জবই বিলে পাখিদের ওপর দুর্ভাগ্য নেমে আসে যেভাবে

এ বছর শীত এখনো উত্তরবঙ্গে জেঁকে বসেনি। তবে গত কয়েকদিন ধরে উত্তরবঙ্গের সকালগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে ঘন কুয়াশার মাঝে। এরই মধ্যে জবই বিলে আসতে শুরু করেছে নানা প্রজাতির অতিথি পাখি। তার মধ্যে আছে বেশ কয়েক প্রজাতির পরিযায়ী হাঁস। গত বৃহস্পতিবার দেখা গেল বিলের দক্ষিণের অংশটি পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত। কিন্তু এই পাখিরা হয়তো জানে না খুব শিগগির তাদের দুর্দিন শুরু হবে, চলে যেতে হবে এই জলাভূমি ছেড়ে।
জবই বিলে আসতে শুরু করেছে নানা প্রজাতির অতিথি পাখি। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

এ বছর শীত এখনো উত্তরবঙ্গে জেঁকে বসেনি। তবে গত কয়েকদিন ধরে উত্তরবঙ্গের সকালগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে ঘন কুয়াশার মাঝে। এরই মধ্যে জবই বিলে আসতে শুরু করেছে নানা প্রজাতির অতিথি পাখি। তার মধ্যে আছে বেশ কয়েক প্রজাতির পরিযায়ী হাঁস। গত বৃহস্পতিবার দেখা গেল বিলের দক্ষিণের অংশটি পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত। কিন্তু এই পাখিরা হয়তো জানে না খুব শিগগির তাদের দুর্দিন শুরু হবে, চলে যেতে হবে এই জলাভূমি ছেড়ে।

নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে উত্তরবঙ্গের এক বিশাল প্রাকৃতিক জলাভূমি জবই বিল। বিলটি বর্তমানে খাস জমি হিসেবে উপজেলা প্রশাসনের অধীনে আছে। স্থানীয়রা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে এর আয়তন প্রায় ২ হাজার হেক্টর এবং শুকনো মৌসুমে প্রায় দেড় হাজার হেক্টর। তবে সরকারি হিসাবে এই বিলের আয়তন ৯৯৯ একর বা ৪০৩ হেক্টর।

এই পাখিরা হয়তো জানে যে খুব শিগগির তাদের চলে যেতে হবে এই জলাভূমি ছেড়ে। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিলটি ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুরের পুণর্ভবা নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অনেকে বলেছেন, বিলটি জবই গ্রামের কাছাকাছি উৎপত্তি হয়ে ভারত সীমান্তে প্রবেশ করে পুণর্ভবা নদীতে গিয়ে পড়েছে। জবই গ্রামের কাছাকাছি বলে স্থানীয়রা এর নাম দিয়েছেন জবই বিল।

ডুমরইল, বোরা মির্জাপুর, মাহিল ও কালিন্দার মূলত এই ৪টি বিলের সমন্বয়ে এই জবই বিল। প্রায় সারা বছর প্রাণ-প্রকৃতিতে মুখরিত থাকলেও, শীতকালে বদলে যায় বিলের পরিবেশ। নানা প্রজাতির পাখ-পাখালির ডাকে ভিন্ন প্রাণের সঞ্চার হয় বিলটিতে।

শীতকালে নানা প্রজাতির পাখ-পাখালির ডাকে ভিন্ন প্রাণের সঞ্চার হয় জবই বিলে। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা এই বিলে প্রতি বছর নভেম্বরের শেষ দিকে আসতে শুরু করে হাজার হাজার শীতের পাখি। দেশীয় নানা জাতের মাছে ভরপুর এই বিলে নিরাপদে থাকতে চায় পাখিরা। কিন্তু বেশি সময় তাদের সেই আশা স্থায়ী হয় না। ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির শুরুতে হাজার হাজার নৌকা নিয়ে মাছ শিকারে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্থানীয় জেলেসহ অন্যান্যরা। যতদিন না মাছ শেষ হয় ততদিন হাজার হাজার নৌকা বিচরণ করে এই বিলে। কয়েক সপ্তাহ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত চলতে থাকে মাছ ধরা। ফলে পাখিদের আর নিরাপদে থাকা হয় না। প্রাণভয়ে পালিয়ে যায় হাজার হাজার পাখি। আমাদের দেশে শীতকালে যে সব পরিযায়ী পাখি আসে, শীত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা এ দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে অবস্থান করে। কিন্তু জবই বিলের পাখিদের অনেক আগেই চলে যেতে হয়।

আমাদের দেশে শীতকালে যে সব পরিযায়ী পাখি আসে, শীত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা এ দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে অবস্থান করে। কিন্তু জবই বিলের পাখিদের অনেক আগেই চলে যেতে হয়। ছবি: মোস্তফা সবুজ

পাখিদের এই দুর্দশা দেখে স্থানীয় কিছু শিক্ষিত তরুণ ২০১৮ সাল থেকে গড়ে তুলেছেন জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সমাজ কল্যাণ সংস্থা। বর্তমানে এই স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটির সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭০ জন। জবই বিলের পাখি সংরক্ষণে তারা বিলের চারদিকের ৪টি ইউনিয়নে কাজ করছেন। স্থানীয় প্রশাসন এবং বন বিভাগের সহায়তা নিয়ে চালাচ্ছেন প্রচার-প্রচারণা। সেই সঙ্গে সচেতনতা তৈরি করছেন এই বিলের উপকারভোগী ৭৯৯ জন জেলেদের মাঝে।

ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে বিলে মাছ ধরা শুরু হলে পাখিগুলো প্রাণভয়ে পালিয়ে যায়। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সমাজ কল্যাণ সংস্থার সভাপতি মো. সোহানুর রহমান সবুজ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '১৯৯০ সালের আগে বিলটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। তখন সেখানে চাষাবাদ হতো না। কচুরিপানায় ভরে থাকত পুরো এলাকা। তখন সেখানে এই সময় প্রতি বছর লাখ লাখ অতিথি পাখি আসত। কিন্তু যখন থেকে এই বিলে মাছ চাষ শুরু হয়েছে তখন থেকে এখানে পাখি আসা কমে যায়। মাঝখানে অনেকে আবার পাখি শিকার করত। কিন্তু আমরা তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। এখন পাখি শিকারিদের সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোটায়।'

তিনি বলেন, 'এই বিলের উত্তরে ভারতের কাছাকাছি অনেকগুলো বড় বড় জলাশয় আছে। তাছাড়া আছে পুণর্ভবা নদী। ফলে ওই জলাশয়গুলো, নদী এবং জবই বিলের মধ্যে পাখিদের চলাচলের একটি চ্যানেল তৈরি হয়েছে। প্রতি বছর শীতকালে হাজার হাজার পাখি এই বিলে আসে। কিন্তু থাকতে পারে না। ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে এই বিলে প্রায় ২ হাজার নৌকা নামে মাছ ধরতে। তখন পাখিগুলো প্রাণভয়ে পালিয়ে যায়।'

'তাছাড়া সে সময় জেলেদের জালে ধরা পরে মা মাছ। এতে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে মাছের অনেক প্রজাতি। হুমকির মধ্যে পড়ছে বিলের জীববৈচিত্র্য,' বলেন সোহান।

জরিপে বিলটিতে প্রায় ২৮ প্রজাতির ৯ হাজার ৭১২টি পাখির দেখা পাওয়া গেছে। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

জবই বিলে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাখিপ্রেমীরা আসে পাখি দেখতে। যারা পাখির ছবি তোলেন, তারাও আসেন এখানে। গত বছর একজন পাখিপ্রেমী এবং জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সমাজ কল্যাণ সংস্থা ৫ দিনের জরিপ চালিয়ে সেখানে প্রায় ২৮ প্রজাতির ৯ হাজার ৭১২টি পাখির দেখা পান। এই সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ২ হাজার বেশি। ২০২০ সালে একই রকমের জরিপে ৭ হাজার ৬৮৩টি পাখির দেখা পাওয়া যায়। এতে বোঝা যায় যে বিলটিতে প্রতি বছরই বাড়ছে পাখির সংখ্যা এবং প্রজাতি।

জলাশয়, নদী এবং জবই বিলের মধ্যে পাখিদের চলাচলের একটি চ্যানেল তৈরি হয়েছে। ছবি: মোস্তফা সবুজ

সাহাপার উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রোজিনা পারভীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, '৯৯৯ একরের জবই বিল খাসজমিতে অবস্থিত। বর্তমানে সেখানে জবই বিল মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে মাছ চাষ করা হয়। এই বিলের সুফলভোগী জেলেদের সংখ্যা ৭৯৯ জন। প্রকল্পের অধীনে উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে মাছের পোনা ছাড়া হয়।'

তিনি আরও বলেন, '২০০০ সাল থেকে এই প্রকল্পের শুরু। গত ২০ বছরে এই বিলের মাছ থেকে আয় হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৬ লাখ টাকা। এই টাকা ৭৯৯ জন উপকারভোগীর। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এ বছর আরও ১০ বছর বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পের মেয়াদ।'

তিনি জানান, প্রতি বছর ডিসেম্বরের শেষের একটা দিন ধার্য করে এই বিল জেলেদের জন্য মাছ শিকারে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এর পর থেকে মাছ ধরা চলে কয়েক সপ্তাহ বা মাস পর্যন্ত।

বিলটিতে প্রতি বছরই বাড়ছে পাখির সংখ্যা এবং প্রজাতি। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

জবই বিল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সমাজ কল্যাণ সংস্থার সভাপতি সোহানুর রহমান বলেন, 'আমরা দীর্ঘদিন উপজেলা প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতাদের কাছে আবেদন করছি, যেন বিলের একটি অংশ "বিশেষ জীববৈচিত্ৰ সংরক্ষণ অঞ্চল" হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যেন মা মাছসহ শীতের পরিযায়ী পাখিরা নির্ভয়ে থাকতে পারে। কিন্তু কেউ আমাদের আবেদনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।'

যখন থেকে এই বিলে মাছ চাষ শুরু হয়েছে তখন থেকে এখানে পাখি আসে কম যায়। মাঝখানে অনেকে আবার পাখি শিকার করত। ছবি: মোস্তফা সবুজ

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাহাপার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিসেম্বরের আগে কিংবা শীতের শেষে বিলের মাছ ধরার বিষয়টা কেবল উপজেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নয়। এখানে অনেক মানুষের জীবিকার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই জমির আসল মালিক ভূমি মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সবার মতামত নিতে হবে।'

'বিলের একটি অংশকে পাখিদের জন্য সংরক্ষণাঞ্চল করা গেলে সেটা অবশ্যই বিলের জলজ প্রাণী এবং পাখিদের জন্য ভালো হতো। আমি এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলব। তিনি যেভাবে নির্দেশনা দেবেন, আমাদের সেভাবেই কাজ করতে হবে,' বলেন ইউএনও।

Comments

The Daily Star  | English

Abantika: A victim of institutional neglect

The universities also didn't organise any awareness activities regarding where and how to file complaints.

4h ago