ঘটনাক্রমে আবিষ্কৃত লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারিতে বিপ্লবের সম্ভাবনা

ডিনামাইট, পেনিসিলিন ও এক্স-রে মেশিনসহ মাইক্রোওয়েভের মতো বেশ কিছু বৈপ্লবিক আবিষ্কার খুব একটা পরিকল্পনা করে হয়নি। অন্য কোনো একটি বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে অনেকটা ঘটনাক্রমে আবিষ্কৃত হয়ে গেছে এসব প্রযুক্তি। সম্প্রতি এই তালিকায় যোগ হয়েছে আরও একটি অধরা প্রযুক্তির নাম, সেটি হলো লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি।
ছবি: এক্সট্রিমটেক

ডিনামাইট, পেনিসিলিন ও এক্স-রে মেশিনসহ মাইক্রোওয়েভের মতো বেশ কিছু বৈপ্লবিক আবিষ্কার খুব একটা পরিকল্পনা করে হয়নি। অন্য কোনো একটি বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে অনেকটা ঘটনাক্রমে আবিষ্কৃত হয়ে গেছে।সম্প্রতিকালে এই তালিকায় যোগ হয়েছে আরও একটি অধরা প্রযুক্তির নাম, সেটি হলো লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি।

এই ব্যাটারির ব্যাপক উৎপাদন ও ব্যবহার শুরু হলে আমাদের গ্রহটা হয়তো জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে।

বর্তমান সময়ে আধুনিক জীবন অনেকটাই লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিনির্ভর। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ি, চিকিৎসা সামগ্রী এমনকি স্যাটেলাইটের শক্তি যোগাতেও ব্যবহৃত হয় লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি। 

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি। ছবি: সংগৃহীত

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির সূচনা ৯০-এর দশকে। এ ব্যাটারি প্রচলনের পর থেকেই বিজ্ঞানী, গবেষক, উদ্ভাবক-উদ্যোক্তারা চেষ্টা চালিয়ে আসছেন এর বিকল্প বের করতে। তার পেছনের কারণ হচ্ছে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির বহুমুখী মারাত্মক নেতিবাচক দিক। 

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি তৈরিতে মূল উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা হয় কোবাল্ট। কিন্তু কোবাল্ট মাইনিং যেমন পরিবেশের জন্য বেশ ক্ষতিকর, তেমনি ইকোসিস্টেম ধ্বংসেও এর ভূমিকা ব্যাপক। 

অন্যদিকে কাঁচামাল হিসাবে কোবাল্ট দামি হওয়ায় লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, সঙ্গে যে সমস্ত যন্ত্রপাতিতে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি ব্যবহৃত হয় তার মূল্যও। 

এ ছাড়া লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির রয়েছে লাইফসাইকেল বা ব্যাটারির স্থায়িত্বের সমস্যা। তুলনামূলক দুর্বল ডেপথ অব ডিসচার্জ থাকায় এই সমস্যার সৃষ্টি হয় লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে।
 
ডেপথ অব ডিসচার্জ নিয়ে মোটাদাগে বললে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, ডিসচার্জ বিবেচনায় শতাংশে কোনো ব্যাটারির মোট ধারণক্ষমতার ব্যবহৃত পরিমাণের পরিমাপ। উদাহরণ স্বরূপ কোনো ব্যাটারি যদি তার পুরো শক্তিক্ষমতার ২০ শতাংশ হারে ডিসচার্জ করে, আর অন্য আরেকটা ব্যাটারি ৮০ শতাংশ হারে ডিসচার্জ করে, তাহলে ২০ শতাংশের ব্যাটারির লাইফ সাইকেল ৮০ শতাংশের তুলনায় বেশি হবে।

লিথিয়াম সালফার ব্যাটারি। ছবি: সংগৃহীত

স্বল্প লাইফ সাইকেলের কারণে ক্ষণস্থায়ী ব্যাটারির অসুবিধা যেমন স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের পোহাতে হয় তেমনি উল্লেখ্য যে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাপক প্রচলন না হওয়ার পিছনেও অন্যতম প্রধান বাধা হিসাবে দাঁড়াচ্ছে এই অতি দ্রুত ব্যাটারি ক্ষয় বা ব্যাটারির ক্ষণস্থায়ীত্ব। 

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির আরেকটি দিক হলো এর ঘনত্ব বা ডেনসিটি স্বল্পতা। 
এই ব্যাটারি সাধারণত ভারী, বড় এবং ঢেপসা আকৃতির হয়ে থাকে। যার ফলে বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রে মাইলেজ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ার মতো প্রতিবন্ধকতার দেখা মেলে। আবার ব্যাপক ভারী হওয়ার কারণে অতি উন্নত প্রযুক্তির যানবাহন যেমন বাণিজ্যিক বৈদ্যুতিক উড়োজাহাজ বা জাহাজে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির ব্যবহার সম্ভব হয়ে ওঠে না।

তবে, আশার বিষয় হচ্ছে ৬০-এর দশকে আবিষ্কৃত লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির রয়েছে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি থেকে সৃষ্ট জটিলতাগুলোকে সামাল দেওয়ার সক্ষমতা। 

১৯৬০-এর দশকে হার্বার্ট এবং উলাম নামের ২ জন উদ্ভাবক লিথিয়ামকে অ্যানোডিক এবং সালফারকে ক্যাথোডিক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে একটা ব্যাটারি তৈরি করে, যা পরবর্তীতে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি নামে পরিচিতি লাভ করে। 

লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি তৈরিতে ব্যবহৃত মূল উপাদান সালফার তুলনামূলকভাবে কোবাল্টের চেয়ে জলবায়ুর জন্য কম ক্ষতিকারক। এ ছাড়া স্বল্প খরচে-স্বস্তায় এটি উৎপাদন করা যায় এবং লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির এনার্জি-ডেনসিটি বেশি হওয়ায় তা বেশ হালকা হয়।  

সালফার। ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে ইতোমধ্যে আমরা লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির ব্যাপক প্রচলন ও ব্যবহার দেখছিনা কেন? 

আদতে এই না দেখার পেছনে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির উদ্ভাবনের পর থেকে এখন পর্যন্ত একটা সীমাবদ্ধতা বড় বাধা হিসেবে কাজ করে আসছে। সমস্যাটা মূলত লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির ভেতর ঘটা এক ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে এর উচ্চ কার্যক্ষমতা হারানোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। 

যার প্রভাব পড়ে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির 'আয়ুর' ওপর। এটিকে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিকে যেখানে ২ হাজার চার্জ সাইকেল পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়, সেখানে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি ব্যবহৃত হতে পারে ১ হাজার চার্জ সাইকেল থেকেও কম সংখ্যক বার। অর্থাৎ ১ বা সর্বোচ্চ ২ বছর ঠিকঠাক ব্যবহার করতেই লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির 'মৃত্যু' ঘটে। 

লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির এই দুর্বলতা সমাধানে অনেকেই অনেকভাবে চেষ্টা করে আসছেন। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় অবস্থিত ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির ক্যাথোডের উপাদান পরিবর্তন করে ওই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে হঠাৎ এক আবিষ্কারের দেখা পায়। 

নিরীক্ষাকালীন সময়ে ড্রেক্সেল দলের মূল লক্ষ্য ছিল লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির চার্জ এবং ডিসচার্জের সময় পলিসালফাইড তৈরির রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে স্লথ করে দেওয়া। আর এই পলিসালফাইড সৃষ্টির ঘটনাই হলো লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির সেই সীমাবদ্ধতা। 
 
রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট পলিসালফাইড আদতে ইলেকট্রোডে থাকা সালফারকে বের করে আনে এবং যার কারণে ব্যাটারির কার্যক্ষমতা ও সর্বোপরি 'মেয়াদকাল' ব্যাপকভাবে কমে যায়।   

সালফারের খনি। ছবি: সংগৃহীত

ড্রেক্সেলের গবেষক দলের পলিসালফাইড তৈরির রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে স্লথ করার লক্ষ্য থাকলেও তারা বরং অভিনব এক ঘটনা অবলোকন করে। তারা নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে সালফারের রাসায়নিক এক দশা সৃষ্টির ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে এবং সালফারের যেই রাসায়নিক দশা ব্যাটারির ক্ষয় রোধ করতে সক্ষম। এমন আবিষ্কার ড্রেক্সেল দলকে বিস্মিত করে তোলে এবং অবিশ্বাস্য এই আবিষ্কার যথাযথ কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে তারা শতবারের বেশি পুনঃনিরীক্ষা চালান। আর প্রতিবারই একই ফলাফল দেখতে পান।  

সালফারের এমন রাসায়নিক অবস্থার নাম মনোক্লিনিক গামা-ফেইজ সালফার। পূর্বে এই অবস্থার দেখা মিলেছিল শুধু একবারই- তা ঘটেছিল পরীক্ষাগারের অতি উচ্চ তাপমাত্রায় (৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ২০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি তাপমাত্রায়), কিন্তু কক্ষ তাপমাত্রায় এবারই প্রথম ওই অবস্থার দেখা পাওয়া গেল।   

লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারিতে মনোক্লিনিক গামা-ফেইজ সালফার পলিসালফাইড তৈরির রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছিল এবং তা এতটাই কার্যকরী ছিল যে, গবেষক দল পরীক্ষায় ব্যবহৃত ব্যাটারিকে ৪ হাজার চার্জ সাইকেলের ভেতর দিয়ে নেওয়া স্বত্ত্বেও বিস্ময়করভাবে তা তার কার্যক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। যার অর্থ হচ্ছে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির তুলনায় যা দ্বিগুন বেশি সময় কার্যকরী থাকার সামর্থ্য রাখে।   

উল্লেখ্য যে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির তুলনায় উক্ত ব্যাটারির ৩ গুন বেশি এনার্জি ডেন্স ছিল অর্থাৎ যা চার্জ হতে সময় নিয়েছিল লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির মতো একই সময়। 

ড্রেক্সেল দলের এই সাফল্য অর্থাৎ পলিসালফাইড ঘটিত জটিলতা যদি লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি বাণিজ্যিকভাবেও পাশ কাটাতে পারে তবে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির পরিবর্তে হালকা, সস্তা, পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকারক এবং অধিক কার্যকরী লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি আসন্ন সময়ে স্মার্টফোন, বৈদ্যুতিক গাড়ি থেকে শুরু করে ভবিষ্যত বিশ্বের প্রযুক্তি-সামগ্রীর বিকল্প মূল শক্তি-উৎস হয়ে উঠতে পারে। 

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিতে ব্যবহার করা হয় উচ্চ মূল্যের উপাদান, কোবাল্ট এবং কোবাল্টের সিংহভাগ যোগান (প্রায় ৭০ শতাংশ) কঙ্গোর মতো নাজুক একটি দেশের ওপর নির্ভর করায়, ধারণা করা হচ্ছে ২০৩০ বা এমনকি ২০২৫ সাল নাগাদ কোবাল্টের সরবরাহ বৈশ্বিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হবে। অন্যদিকে সালফার যেমন খুবই সস্তা কাঁচামাল, তেমনি সহজপ্রাপ্যতা ও উপাদান হিসেবে প্রাচুর্যের বিবেচনায় পৃথিবীর দশম স্থান অধিকার করে আছে।

অন্যদিকে, স্পেসিফিক এনার্জি বা ইউনিট প্রতি শক্তি বিবেচনায় আনলে দেখা যায় লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির মাত্রা যেখানে মাত্র ১৫০-২৬০ ওয়াট ঘণ্টা/কিলোগ্রাম সেখানে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির মাত্রা তা থেকে দ্বিগুণেরও বেশি (প্রায় ৫৫০ ওয়াট ঘণ্টা/কিলোগ্রাম)।

এরই সঙ্গে, বাণিজ্যিক পরিসরে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি তৈরিতে অতিরিক্ত খরচ পাশ কাটানোরও সুযোগ থাকছে। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি তৈরিতে ব্যবহৃত কারখানাই লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি উৎপাদনে ব্যবহার করা যাবে। ফলে লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারির বাণিজ্যিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নতুনভাবে অবকাঠামো তৈরি করতে হবে না বলে সেই সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। 

তাই ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের অকস্মাৎ এই আবিষ্কার সারা পৃথিবীর শক্তির ব্যবহারে বিপ্লব নিয়ে আসতে পারে এবং পৃথিবীকে কার্বনমুক্ত, দূষণ কমিয়ে এক নির্মল পরিবেশ উপহার দিতে পারে। সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে যেন এই উদ্ভাবন গবেষণাগার থেকে অতি দ্রুত সফলভাবে বাণিজ্যিক পরিমণ্ডলে পৌঁছায় এবং ব্যবহৃত হতে শুরু করে।

Comments

The Daily Star  | English

Pollution claims 2.72 lakh lives in one year

Alarming levels of air pollution, unsafe water, poor sanitation, and exposure to lead caused over 2.72 lakh premature deaths in Bangladesh in 2019.

6h ago