুঝায়। অর্থাৎ যেকোনো ব্যক্তি যা খুশি বলতে পারবেন। তাকে বাধা দেওয়া যাবে না। যদি কোনো এক্সট্রিমিস্ট গ্রুপের বিভিন্ন কথাবার্তার জন্য তাদেরকে দমন করা হয় সেটি আমরা মনে করি ঠিক আছে। কিন্তু তাদের মতে, এটাকেও মতপ্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা বুঝায়।'

প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে আইনের ব্যবহার ঠিক মতো হচ্ছে না। এটা একটা কারণ হতে পারে। আমাদের এখানে গণমাধ্যমের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় এমন আরও কিছু নতুন আইন হচ্ছে। অন্য দেশগুলোতে এমন আইন নেই। তাই তারা এগিয়ে আছে।'

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১০ ধাপ পিছিয়েছে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা উল্লেখ করে মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, 'আইনটি করার সময় দেশে ও দেশের বাইরে অনেক প্রতিবাদ হয়েছে। এখন সেই আইন ফল দিতে শুরু করেছে। গত ২৬ মাসে এই আইনে প্রায় ৯০০ মামলা হয়েছে। তার মধ্যে অধিকাংশ মামলাই হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। মামলাগুলো অধিকাংশ করেছে সরকারি দল বা তাদের সমর্থকরা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এই আইন ব্যবহৃত হচ্ছে। এর অপপ্রয়োগ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।'

তিনি বলেন, 'আইনটি তৈরির সময় এক মন্ত্রী বলেছিলেন, সবচেয়ে ভালো একটি আইন হচ্ছে। পৃথিবীর বহুদেশ নাকি এটিকে অনুসরণ করার জন্য বসে আছে। একজন ব্যক্তির ভূমিকার জন্য একটি রাষ্ট্রের এমন বিপদ হবে, তা আমরা কেউ ভাবতে পারিনি। তখন বলা হয়েছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ত্রুটিগুলো সংশোধন করা হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা সংশোধন করা হয়নি।'

মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য সরকারকে যে দায়িত্ব পালন করতে হয় বিগত ৫০ বছরে আমাদের দেশের কোনো সরকার সেই দায়িত্ব তেমনভাবে পালন করেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমাদের একটা অভ্যাস আছে, কোনো বিদেশি রিপোর্ট যখন আমাদের পক্ষে যায় তখন সেটি সানন্দে গ্রহণ করি, বিপক্ষে গেলে প্রত্যাখ্যান করি। এই অবস্থান থেকে বের হতে হবে। যারা এই গ্রহণ আর প্রত্যাখ্যানের দায়িত্বে থাকেন তাদের উচিত সবটাই গ্রহণ বা বর্জন না করে এর পেছনের কারণ, কারা জড়িত বা সরকারের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।'

আরএসএফ যে সূচকগুলোর কথা বলেছে সেগুলো যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে বর্তমান অবস্থা থেকে বের হওয়া যাবে এবং আগামী বছর উন্নতি করা যাবে বলে মনে করেন সিনিয়র এই সাংবাদিক।

মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে অবনতির ফলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এর দায়দায়িত্ব কিন্তু সরকারের। আমাদের অনেক উন্নয়ন হচ্ছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, কিন্তু একটি দেশের উন্নয়ন মানে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন না। মননশীলতার উন্নয়ন না করে শুধু আর্থিক উন্নয়ন হলে সেই উন্নয়ন টিকে থাকে না। তাই আর্থিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি অন্যান্য খাতের উন্নয়নের দিকে নজর দিতে হবে।'

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, 'সরকার গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে চায়। সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান পিছিয়ে যাওয়ার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। এই কালো আইনে সাংবাদিকরাই সবচেয়ে বেশি হেনস্থা ও গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন। তাই এই সূচকে পিছিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। সবার বলার পরেও এই আইন বাতিল হচ্ছে না।'

তিনি মনে করেন, 'আমাদের ভাবমূর্তি নেতিবাচক দিকে যাচ্ছে। এমনিতেই দেশে গণতন্ত্র ভালো অবস্থানে নেই, সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে না, মানুষের ভোটের অধিকার নেই। গণতন্ত্রের সঙ্গে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকলে কিছুটা হলেও গণতন্ত্র আছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু সেটিও মার খেয়ে যাচ্ছে।'

সাংবাদিকতার এই শিক্ষক বলেন, 'বাংলাদেশে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী সরকার আছে, সেই পরিচয়টাই বেশি প্রস্ফুটিত হচ্ছে। গণতান্ত্রিক, মুক্ত বুদ্ধিচর্চার যে জায়গা দেশে ছিল সেটি বরং ভুলুন্ঠিত হচ্ছে। আমাদের ভাবমূর্তি খারাপের দিকে যাচ্ছে। র‌্যাবের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যে নিষেধাজ্ঞা সেটি দেখে আমাদের বোঝা উচিত ছিল যে নিজেদের ঠিক করতে হবে। কিন্তু তারপরেও আমরা শুধরাচ্ছি না।'

আরএসএফ প্রকাশিত বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক বিদ্বেষপ্রসূত বলে মন্তব্য করেছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ মন্তব্য করেন।

তথ্যমন্ত্রী বলেন, 'যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ক্রমাগতভাবে বিদেশে অপপ্রচার চালাচ্ছে, সেসব সূত্র থেকে তারা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এবং নিজেরাও বাংলাদেশের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত হয়েই যে রিপোর্ট দেয় সেটি প্রমাণিত। তারা সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট নিয়ে বলেছে। যখন ডিজিটাল বিষয়টি ছিল না তখন ডিজিটাল নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়টিও ছিল না। যখন ডিজিটাল বিষয়টি এসেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ডিজিটাল হয়েছে, তখন গণমানুষকে ডিজিটাল নিরাপত্তা দিতে বিভিন্ন দেশ আইন করেছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এই আইন হয়েছে এবং হচ্ছে। বাংলাদেশ যেহেতু উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে প্রথম দিকে ডিজিটাল হয়েছে, তাই আমাদের দেশেও এই আইন হয়েছে। এই আইন সব মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য।'

Comments