একদা এখানে খরস্রোতা নদী ছিল

এক সময়ের খরস্রোতা টাঙ্গাইলের লৌহজং নদী আজ মৃতপ্রায়। পলি জমার পাশাপাশি পানির অভাবে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ও নাব্যতা হারিয়ে গেছে।
স্টেডিয়াম এলাকার কাঁচাবাজার থেকে লৌহজং নদীতে প্রতিদিন ফেলা হয় বর্জ্য। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

এক সময়ের খরস্রোতা টাঙ্গাইলের লৌহজং নদী আজ মৃতপ্রায়। পলি জমার পাশাপাশি পানির অভাবে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ও নাব্যতা হারিয়ে গেছে।

এমন বৈরী পরিবেশের সঙ্গে রয়েছে দখল ও বর্জ্য ফেলা। মারাত্মক দূষণ এই নদীটিকে মরা নোংরা খালে পরিণত করেছে। এসবই ঘটেছে মাত্র কয়েক দশকে।

ময়লা আবর্জনা ফেলায় খরস্রোতা লৌহজং এখন মরা খাল। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বৈষ্ণববাড়ি এলাকায় ধলেশ্বরী থেকে উৎপত্তি হয়ে ৭৬ কিলোমিটার দীর্ঘ লৌহজং নদী জেলা শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জেলার মির্জাপুর উপজেলার বংশাই নদীতে পড়েছে।

শহরের বেশ কয়েকজন প্রবীণ দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত এই নদীতে লঞ্চ ও পণ্যবোঝাই বড় বড় নৌকা চলাচল করেছে। নদীপথে রাজশাহী থেকে আম বোঝাই নৌকা এসে শহরে ভিড়তো। এ জন্য শহরের কলেজ পাড়ার একটি রাস্তার নাম হয় আমঘাট রোড।

উজানে যমুনা ও এর শাখা ধলেশ্বরীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়ে লৌহজংয়ের প্রবাহেও। নাব্যতা হারাতে থাকে নদীটি। বন্ধ হয়ে যেতে থাকে বড় নৌকার চলাচল।

পানিশুন্য স্লুইস গেট। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

পরে পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যা কর্ম পরিকল্পনার (ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান/ ফ্যাপ-২০) অধীনে ১৯৯১ সালে সদর উপজেলার যোগিনীতে লৌহজং ও ধলেশ্বরীর সঙ্গমস্থলের কাছে স্লুইস গেট নির্মাণ করায় মরে যেতে শুরু করে নদীটি।

পরে নদীর তীর দ্রুত দখল হয়ে যেতে শুরু করে। শুরু হয় ঘর নির্মাণ ও ধান ও সবজি চাষ।

পাশাপাশি, পৌর এলাকার বসতবাড়ি থেকে নির্গত ময়লা পানি ও আবর্জনা, বিসিক শিল্প এলাকার কয়েকটি কারখানা ও সদর উপজেলার ক্ষুদিরামপুরে টেক্সটাইল মিল থেকে নির্গত বর্জ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নদীটিকে মারাত্মকভাবে দূষিত করতে থাকে। লৌহজংয়ের পানি মানুষ ও গবাদি পশুর ব্যবহারে অনুপযোগী হয়ে পড়ে। নদীর জলজ প্রাণীও বিলুপ্ত হয়ে যায়।

তা ছাড়া, দূষিত পানির দুর্গন্ধে নদীর ধারে মানুষের বসবাস কঠিন হয়ে পড়ে।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার জোগিনি এলাকায় নদীটি একেবারেই শুকিয়ে গেছে। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে বছরের পর বছর ধরে সংশ্লিষ্ট নাগরিক ও স্থানীয় পরিবেশ কর্মীরা নদীটির নাব্যতা ফিরিয়ে আনাসহ দখল ও দূষণমুক্ত করার দাবিতে নানান কর্মসূচি পালন করে আসছেন।

২০১৬ সালের ২৯ নভেম্বর তৎকালীন জেলা প্রশাসন মোট ৭৬ কিলোমিটার নদীর মধ্যে পৌর এলাকার হাজরা ঘাট থেকে বেড়াডোমা পর্যন্ত মাত্র দেড় কিলোমিটার এলাকা দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়।

প্রাথমিকভাবে কিছু অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করা হলেও পরে উচ্ছেদ কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন জেলা প্রশাসন একইস্থানে পুনরায় উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে।

সেসময় শুধু সদর উপজেলাতেই সাড়ে চার শতাধিক অবৈধ স্থাপনা শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে পৌর এলাকায় নদীর তীরে ৩ কিলোমিটারের মধ্যে ২৬০টির বেশি স্থাপনা রয়েছে।

কয়েকটি স্থাপনা ভেঙে ফেলার পর, নদীর সীমানা নির্ধারণ ও দখলদারদের চিহ্নিত করা নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়ে এই অভিযানটিও স্থগিত করা হয়।

পৌর এলাকার স্টেডিয়াম সংলগ্ন নদীপাড়ের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকার নদীটি খনন করতে চাচ্ছে, পরিবেশ সুন্দর করতে চাচ্ছে—এর সঙ্গে আমরা একমত। কথা হলো, ১৯৬২ সালে জমিগুলো আমাদের নামে রেকর্ড করে দেওয়ায় ডিসি অফিস খারিজ দিয়েছে, ভূমি অফিস খাজনা নিয়েছে ও পৌরসভা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা পাশ করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ঘর করেছি।'

ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

'এখন যদি এই জমি থেকে আমাদের সরিয়ে দেওয়া হয় তবে আমাদের জমির ন্যায্য মূল্য দিতে হবে,' যোগ করেন তিনি।

সরেজমিনে দেখা যায়, লৌহজং নদীর উৎসমুখ বালিতে ভরাট হয়ে গেছে। যোগিনী স্লুইস গেট এলাকাসহ নদীর অধিকাংশ স্থানই প্রায় পানিশূন্য। শহর এলাকায় নর্দমার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে নদীটি। দিনের পর দিন ফেলা নোংরা আবর্জনার গন্ধে টেকা দুষ্কর হয়ে পড়েছে নদীপারের বাসিন্দাদের।

টাঙ্গাইলের নদী, খাল ও জলাশয় রক্ষা আন্দোলন কমিটির সাধারণ সম্পাদক রতন আহমেদ সিদ্দিক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদীর জমি দখলের পাশাপাশি সেখানে এখনও আবর্জনা ফেলা হচ্ছে।'

তিনি জানান, শহরের প্রধান কাঁচাবাজারের পাশের পার্ক মার্কেটের সব বর্জ্য ড্রেনের মাধ্যমে নদীতে ফেলা হচ্ছে।

কবি ও গীতিকার মাসুম ফেরদৌস ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কয়েক বছর আগে স্থানীয় প্রশাসন অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নদীর ৭৬ কিলোমিটারের মধ্যে পৌর এলাকার মাত্র দেড় কিলোমিটার দখল ও দূষণমুক্ত করার চেষ্টা করেছিল। নদীতে যদি পানিই না থাকে তাহলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে এর পাড় বাঁধাই বা অন্য কার্যক্রম করে লাভ নেই। নদীর প্রাণ হচ্ছে পানি।'

ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

'আমরা চাই, দখল-দূষণ মুক্ত করার পাশাপাশি উৎসমুখ থেকে পুরো নদীতে কিভাবে প্রবাহ ফিরিয়ে আনা যায় সেই উদ্যোগ নেওয়া হোক।'

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) টাঙ্গাইলের বিভাগীয় সমন্বয়কারী গৌতম চন্দ্র চন্দ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দখল-দূষণে লৌহজং আজ মৃতপ্রায়। শুধু দেড় বা ৩ কিলোমিটার উদ্ধার করে নদীর পাড়ে রাস্তা বা অন্য কিছু নির্মাণ করে কাজের কাজ কিছু হবে না। মানুষ নদী সৃষ্টি করতে পারে না। এটি প্রাকৃতিক সম্পদ। নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, দেশ বাঁচবে। কাজেই নদীটিকে সচল করতে হবে।'

'নদীর উৎস মুখ থেকে প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'নদীকে নদীর গতিতে চলতে দিতে হবে। এর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রাণ-বৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে।'

সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদীটির বেহাল দশা দেখেছি। যে অংশটুকুতে অভিযান চালানো হয়েছিল তা আবার দখলের প্রক্রিয়া চলছে।'

'জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে,' বলে জানান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Student politics, Buet and ‘Smart Bangladesh’

General students of Buet have been vehemently opposing the reintroduction of student politics on their campus, the reasons for which are powerful, painful, and obvious.

20m ago