‘ভয় দেখানো সংস্কৃতির একটি নিকৃষ্টতম উদাহরণ’ 

সুমনের গানের সেই ‘ছোট্ট’ পার্কটিতে ঘাসের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু তা পরোয়া করার দায় ছিল না ‘সবুজ’ বাচ্চাগুলোর। ওই পার্কেরই রোদে পোড়া বেঞ্চে চ্যাপলিন ও আহত প্রেমিকের সাজে ‘সমকাল’কে বসে থাকতে দেখেছিলেন সুমন। প্রত্যক্ষ করেছিলেন, কীভাবে ছোট্ট একটি পার্ক প্রতি বিকেলে শিশুদের ‘সাম্যের’ পৃথিবী হয়ে ওঠে।

সুমনের গানের সেই 'ছোট্ট' পার্কটিতে ঘাসের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু তা পরোয়া করার দায় ছিল না 'সবুজ' বাচ্চাগুলোর। ওই পার্কেরই রোদে পোড়া বেঞ্চে চ্যাপলিন ও আহত প্রেমিকের সাজে 'সমকাল'কে বসে থাকতে দেখেছিলেন সুমন। প্রত্যক্ষ করেছিলেন, কীভাবে ছোট্ট একটি পার্ক প্রতি বিকেলে শিশুদের 'সাম্যের' পৃথিবী হয়ে ওঠে।

কবীর সুমন তাই গেয়েছিলেন, 'বিকেল বেলার রোদে বাচ্চার ভিড় বাড়ে/খেলতে খেলতে পড়ে যাওয়া ছেলে প্যান্টের ধুলো ঝাড়ে/বাস্তুহারার খুকি মেটায় খেলার সাধ/ঘাস উঠে যাওয়া ধূসর পার্কে শিশুর সাম্যবাদ।'

পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালের উল্টো দিকের খোলা জায়গাটিকে পার্ক বলার কোনো উপায় নেই। তবে তেঁতুলতলা মাঠ হিসেবে পরিচিত ওই একরত্তি জায়গাটিই স্থানীয় শিশুদের খেলাধুলার একমাত্র স্থান। পাশাপাশি এখানেই ঈদের নামাজ, জানাজাসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান করেন বাসিন্দারা।

এই মাঠে থানা ভবন নির্মাণের প্রতিবাদ করায় এবং নির্মাণকাজের ভিডিও ধারণ করায় গতকাল রোববার বেলা ১১টার দিকে স্থানীয় বাসিন্দা সৈয়দা রত্নাকে আটক করে পুলিশ। পরে তার অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকেও ধরে নেওয়া হয়। রাখা হয় কলাবাগান থানায়।

মা-ছেলের এই আটক নিয়ে দিনভর ব্যাপক সমালোচনা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ গণমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে বিক্ষোভের মুখে দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে মুচলেকা নিয়ে রত্না ও তার ছেলেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি তেঁতুলতলা মাঠে খেলতে যাওয়া কয়েকটি শিশুকে কান ধরে ওঠবস করায় পুলিশ।

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং স্থপতি ও পরিবেশবিদ ইকবাল হাবিবের সঙ্গে।

তারা বলছেন, যেভাবে সৈয়দা রত্না ও তার ছেলেকে আটক করা হয়েছে তা সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী। আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যে নাগরিক অধিকার সুরক্ষা করার বদলে খর্ব করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা এই ঘটনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। পাশাপাশি জেলা প্রশাসন যে প্রক্রিয়ায় এমন একটি উন্মুক্ত জায়গাকে থানা ভবন নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দিলো, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

এ ব্যাপারে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের বক্তব্য হলো, 'এ বিষয়টা আসলে ধারাবাহিকভাবে মানুষকে ভয় দেখানো, তুলে নিয়ে যাওয়া, আটকে রাখার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তারই নিকৃষ্টতম একটি উদাহরণ।'

তিনি আরও বলেন, 'ন্যুনতম গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় কিংবা ন্যুনতম মানবিক অধিকার ও ন্যুনতম পরিবেশ অধিকার রক্ষার দাবি জানালে যে কাউকে তুলে নিয়ে যাওয়া যায়, দিনভর থানা কর্তৃপক্ষ কারও সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারে, দিনভর আটকে রাখা যায়, নাবালককে আটকে রাখার আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ না করা যায়, এটা আমরা গতকাল দেখলাম।

'আমরা এর আগে কিন্তু এরকম দেখিনি, যে থানার কেউ কথা বলবে না। মাঠে গেলে বলবে আমরা কথা বলার জন্য অথোরাইজ না, থানায় গেলে বলবে আমরা অথরাইজ না। একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সারাদিনেও থানায় যাবেন না- এগুলো আমরা গতকালই দেখেছি।'

রিজওয়ানা হাসানের পর্যবেক্ষণ হলো, 'এই যে একটা কথা না বলার সংস্কৃতি, জনগণকে না পোছার সংস্কৃতি, ভয় দেখানোর সংস্কৃতি, এটা যে এই পর্যায়ে নেমে এসেছে, তা কিন্তু সাংঘাতিক ভীতিকর একটি বিষয়। সাংঘাতিক অস্বস্তিকর একটি বিষয়। এতে সরকারের ভাবমূর্তি, রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের ভাবমূর্তি কোনোভাবেই বৃদ্ধি করছে না।

'এবং আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যে নাগরিক অধিকার সুরক্ষার বদলে খর্ব করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সেটা কিন্তু এই ঘটনার মাধ্যমে গতকাল প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।'

এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ রিজওয়ানা সৈয়দা রত্না ও তার ছেলেকে আটকের সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করে বলেন, 'এর আগে কলাবাগান থানা কর্তৃপক্ষ কয়েকটা বাচ্চাকে কান ধরে ওঠবস করিয়েছিল মাঠে খেলতে যাওয়ার জন্য। সেটা জানাজানি হওয়ার পর ওদেরকে (দায়ী পুলিশ সদস্যদের) ওখান থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। আমরা জানতে চাই যার নির্দেশে এবং যাদের দ্বারা এই তুলে নিয়ে যাওয়ার, আটক রাখার, মুচলেকা নেওয়ার ঘটনা ঘটল তাদের কি শাস্তি দেওয়া হবে? তাদের শাস্তি দেওয়া না পর্যন্ত নাগরিকরা কিন্তু তীব্র অস্বস্তির মধ্যে থাকবেন।'

এ ছাড়া অতটুকু একটি মাঠের জায়গা থানা ভবন নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এই আইনবিদ। বলেন, 'আমি কোনো অবস্থাতেই বলব না যে, থানা হওয়ার দরকার নেই। অবশ্যই সেটা দরকার। কারণ কাল আমরা কলাবাগান থানায় ছিলাম। আমরা স্পষ্ট উপলব্ধি করেছি যে, তাদের একটি ভবন দরকার। সেটা একটা একরত্তি খেলার মাঠেই কেন হতে হবে? যেখানে ওই এলাকায় আর কোনো খেলার মাঠ নেই। পুলিশ কর্তৃপক্ষ কি আমাদের দেখাতে পারবে যে, বাচ্চার ওখানে না খেলে অন্য কোথাও খেলতে পারবে?

এ পর্যায়ে রাজউক ও সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে রিজওয়ানা বলেন, 'ওই জায়গাটি যে থানা করার উপযুক্ত জায়গা, সেটা রাজউক-সিটি করপোরেশন কীভাবে প্রত্যয়ন দিতে পারে? পরিবেশ অধিদপ্তর কীভাবে প্রত্যয়ন দিতে পারে? তারা (থানা কর্তৃপক্ষ) দাবি করছে তাদের প্রত্যায়ন আছে। তাহলে সেই কাগজগুলো আমাদের দেখাক।'

এই পরিস্থিতিতে ওই মাঠে থানা কিংবা অন্য কোনো স্থাপনা তৈরি না করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, 'এই মর্মে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, রাজউক ও কলাবাগান থানা কর্তৃপক্ষকে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিতে হবে। কালকের ঘটনার জন্য কারা দায়ী তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ বিভাগীয় তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া এলাকাবাসীসহ  সৈয়দা রত্না ও তার পরিবারকে আর হয়রানি করা যাবে না।'

এ ব্যাপারে স্থপতি ইকবাল হাবিবের বক্তব্য হলো, 'আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার আপনি পড়ে দেখেন, প্রতি ২ মাস পর পর একনেক সভায় মিটিংসংক্রান্ত অতিরিক্ত সেসব বার্তা থাকে তা একটু যাচাই করে দেখেন, এ সংক্রান্ত আরও ১০টি আইন-বিধান আপনি পড়ে দেখেন। এর প্রতিটার মধ্যে খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থান সংরক্ষণের সুষ্পষ্ট বিধান রয়েছে। সংবিধানের কথা বাদই দিলাম।'

তিনি বলেন, 'পরিত্যাক্ত সম্পত্তি হলেও জায়গাটি ৫০ বছর ধরে খেলাধুলাসহ নানা সামাজিক কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ অবস্থায় ব্যবহার অনুসারে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জায়গাটির ভূমিরূপ চিহ্নিত করা উচিত ছিল। তা না করে জেলা প্রশাসন জায়গাটি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো করে পুলিশের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। পাশাপাশি পুলিশ যেখানে এ সংক্রান্ত আইনগুলো সংরক্ষণ করবে, প্রধানমন্ত্রীর স্পষ্ট নির্দেশনার বাস্তবায়ন করবে, সেখানে সে হন্তারক হয়ে উঠেছে।'

এই পরিবেশবিদের ভাষ্য, 'রাষ্ট্রের এই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানোর এই প্রয়াসকে আমি রাজনৈতিক ব্যর্থতা মনে করি। আমি এটাও মনে করতে চাই, এটি এই সময়ে অস্থিরতা তৈরি করার একটি গোষ্ঠীকেন্দ্রিক পরিকল্পিত তৎপরতা।

'কারণ উন্মুক্ত স্থান ও খেলার মাঠ সংরক্ষণের জন্য দীর্ঘ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই আজ ঢাকার ৪০টি খেলার মাঠ এবং পার্ক বেদখল থেকে দখলমুক্ত করে ২ সিটি করপোরেশন উন্নয়ন করেছে। আরও করার জন্য মেয়ররা হন্যে হয়ে ঘুরছেন।'

ইকবাল হাবিব আরও বলেন, 'ওই ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে আর একটিও খেলার মাঠ নেই। সুতরাং ওখানকার একমাত্র উন্মুক্ত স্থানটিকে পুলিশের থানা বানানোর প্রক্রিয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

'উন্মুক্ত স্থান ও খেলার মাঠ সাংবিধানিক অধিকারের একটি জায়গা। সেটাকে সংরক্ষণের বদলে দখলের সংস্কৃতির নায়ক হওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আমাদের দরকার নেই।'

Comments