রোহিঙ্গা ট্র্যাজেডি: সংকটের অবনতি না অবসান

আমি চট্টগ্রামের যে গ্রামে বড় হয়েছি তা থেকে সামান্য দূরত্বে বিশ্ব মাপের একটি মানবিক বিপর্যয় সংগঠিত ও ঘনীভূত হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ অসহায়, বিধ্বস্ত পুরুষ, নারী ও শিশু যাদের কেউ কেউ মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুরতায় গুরুতরভাবে আহত, মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে ছুটে আসছে। নাফ নদীর তীরে প্রতি দিন নারী ও শিশুর লাশ ভেসে আসছে যাদের অধিকাংশই মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা পরিবার ভর্তি নৌকা ডুবির শিকার।
rohingya refugees
মিয়ানমার সরকারের নির্যাতনের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। ছবি: এএফপি

আমি চট্টগ্রামের যে গ্রামে বড় হয়েছি তা থেকে সামান্য দূরত্বে বিশ্ব মাপের একটি মানবিক বিপর্যয় সংগঠিত ও ঘনীভূত হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ অসহায়, বিধ্বস্ত পুরুষ, নারী ও শিশু যাদের কেউ কেউ মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুরতায় গুরুতরভাবে আহত, মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে ছুটে আসছে। নাফ নদীর তীরে প্রতি দিন নারী ও শিশুর লাশ ভেসে আসছে যাদের অধিকাংশই মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা পরিবার ভর্তি নৌকা ডুবির শিকার।

মিয়ানমার সরকার যে যুক্তিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করছে তা একেবারেই আজগুবি। বর্তমান যে রাখাইন রাজ্যটি, তা ঐতিহাসিকভাবে আরাকান সাম্রাজ্যের মূল ভূখণ্ড ছিল। এই সাম্রাজ্যটি একসময় আমার নিজ জেলা চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর অনেক পরে আরাকান ব্রিটিশ ভারতের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। ইতিহাস তার নিজ খেয়ালে ও প্রয়োজনে কোনো এলাকার সীমানা ক্রমাগত নির্ধারণ ও পুনঃনির্ধারণ করে যায়, কিন্তু সেখানকার মানুষের সঙ্গে মাটির সম্পর্কটি অপরিবর্তিত থেকে যায়। এলাকাটি যে দেশের নতুন সীমানার মধ্যে পড়ে যায়, তা সে দেশের অংশে পরিণত হয়। মানুষ ইচ্ছায় অনিচ্ছায় সে দেশের নাগরিকে রূপান্তরিত হয়।

১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে বার্মা স্বাধীন হবার পর এবং পরবর্তী বিভিন্ন সরকারের সময়কালে বার্মা তার সীমানাভূক্ত রোহিঙ্গাসহ সকল জাতিগোষ্ঠীকে পূর্ণ নাগরিক বলে স্বীকার করে নেয় এবং তাদের প্রতিনিধিত্বের অধিকার দেয়। তার ভিত্তিতে রোহিঙ্গারা সে দেশের সংসদে নির্বাচিত হয় ও সরকারের মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করে।

আশ্চর্যজনকভাবে, ১৯৮০-র দশকে সেদেশের সামরিক শাসকদের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে হঠাৎ এই ধারণার উৎপত্তি হয় যে, রোহিঙ্গারা বার্মিজ নয়! এরপর তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয় এবং তাদেরকে সে দেশ থেকে বিতাড়িত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সামরিক ও রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করে। শুরু হয় জাতিগত ও ধর্মীয় নিধনের উদ্দেশ্যে সুপরিকল্পিত নির্যাতন।

গত দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে হাজার হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু মিয়ানমার সরকারের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য বাংলাদেশে এসে ভিড় করছে। ২৬ আগস্ট ২০১৭ তারিখের পর এই অত্যাচারের মাত্রা এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, গত দুই সপ্তাহেই প্রায় ৩ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করেছে।

মিয়ানমারের নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের উপর দেশটির এই নির্বিচার সামরিক আক্রমণ - যার ফলে তারা গণহারে দেশটি থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে - বন্ধ করার উদ্দেশ্যে জরুরি ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করে গত ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ আমি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে একটি খোলা চিঠি দিই। এর আগেও গত বছরের ডিসেম্বর মাসে আরো কয়েকজন নোবেল বিজয়ীকে সঙ্গে নিয়ে আমি রোহিঙ্গাদের উপর বর্বর হামলার প্রতিবাদে একটি যৌথ আবেদন নিরাপত্তা পরিষদের নিকট পেশ করেছিলাম।

দেশটির এই অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপগুলো কর্তৃক আরাকানের জন্য “স্বাধীনতা”-র দাবিতে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। ফলে এশিয়ার এক নীরব প্রান্তে অবস্থিত অত্যন্ত দরিদ্র কিন্তু অর্থনৈতিক ও মানবীয় সম্ভাবনায় বিপুলভাবে সমৃদ্ধ একটি ভূখণ্ড হঠাৎ করে উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। প্রতিবেশী দু’দেশের মানুষের একই ধরনের অর্থনৈতিক প্রত্যাশার কারণে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে পরম বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠার সকল উপাদানই বিদ্যমান। আমাদের দু’টি দেশই তাদের অতীতকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবার এবং সকলের জন্য একটি নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার বিশ্বময় কর্মযজ্ঞে মর্যাদাপূর্ণ অংশীদার হবার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমি বরাবরই মিয়ানমারকে এই এলাকার আঞ্চলিক সংগঠন সার্কের সদস্যভূক্ত করার এবং বাংলাদেশকে আসিয়ান জোটের সদস্যভূক্ত করার জন্য প্রস্তাব দিয়ে এসেছি - এই দু’টি দেশ এশিয়ার দু’টি শক্তিশালী এবং সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রজোটের মধ্যে দৃঢ় মৈত্রীবন্ধন তৈরি করে দিতে পারে - আমি এই যুক্তিই এর পক্ষে দিয়ে এসেছি। আমি এটা বিশ্বাস করি।

সৌভাগ্যক্রমে, মিয়ানমার সরকার নিজেই বর্তমান রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের ভিত্তি রচনা করে রেখেছে। কফি আনানের নেতৃত্বাধীন ও মিয়ানমার সরকার নিযুক্ত রাখাইন রাজ্য বিষয়ক উপদেষ্টা কমিশনের প্রতিবেদনেই তা সম্প্রতি দেয়া হয়েছে। আমরা নতুন বিতর্কে না-গিয়ে সরাসরি এখান থেকেই শুরু করতে পারি। এই প্রতিবেদনে চমৎকার সব সুপারিশ রয়েছে যা মিয়ানমার সরকার গ্রহণ করেছে। কী-কী সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে তা কমিশনের প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার হলো সকল পক্ষই এই প্রতিবেদন অনুমোদন করেছে।

এই সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাদেরকে পূর্ণ নাগরিকত্ব প্রদানের ব্যবস্থা; তাদের অবাধ চলাচলের সুযোগ ও আইনের চোখে সমান অধিকার; রোহিঙ্গাদের স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যার অভাবে স্থানীয় মুসলিমরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে; এবং নিজ ভূমিতে ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের সহায়তা কাজে লাগানো। আনান কমিশনের সুপারিশগুলোর পূর্ণ ও তাৎক্ষণিক বাস্তবায়ন রোহিঙ্গা সংকটের অবসান ঘটাতে সক্ষম।

শান্তি স্থাপনের প্রক্রিয়া এখনই শুরু করা দরকার। আমরা এখনই ব্যবস্থা না নিলে র‌্যাডিকালাইজেশনের যে আশংকার কথা আনান কমিশন মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে মনে করিয়ে দিয়েছে তা বাস্তবে নিশ্চিতভাবে জটিলতর হতে থাকবে। ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে সময়ক্ষেপণ এবং মিয়ানমার সরকারের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা শান্তি স্থাপন প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত ও কঠিন করে তুলবে।

কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমি নিম্নলিখিত প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপগুলো সুপারিশ করছি:

 

১.     আনান কমিশনের সদস্যদের নিয়ে অবিলম্বে একটি “বাস্তবায়ন কমিটি” গঠন করা যার কাজ হবে কমিশনের সুপারিশগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন তত্ত্বাবধান করা।

২.     দেশটি থেকে শরণার্থীর প্রবাহ বন্ধ করতে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ।

৩.     আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদেরকে নিয়মিতভাবে পীড়িত এলাকাগুলো পরিদর্শন করতে আমন্ত্রণ জানানো।

৪.     যেসব শরণার্থীরা ইতোমধ্যে দেশ ত্যাগ করেছে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা।

৫.     ফিরে যাওয়া শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য জাতিসংঘের অর্থায়ন ও তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন।

৬.     বাস্তবায়ন কমিটির কর্তৃত্বে আনান কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশ মোতাবেক রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান।

৭.     রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অবাধে চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।

 

এই প্রক্রিয়ার শুরু হিসেবে মিয়ানমারের জাতীয় নেত্রী অং সান সু চি বাংলাদেশে এসে শরণার্থী ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করতে পারেন। তিনি শরণার্থীদের এই বলে আশ্বস্ত করতে পারেন যে, মিয়ানমার যেমন তাঁর দেশ, এটা শরণার্থীদেরও নিজেদের দেশ; তিনি তাদের ফিরিয়ে নিতে এসেছেন। এরকম একটি সফর এবং বক্তব্য পুরো পরিস্থিতিই শান্ত করে দিতে পারে।

অং সান সু চি নিশ্চয়ই এমন একটি নতুন মিয়ানমার গড়ে তুলতে চান যেখানে কোনো ধরনের বৈষম্য থাকবে না -- জাতিগত, ধর্মীয়, ভাষাগত বা সাংস্কৃতিক, এবং একে গড়ে উঠতে হবে মানুষের অধিকার ও আইনের শাসনের উপর ভিত্তি করে। তাঁর জীবনে সবচেয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবার সময়টা এখন তাঁর সামনে। তিনি কোন পথে যাবেন - শান্তি ও বন্ধুত্বের, নাকি ঘৃণা ও সংঘর্ষের, তা বেছে নেবার ঐতিহাসিক মুহূর্ত এটাই।

Comments

The Daily Star  | English

Results of DU admission tests of all units published

There was a pass rate of 8.89 percent in A unit [Science] , 10.07 percent in B unit, 13.3 percent in C unit (Business), and 11.75 percent in Cha Unit (Fine Arts)

16m ago