সামরিক অভ্যুত্থান: মিয়ানমারে প্রাণ হারিয়েছে যে শিশুরা
মিয়ানমারের স্থানীয় অধিকার গোষ্ঠীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর থেকে এখন পর্যন্ত ৯৩৪ জনকে হত্যা করেছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। যাদের মধ্যে ৭৫টি শিশু বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু অধিকার কমিটি। যদিও এ সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।
নিহত শিশুদের বেশিরভাগেরই বয়স ১৬ বছরের নিচে এবং সবচেয়ে কম বয়সী শিশুটির বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর।
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত শিশুদের নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আলজাজিরা। এ শিশুদের কাউকে রাস্তায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কেউ খুন হয়েছে নিজ বাড়িতেই।
অং দি (১৩)
কোচিন রাজ্যের অং দি নিহত হয় গত ২৪ মে। তার বাবা একজন কাঠমিস্ত্রী এবং মায়ের বাড়িতে মুরগির খামার ছিল। নিহত হওয়ার দিন মুরগির দেখাশোনা করতে গ্রামের পাশে তার খালার বাড়িতে যায় অং। সেখানে পৌঁছানোর ৩০ মিনিট পর ভারী গোলাবর্ষণ শুরু হয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই অং মারা যায়।
অং দির মা বলেন, ' গান ভীষণ পছন্দ করতো অং দি। গিটার বাজানোর শখ ছিল। যখন আমাদের দেশ স্বাধীন হবে, আমার মনে হয় সে স্বর্গ থেকে তা দেখবে এবং খুশি হবে। আমি চাই মানুষ অন্তত মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে স্মরণ করুক।'
তাং লিয়ান মুয়ান স্যাং (১১)
চিন রাজ্যের তাং মারা যায় গত ২০ মে। বন্ধুদের সঙ্গে হাঁটার সময় রাস্তার পাশে পড়ে থাকা একটি বিস্ফোরক না বুঝে হাতে নিয়েছিল সে। বিস্ফোরণের পর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়।
তাংয়ের দিনমজুর মা একাই তাং ও তার তিন ভাইবোনকে বড় করছিলেন। আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, 'সে আমাকে প্রায়ই বলতো যে, ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করো না, মা। আমি তোমার দেখাশোনা করব।'
সানডে আয়ে (১৪)
সানডের বাড়ি কায়াহ রাজ্যের লইকাউতে। গত ২৭ মে সে বন্ধুর বাড়ির সামনে খেলার সময় প্রায় ৫০ জন সেনা সেখানে হাজির হয়। তারা গুলি ছুঁড়তে শুরু করলে শিশুরা পালাতে শুরু করে। সানডে সেখানেই মারা যায়।
তার কৃষক বাবা-মা বলেন, 'আর কোনো শিশুর এমন পরিণতি হোক, আমরা তা চাই না।'
তুন তুন অং (১৪)
মান্দালয়ে নিম্ন পদস্থ সরকারি চাকরিজীবী বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতো তুন তুন। মিয়ানমারের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম মিয়ানমার নাউয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ২২ মার্চ প্রায় ৩০০ সেনা দুটি বুলডোজার নিয়ে নিম্ন পদস্থ সরকারি চাকরিজীবীদের হাউজিং কমপ্লেক্সে হাজির হয়। সেখানে তাদের গুলিতে যে আটজন নিহত হয়, তুন তুন তাদের একজন।
মোয়ি থান্ডার (১৪ মাস)
মাত্র ১৪ মাস বয়সী মোয়ি মারা যায় গত ১৯ জুন। শান রাজ্যের এ শিশুটি ডায়রিয়া আক্রান্ত ছিল। তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় কিছু পুলিশের গাড়ি ও সামরিক বাহিনীর নিয়োগ দেওয়া এক প্রশাসকের গাড়ি তার বাবার মোটরবাইকের দিকে ছুটে আসে। এ সময় একটি গাড়িতে ধাক্কা লেগে মোয়ি বাবার কোল থেকে পড়ে মারা যায়। মদ্যপ অবস্থায় মোটরবাইক চালানোর অভিযোগ তুলে পুলিশ তার বাবাকেই গ্রেপ্তার করে পরদিন ।
ওম শাল (১৩)
গত মে মাসে সামরিক বাহিনী আবাসিক এলাকায় আক্রমণ চালানো শুরু করার পর চিন রাজ্যের মিন্দাতে বসবাসরত ওমের পরিবার পালিয়ে শহরের বাইরে আশ্রয় নেয়। গত ২৪ জুন সেখানকার একটি কূপ থেকে খাবার পানি সংগ্রহের সময় ভুলে একটি স্থলমাইনে পা দেয় ওম। ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়।
কায়াল সিন হেইন (১৬)
ইয়াঙ্গুনের কায়াল নিহত হয় গত ১৪ মার্চ। প্রত্যক্ষদর্শীদের মাধ্যমে তার বাবা-মা জানতে পারেন, একটি বিক্ষোভ চলাকালে মাথায় গুলি করে কায়ালকে হত্যা করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা একটি সামরিক ট্রাকে করে তার মরদেহ নিয়ে যায়। নিহত শিশুদের নাম মনে রাখা হোক-এমনটা প্রত্যাশা করেন কায়ালের মা।
নাইয়ি নেইং ফায়ো (১৪)
নায়ি মারা যায় গত ১ এপ্রিল। সেগেইং রাজ্যের দুই নির্মাণশ্রমিকের একমাত্র সন্তান ছিল সে। মৃত্যুর দিন বাবা-মায়ের সঙ্গে সড়ক নির্মাণের কাজ করছিল সে। এ সময় সামরিক বাহিনী গুলি ছুঁড়তে শুরু করলে নাইয়ি পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু, দুবার গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়।
গত ৩০ জুলাই সেভ দ্য চিলড্রেন এক বিবৃতিতে জানায় অন্তত ১০৪টি শিশুকে আটকে রাখা হয়েছে, যাদের মধ্যে সাত বছরের শিশুও আছে। হত্যা-আটকের ঝুঁকির পাশাপাশি মিয়ানমারের শিশুদের পড়াশোনা, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ পানি ও খাদ্যের নিশ্চয়তাও ব্যাহত হচ্ছে বলে উদ্বেগ জানানো হয়।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার কমিটি সতর্ক করে দিয়ে বলে, 'মিয়ানমারে শিশু অধিকার এমন এক হুমকির মুখোমুখি, যাতে পুরো একটি প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।'
Comments