২৩ অক্টোবর ১৯৭১: সংকটের পরও শরণার্থীদের পাশে থাকব: ইন্দিরা গান্ধী
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৩ অক্টোবর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বেতারে জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেন। ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে দলমত নির্বিশেষে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। এখন সময় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার।'
তিনি বলেন, 'কাল সকালে আমি কয়েকটি দেশে সফরে যাচ্ছি। আমি বলতে চাই, আমি আপনাদের পাশেই থাকব। এইরকম মুহূর্তে আমি বসে থাকতে পারি না। আমাদের দেশ বিপদের সম্মুখীন। তা সত্ত্বেও, অনেক চিন্তার পর আমি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অন্যান্য দেশের নেতাদের সঙ্গে দেখার করার জন্য কিছু আমন্ত্রণও ছিল। আমি তাদের আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাখ্যা করবো। আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে আমরা যখন কোনো সমস্যায় পড়ি তখন সাধারণত সমাধান আমাদের হাতেই থাকে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমরা এভাবে আর এটিকে চলতে দিতে পারি না। শুধু রাগ বা তাড়াহুড়া করে আমাদের অবস্থান আমরা নষ্ট করতে চাই না। কেবল আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীর দিকেই তাকিয়ে থাকলে চলবে না। এই মুহূর্তে আমাদের সব মানুষেরও সতর্কতা প্রয়োজন। গত কয়েক মাসে সাহস, মর্যাদা ও সংযম দিয়ে আমরা এই চ্যালেঞ্জ প্রত্যক্ষ এবং মোকাবিলা করেছি। আমি নিশ্চিত যে ভবিষ্যতে আপনারা যে কোনো বিপদ একই সাথে মোকাবিলা করবেন।'
তিনি বলেন, গুজব, হয়রানি, সাম্প্রদায়িক উসকানি এসব আমাদেরকে প্রতিহত করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী প্রবাহ আমাদের জন্য একটি বড় বোঝা। তবুও আমরা আমাদের সীমান্ত সংকটের পরেও তাদের দেখাশোনা করছি। এই মুহূর্তে তারা ভূমিহীন ও বেকার। আমরা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। ভারতীয় জনগণের অসুবিধা সাময়িক এবং একটি ভাল এবং শক্তিশালী দেশ গড়ে তোলার ব্যাপারে আমাদের অনেক বেশি আন্তরিক হতে হবে।'
ঢাকায় এদিন
২৩ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে তথ্যমন্ত্রী মুজিবুর রহমানসহ আরও ১০ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। জাতীয় পরিষদে এখন পর্যন্ত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রতিনিধির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ জনে।
২৩ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তানের শ্রম, সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী এ এস এম সোলায়মান পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'শিল্প কারখানার শ্রমিকেরা এখন পূর্ণ মনোযোগে কাজ করছেন। প্রতিটি কারখানাতেই উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। মাঝে কিছুদিন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুষ্কৃতকারীদের হামলায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল। আমরা আশা করি গত কয়েক মাসের ক্ষতি কিছুটা হলেও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা পোষাতে সক্ষম হবো।
২৩ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামির সাধারণ সভায় ঢাকা জেলার আমির হিসেবে অধ্যাপক গোলাম সরয়ারকে নির্বাচিত করা হয়।
ভারতে এদিন
২৩ অক্টোবর কলকাতায় বসুমতী পত্রিকা একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। যেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিকেরা। এর আগে বসুমতী পত্রিকা দীপাবলি সংখ্যায় আয়কৃত সকল অর্থ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে দান করে। এছাড়া এই সংখ্যায় লেখার জন্য সাহিত্যিকদের পাওয়া লেখক সম্মানীও সাহিত্যিকেরা মুক্তিযুদ্ধ ফান্ডে দান করেন। এদিন আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শওকত ওসমান, অন্নদাশঙ্কর রায়, মনোজ বসু।
পাকিস্তানে এদিন
২৩ অক্টোবর করাচিতে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, 'ভয়ভীতি প্রদর্শন অব্যাহত থাকলে পূর্ব পাকিস্তানের উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে পিপিপি প্রার্থীদের প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। আমরা সংঘাতপূর্ণ নির্বাচন চাই না।'
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
২৩ অক্টোবর নিউইয়র্ক থেকে করাচির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার আগে পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য শাহ আজিজ সাংবাদিকদের বলেন, 'আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র এখন দেশবাসী পূর্ণ মাত্রায় টের পাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। যদিও তাদের অনুপস্থিতিতে এই বিচার শুরু হয়েছে। পাকিস্তান এক ও অক্ষুণ্ণ থাকবে। পাকিস্তানের ঐক্য কেউ ভাঙতে পারবে না।'
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
২৩ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ভোর ৪টার দিকে আগের দিন পিছু হটা সুবেদার শামসুল হকের কোম্পানি পুরান বাজার এলাকায় ঘাঁটি গড়ার সময় হানাদারদের উপর দুর্ধর্ষ আক্রমণ গড়ে তোলে। এসময় মুক্তিবাহিনীর হামলায় ২০ হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ২২ জন সৈন্য আহত হয়। এই যুদ্ধের পর কসবা স্টেশনসহ আশেপাশের এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। হানাদার বাহিনী তখন পেছন থেকে মঈনপুর, কামালপুর, কাশেমপুরসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় অবস্থান গড়ে তোলে।
২৩ অক্টোবর মৌলভীবাজারের বড়লেখার বর্নিতে ভোর ৫টার দিকে ৫নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলীর নির্দেশে সাব-সেক্টর কমান্ডার তাহের উদ্দিন আখঞ্জির নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর প্রায় ২০০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটিতে অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। হানাদার বাহিনীর বিপুল প্রতিরোধের মুখে মুক্তিবাহিনী এক পর্যায়ে পিছু হটতে শুরু করে একপাশে এসে অবস্থান নেয়। এদিকে সাব সেক্টর কমান্ডার তাহের উদ্দিন আখঞ্জি ওয়্যারলেসে সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলীকে নিজেদের পরিস্থিতি বর্ণনা করলে সেক্টর কমান্ডার আরও ১ প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠান। এসময় হানাদার বাহিনী টিকতে না পেরে গৌরীনগরের দিকে পালিয়ে যায়।
২৩ অক্টোবর সকালে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে মুক্তিবাহিনীর পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়।
২৩ অক্টোবর ৮নং সেক্টরের গোজাডাঙ্গা সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মুহাম্মদপুর অবস্থানের ওপর মর্টারের সাহায্যে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এসময় হানাদার বাহিনী বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ গড়ারও সুযোগ পায়নি। এই হামলায় হানাদার বাহিনীর ১০ সৈন্য নিহত হয়।
২৩ অক্টোবর টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল রাজাকার ও মিলিশিয়াদের একটি দলের উপর আক্রমণ চালায়। এই হামলায় ৩৯ রাজাকার ও ৩ সেনা নিহত হয়।
২৩ অক্টোবর লক্ষ্মীপুরে রাজাকার কমান্ডার ননী চেয়ারম্যানকে আটক করে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল।
২৩ অক্টোবর ৮ নং সেক্টরের বেতাই সাব-সেক্টরের রামনগরে মুক্তিবাহিনীর একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক প্লাটুন সৈন্যের আসার খবর পেয়ে অ্যামবুশ করে। এসময় হানাদার বাহিনীর ২ সেনা নিহত হয় এবং ৩ জন আহত হয়।
সূত্র-
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র সপ্তম, একাদশ ও দ্বাদশ খণ্ড
দৈনিক পাকিস্তান ২৪ অক্টোবর ১৯৭১
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২৪ অক্টোবর ১৯৭১
Comments