বিমানের ৫০ বছর: যাত্রার পুরোটা পথই অমসৃণ

২১টি আধুনিক উড়োজাহাজের শক্তিশালী বহর থাকার পরেও বিমান শুধু লোকসানই দিয়ে যাচ্ছে। এভিয়েশন  বিশেষজ্ঞরা জানান, এর পেছনে যথাযথ পরিকল্পনার অভাব এবং নিম্নমানের যাত্রী সেবা দায়ী।
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

২১টি আধুনিক উড়োজাহাজের শক্তিশালী বহর থাকার পরেও বিমান শুধু লোকসানই দিয়ে যাচ্ছে। এভিয়েশন  বিশেষজ্ঞরা জানান, এর পেছনে যথাযথ পরিকল্পনার অভাব এবং নিম্নমানের যাত্রী সেবা দায়ী।

তারা আরও জানান, পূর্ব পরিকল্পনার অভাবে বহরের অনেক নতুন উড়োজাহাজ সক্ষমতা অনুযায়ী ব্যবহৃত হচ্ছে না এবং মানসম্পন্ন পূর্ণ সেবা দিতে পারছে না। ফলে আকাশে শান্তির নীড় শ্লোগানধারী বিমানের পৃথিবী বছরে পর বছর ছোট হয়েছে।

১৯৭২ সালে বিমান তার ডানা মেলার পর থেকে জাতীয় উড়োজাহাজ সংস্থাটি প্রায় প্রতি অর্থবছরেই লোকসান দিয়েছে।

বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিমান ২০২০-২১ (২০২০ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত) অর্থবছরে ১৩৩ কোটি টাকা লাভ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮১ কোটি ১৩ লাখ টাকা লোকসান করেছে।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা জানান, বিভিন্ন সংস্থার কাছে বিমানের দেনার পরিমাণ প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও বিমান নতুন উড়োজাহাজের জন্য বছরে ২৫০ কোটি করে কিস্তি পরিশোধ করে।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিমানের লাভকে প্রকৃতপক্ষে লাভ বলা যায় না, কারণ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে সংস্থাটির শত কোটি টাকার দেনা রয়েছে।'

তিনি আরও জানান, বিমান তাদের আর্থিক নথি প্রকাশের ব্যাপারে স্বচ্ছ নয়।

বর্তমানে সংস্থাটি ১৯টি আন্তর্জাতিক গন্তব্যে আসা যাওয়া করে। বেশিরভাগ গন্তব্যই স্বল্প অথবা মধ্যম দূরত্বে। বিমানের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, আগে সংস্থাটি আরও কম উড়োজাহাজ নিয়েও পশ্চিমের নিউ ইয়র্ক থেকে শুরু করে পূর্বের টোকিওসহ ইউরোপের প্রধান শহরগুলোতে মোট ২৯টি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করতো।

২০০৬ সাল থেকে বিমান ধীরে ধীরে নিউ ইয়র্ক, ফ্র্যাঙ্কফুর্ট, রোম, টোকিও, ব্রাসেলস, আমস্টারডাম ও লিবিয়াসহ ১০টি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ করে দেয়। এর পেছনে মূল কারণ আর্থিক সমস্যা, আধুনিক বিমানের স্বল্পতা এবং কিছু গন্তব্যে পরিচালনায় অর্থনৈতিকভাবে লাভবান না হওয়া।

২০০৭ সালে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হওয়ার পর বিমান তার বহরের সম্প্রসারণের জন্য ২০০৮ সাল থেকে প্রায় ১৯ হাজার ২০ কোটি টাকা খরচ করেছে।

ওয়াহিদুল জানান, প্রায় ৪২টি দেশের সঙ্গে উড্ডয়ন চুক্তি থাকা সত্ত্বেও বিমান নতুন কোনো গন্তব্যে বা বন্ধ হয়ে যাওয়া গন্তব্যে আবারো ফ্লাইট চালু করতে পারেনি।

যদিও বিমানের একটি বড় বাজার আছে এবং অনেক যাত্রী এই সংস্থার ওপর ভরসা করেন, তবুও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনুন্নত সেবা, অব্যবস্থাপনা, অকার্যকর পরিকল্পনা ও বিপণন নীতিমালা এবং পেশাদার কর্মীর অভাবে তাদের বাজার ২০ শতাংশ কমে গেছে।

তিনি আরও জানান, গত ৫০ বছরেরও বেশি সময়ে সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে বিমান ৫০ জন পেশাদার ব্যক্তিকেও সরাসরি নিয়োগ দিতে পারেনি। 'বিশেষজ্ঞ ও পেশাদারদের অভাবে বিমান পতনের মুখে।

বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) একজন নেতা যিনি একজন জ্যেষ্ঠ বৈমানিক তিনি ডেইলি স্টারকে জানান, এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে বিমান তাদের আধুনিক উড়োজাহাজের সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য এখনো কোনো উপযুক্ত উড্ডয়ন পরিকল্পনা তৈরি করতে পারেনি।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, 'বিমান দূরপাল্লার গন্তব্যের জন্য উপযোগী বোয়িং ৭৮৭-৮ উড়োজাহাজকে স্বল্পপাল্লার গন্তব্যের জন্য ব্যবহার করছে, যেমন ঢাকা-সিঙ্গাপুর ও ঢাকা-মালয়েশিয়া, যেটি পরিকল্পনার দুর্বলতা ছাড়া আর কিছুই নয়।'

তিনি জানান, বোয়িং ৭৮৭-৮ টানা ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা উড়তে পারে এবং এটি নিউ ইয়র্ক, টরোন্টো বা টোকিওর মত দূরবর্তী গন্তব্যের জন্য বেশি উপযোগী।

বিমানের পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান সাজ্জাদুল হাসান দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে স্বীকার করেন, সংস্থাটি গত ৫০ বছরে তাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি।

'বিভিন্ন কারণে যাত্রীসেবার মান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি', যোগ করেন তিনি।

গত নভেম্বরে কুর্মিটোলায় বিমানের সদর দপ্তরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি জানান, বিমানের সেবার মান আগের মতোই আছে।

বিমানের সাবেক এমডি ও সিইও এম এ মোমেন জানান, বিমানের উপযুক্ত সেবা দিতে না পারা এবং বাজারে টিকে থাকতে না পারার কোনো কারণ নেই।

বিমানের বর্তমান এমডি ও সিইও আবু সালেহ মোস্তফা কামাল জানান, বিমানের নতুন কোনো গন্তব্যে না যাওয়া ও গ্রাহকদের সঠিকভাবে সেবা দিতে না পারার পেছনে জনবল স্বল্পতাই দায়ী। তিনি বৈমানিক ও কেবিন ক্রু সদস্যদের ঘাটতির কথা উল্লেখ করেন।

গ্রাহকদের পক্ষ থেকে অনুন্নত সেবার অভিযোগ মেনে নিয়ে তিনি বলেন, 'সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে আমাদের সম্মানিত গ্রাহকদের সঠিক সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।'

১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি একটি মাত্র ডিসি-৩ উড়োজাহাজ নিয়ে বিমানের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়।

এখন সংস্থাটির ২১টি উড়োজাহাজ আছে। ৪টি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, ৪টি বোয়িং ৭৮৭-৮, ২টি বোয়িং ৭৮৭-৯, ৬টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ এবং ৫টি ডি হ্যাভিল্যান্ড কানাডা ডিএইচসি-৮ কিউ৪০০।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Pak PM lauds Bangladesh’s economic progress

Says ‘we feel ashamed when we look towards them’

1h ago