কার স্বার্থে চলে রাবি প্রশাসন

নীতিমালা শিথিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার সমালোচনা শেষ হতে না হতেই এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সন্তানদের পোষ্য কোটায় ভর্তি করতে পরীক্ষায় 'ন্যুনতম পাস নম্বর' কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাবি
ফাইল ছবি

নীতিমালা শিথিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার সমালোচনা শেষ হতে না হতেই এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সন্তানদের পোষ্য কোটায় ভর্তি করতে পরীক্ষায় 'ন্যুনতম পাস নম্বর' কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

গত ৬ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষা উপ-কমিটির এক সভায় 'ন্যূনতম পাস নম্বর' ৪০ থেকে কমিয়ে ৩০ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক ড. আজিজুর রহমান।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ৪ হাজার ১৭৩টি আসনের বিপরীতে গত ৪ থেকে ৬ অক্টোবর ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১ লাখ ১ হাজার ৩৮২ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়।

এর আগে বহুনির্বাচনি পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত ১০০ মার্কের পরীক্ষায় সব শিক্ষার্থীর (কোটাসহ) পাস নম্বর নির্ধারিত ছিল ৪০। ফলাফল অনুযায়ী সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীরাই ভর্তির সুযোগ পাবেন, এই সিদ্ধান্তে গত ২৫ অক্টোবর রাবিতে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়।

পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ৩টি ইউনিটে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৯৪ নম্বর থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন ৫৩ নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থী ভর্তি নিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। (কোটা ছাড়া)। (৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ভর্তি প্রক্রিয়া চলমান।)

বিশেষ সুবিধার মধ্যে আরও সুবিধা চাই?

ভর্তি পরীক্ষা উপ-কমিটির সূত্র মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য ভর্তি পরীক্ষায় মোট আসনের ৫ শতাংশ বরাদ্দ থাকে, যা 'পোষ্য কোটা' হিসেবে পরিচিত। ন্যুনতম পাস নম্বর পেলেই সাধারণত তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে থাকেন।

তবে ন্যূনতম ৪০ নম্বরও অর্জন করতে পারেনি, অর্থাৎ পরীক্ষায় ফেল করেছে, এমন ৭১ জনের অভিভাবক ভর্তির সুযোগ চেয়ে আবেদন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে।

অতিরিক্ত বিশেষ এই সুবিধা পেতে পরিচ্ছন্নতা কর্মী, রাঁধুনি, মালী, কাঠমিস্ত্রি থেকে শুরু করে এক কাতারে নাম লিখিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকেরাও।

দ্য ডেইলি স্টারের হাতে আসা আবেদনকারীদের বিস্তারিত তথ্যসম্বলিত একটি উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পরীক্ষায় ৩৯.৫৫ থেকে ৩৫.২০ নম্বর পেয়েছে এমন সংখ্যা ২৬ জন, ৩৪.৯৫ থেকে ৩০.০৫ পেয়েছেন ২১ জন, ২৯.৭৫ থেকে ২৫.৬০ পেয়েছেন ১১ জন। এ ছাড়া ২৪.৬০ থেকে ২০.৬০ পেয়েছেন ৭ জন এবং ১৯.৮০ থেকে ১০.৮০ নম্বর প্রাপ্ত আবেদনকারীর সংখ্যা ৬ জন।

পরোক্ষভাবে শিক্ষকদের সন্তানদের ভর্তির সুযোগ দিতেই কি এই সিদ্ধান্ত?

তথ্যমতে, সকল শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আবেদন করলেও তালিকায় থাকা ৩০ থেকে ৪০ নম্বর প্রাপ্ত ৪৭টি আবেদনের মধ্যে ৯টি আবেদনই করেছেন শিক্ষকশ্রেনীর অভিভাবকেরা।

আর এর মধ্যে ৬ জনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের 'অধ্যাপক' পদমর্যাদার শিক্ষক। এই ৬ জনের মধ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি নির্বাচিত শিক্ষক নেতা। রয়েছেন এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আরও এক শিক্ষক। সেই সঙ্গে সাবেক ২ ডিনও রয়েছেন এই তালিকায়। এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের ৩ জন শিক্ষক রয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পাস নম্বর ৪০ থেকে কমিয়ে ৩০ এ নামানোর ফলে সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিচ্ছন্নতা কর্মী, মালীদের কাতারে উল্লেখিত শিক্ষকেরাও তাদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করার সুযোগ পেয়েছেন।

লক্ষণীয়, আবেদনকারী সব শিক্ষকদের সন্তানদের নম্বর ৩০ থেকে ৪০ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর নিচে আর আবেদনকারী কোনো শিক্ষক নেই।

উল্লেখ্য, গত বছর আবেদনকারী শিক্ষকদের ন্যুনতম নম্বর ছিল ২৫। সে সময় পোষ্য কোটার পাস নম্বর কমিয়ে ন্যুনতম ২৫ করেছিল কর্তৃপক্ষ।

পোষ্য কোটা বাতিলের দাবি শিক্ষার্থীদের

শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এই বিশেষ সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে এবারের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া বাকি ১ লাখ ১ হাজার ৩৮২ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে বৈষম্য করার শামিল বলে মনে করছেন অনেকেই।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কোটার আওতায় থাকা শিক্ষার্থীরা এমনিতেই নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। এরপরেও পাস নম্বর কমানোর কোনো সৎ যুক্তি থাকতে পারে না।

জোবায়দা নহর জবা নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, 'শিক্ষকদের সন্তান হিসেবে একজন শিক্ষার্থী যেখানে পড়াশোনার পরিবেশ থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা সবকিছু মানসম্মত সুবিধা পেয়ে বড় হয়, সেখানে গ্রাম থেকে উঠে আসা সাধারণ ঘরের ছেলে-মেয়েরা এসব সুবিধা পায় না। পরিবারের বিভিন্ন সমস্যা, অভাব-অনটন কাটিয়ে তারা ঠিকই মেধায় চান্স পায়।'

তিনি আরও বলেন, 'সে হিসেবে শিক্ষকদের সন্তানদের তো আরও ভালো ফল করে চান্স পাওয়ার কথা। তাদের জন্য কেন কোটার সুবিধা থাকবে? এটা তুলে দেওয়া উচিত।'

এখন ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেও কোটায় ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করবে আর ভবিষ্যতে এরাই আবার একই সুবিধা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর এক মানববন্ধনে মার্ক কমানোর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে পোষ্য কোটা বাতিলের দাবি জানায় রাবি শাখা ছাত্র অধিকার পরিষদ।

এমন সিদ্ধান্ত অনুচিত, তবে সিদ্ধান্ত পাশের সময় অনাপত্তি জানাননি সংশ্লিষ্ট কেউ

যে সভায় এই সিদ্ধান্ত পাস হয় সেখানে উপস্থিত ছিলেন এমন ৮টি অনুষদের ডিনের সাথে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। তাদের মধ্যে ৫ জন মনে করেন, এভাবে পাস নম্বর কমিয়ে ভর্তির সুযোগ দেওয়া 'অনুচিত'। এর মাধ্যমে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্পষ্টভাবে বৈষম্য করা হয়।

এই ৫ অধ্যাপক বলেন, তারা ব্যক্তিগতভাবে পাস নম্বর কমানোর সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন না। তবে এর আগেও একইভাবে নম্বর কমানো হয়েছে বিধায় এবারের সভাতে যখন বিষয়টি উপস্থাপিত হয়, তখন কেউ আপত্তি জানায়নি।

অতীত প্রশাসনের সময়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও নীতিমালা শিথিল হয়েছিল, বর্তমান প্রশাসন যদি এবার সে ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে চায়, তবে কি সেখানেও আপত্তি থাকবে না? এমন প্রশ্নে বিব্রত হয়ে মন্তব্য করতে অনীহা প্রকাশ করেন ৩ অধ্যাপক।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ইলিয়াছ হোসেন বলেন, 'ভর্তি প্রক্রিয়া শেষের দিকে থাকায় কোটাতে অনেক আসন ফাঁকা থেকে যাচ্ছিল। এ কারণে ভর্তিচ্ছুদের আবেদনের প্রেক্ষিতে এসব আসনে তাদের ভর্তি সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারে সভা হয়েছে। এতে সাধারণ পদ্ধতিতে যেসব শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হচ্ছে তাদের সঙ্গে কোনো বৈষম্য করা হচ্ছে না।'

'তবুও ব্যক্তিগতভাবে আমি এ ধরণের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করি না' বলে জানান তিনি।

অন্যদিকে ফিশারিজ অনুষদের ডিন ইসতিয়াক হোসেন বিতান বলেন, 'কোটা ব্যাপারটাই এক ধরনের বৈষম্য। তবে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য আজও এই সুবিধার প্রয়োজন রয়েছে।'

'সে জায়গা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে শিক্ষার্থীদের এই সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে। এটাই তাদের জন্য অন্যতম বড় একটি সুবিধা। স্বাভাবিকভাবে পরীক্ষায় যে পাস নম্বর রাখা হয়েছিল সে অনুযায়ীই তাদের ভর্তি নেওয়া উচিত।'

'এখন সেই নম্বরও যদি কমানো হয়, তবে তা কোনোভাবেই নৈতিক সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে আমি মনে করি না। কারণ যাদের জন্য এই সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে, তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় পারিবারিকভাবে অনেক বেশিই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকে।'

'কাজেই এমন সিদ্ধান্ত বৈষম্যের ওপরে বৈষম্য' বলে মন্তব্য করেন এই অধ্যাপক।

উপস্থিত ৮ জন অধ্যাপকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিদের চাওয়ার প্রেক্ষিতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ভবিষ্যতে এই প্রথা ভাঙার চেষ্টা করবে প্রশাসন

এ বিষয়ে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান উল ইসলাম বলেন, 'গতবারও এভাবে পাস নম্বর কমানো হয়েছিল। তবে এবার তারচেয়ে বেশি নম্বর রাখা হয়েছে। এটা এক ধরণের প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এ ধরনের বিষয় থেকেও আমরা বের হয়ে আসতে চাই। যেহেতু গত বছর থেকেই এটি চালু ছিল, তাই আমরা একবারে বন্ধ করতে সক্ষম হইনি। তবে ভবিষ্যতে এসব প্রথা ভাঙতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সর্বাত্মক সচেষ্ট থাকবে।'

উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এসব ব্যাপারে উপাচার্য একক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সুনির্দিষ্ট কমিটি গঠন করা থাকে, সে কমিটি হয়ে সভায় সবার সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।'

'আর তাছাড়া বহুদিন যাবত এভাবেই ভর্তি প্রক্রিয়া প্রচলিত হয়ে আসছে। কাজেই এবারও সেভাবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিটি। তবে সামনে আমরা চেষ্টা করবো কীভাবে এই ট্র্যাডিশন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, কীভাবে সরে আসা যায়।'

উল্লেখ্য, বিগত প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা শিথিল করে তার জামাই-মেয়েসহ অন্তত ৩৪ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলেন। নিয়োগে নানাধরনের অনিয়ম, স্বজনপ্রীতির অভিযোগে প্রথমাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং পরবর্তীতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানাবিধ তদন্তের সম্মুখীন হন তিনি। যা দেশব্যাপী সমালোচনার সৃষ্টি করে।

বিতর্কিত এই প্রশাসনের সময়েও ভর্তি পরীক্ষায় ৪৬ জন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য শিক্ষার্থীকে পাস নম্বর কমিয়ে পোষ্য কোটার আওতায় ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

Comments

The Daily Star  | English

Pollution claims 2.72 lakh lives in one year

Alarming levels of air pollution, unsafe water, poor sanitation, and exposure to lead caused over 2.72 lakh premature deaths in Bangladesh in 2019.

5h ago