‘গণরুমেই’ ফিরলেন ঢাবি শিক্ষার্থীরা, ছাত্রলীগের ‘গেস্টরুমও’ চলছে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আবাসিক হলগুলো থেকে গণরুম সংস্কৃতি বিলুপ্তির 'কঠোর পরিকল্পনা' ছিল প্রশাসনের। কিন্তু হল খোলার পর সে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি। বিষয়টি এখন থেকে গেল কেবল কাগজে-কলমে।
এ বছর করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় গণরুম সংস্কৃতি বিলুপ্ত করতে বেশ তোড়জোড় ছিল প্রশাসনের। কিন্তু প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের সিটের ব্যবস্থা না হওয়ায় তাদের বাধ্য হয়ে আবার ফিরতে হয়েছে গণরুমেই।
গণরুমে ৮ জনের একটি কক্ষে একসঙ্গে গাদাগাদি করে ৩০-৩৫ জন শিক্ষার্থীকে মেঝেতে ঘুমাতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকটের জন্যই এভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয় শিক্ষার্থীদের। কিন্তু আবাসন সংকটের চেয়ে অনেকটা রাজনৈতিক কারণে গণরুমের সৃষ্টি বলে মনে করেন অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী।
প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য সিটের ব্যবস্থা করে না হল প্রশাসন। তাই সিট না পেয়ে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের হাত ধরে গণরুমগুলোতে ঠাঁই নেন তারা। এর পরিবর্তে তাদের রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতে হয়। না গেলে রাতে গেস্টরুমে জবাবদিহিতা করতে হয়। অথচ যে রুমগুলোকে গণরুম বলা হচ্ছে, সে রুমগুলোর ব্যবস্থাপনার যাবতীয় দায়িত্ব হল কর্তৃপক্ষেরই। কিন্তু রুমগুলো ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের দখলে থাকে।
গণরুম সংস্কৃতি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের সময় বিভিন্ন হল কর্তৃপক্ষ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিল, গণরুমের বাসিন্দা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের সাবেক ছাত্রদের দখলে থাকা কক্ষে বরাদ্দ দেওয়া শুরু করেছেন তারা। হল খুললেই বরাদ্দকৃত কক্ষে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের তুলে দেওয়া হবে।
দেড় বছর পর গত ৫ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আবাসিক হল খুলে দেওয়া হয়। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, 'গণরুমের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পছন্দ করছেন না। শিক্ষার্থীদের জীবনমানে ঘাটতি পড়ুক, একটা প্রতিকূল পরিবেশ থাকুক, এটা তিনি কোনোভাবেই চান না। তিনি আমাকে বেশ কয়েকবার পরামর্শ দিয়েছেন গণরুমের বিষয়টির সুরাহা করতে। এখন সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা দরকার।'
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গত ৫ অক্টোবর শুধু অনার্স চতুর্থ বর্ষ এবং মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের জন্য খুলে দিয়েছে হল। প্রথম দিনেই হলগুলোতে নিয়মিতদের সঙ্গে সাবেক শিক্ষার্থীরা গোপনে প্রবেশ করেন। অন্যান্য বর্ষের অনেক নিয়মিত শিক্ষার্থীও হলে ঢুকে পড়েন।
গতকাল রোববার সকাল থেকে সব বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য হল উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এরপর প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে প্রবেশ করতে দেখা যায়। যদিও তাদের বেশিরভাগই আগেই হলে প্রবেশ করেছেন। হল কর্তৃপক্ষ তাদের মাস্ক দিয়ে, হ্যান্ড স্যানিটাইজ করে, ফুল এবং চকলেটের মাধ্যমে হলে বরণ করে নেয়। কিন্তু হলে উঠার পর তারা কোথায় থাকবেন, সে পথ খুঁজে না পেয়ে ধীরে ধীরে গণরুমগুলোর দিকে ঠেসতে থাকেন। সারাদিন কাটে তাদের এদিক-সেদিক করে। রাত ঘনিয়ে এলে নিরুপায় হয়ে শিক্ষার্থীরা আগের মতোই গণরুমে থাকা শুরু করেন। হল প্রশাসন যদিও সাবেক ছাত্রদের দখলে থাকা কক্ষে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বরাদ্দ দিয়েছে, কিন্তু সাবেক শিক্ষার্থীদের হলে প্রবেশ ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ঠাঁই মিলেছে সেই পুরনো গণরুমে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলে গতকাল হল ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গণরুমে তুলতে গেলে প্রশাসনের বাধার সম্মুখীন হন। পরে হল প্রশাসনের সঙ্গে তাদের বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে গণরুমে শিক্ষার্থীরা উঠে যান। স্যার এ এফ রহমান হলেও একই ঘটনা ঘটেছে।
এ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম খান গতকাল রাতে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হলের গণরুমে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা উঠতে চাইলে আমরা তাদের নিষেধ করি। আমরা গণরুম বিলুপ্ত করে দিয়ে সেখানে ৪টি খাট বসিয়েছি। একটি রুমে ৮ জন করে কয়েকটি রুমে তাদের থাকতে দিয়েছি। বাকি ১০ জনের মতো শিক্ষার্থীর আবাসন সংকট ছিল। তাদের থাকার জন্য আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি। আমরা জানতে পেরেছি, ১০ জনের মতো সাবেক শিক্ষার্থী হলে গোপনে প্রবেশ করেছেন। তাদের দখলে থাকা কক্ষগুলো উদ্ধার করে তারপর প্রথম বর্ষের ওই ১০ জনের থাকার ব্যবস্থা করব। এ বিষয়টি সাবেক শিক্ষার্থীদের জানাতে আবাসিক শিক্ষকদের বলা হয়েছে।'
স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ছাত্রলীগের 'গেস্টরুম'
করোনা পরিস্থিতিতে হলের গেস্টরুমে শিক্ষার্থীদের নিয়ে জমায়েত করতে নিষেধ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কোভিড-১৯ চলাকালে নির্দেশিকা (এসওপি) অনুসরণ করে চলতে বলা হয়েছে শিক্ষার্থীদের। কিন্তু শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে আগের মতোই গণরুমে থাকা শিক্ষার্থীদের ডেকে জমায়েত করে গেস্টরুম নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। এসওপি'র নিয়ম ভেঙে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন করতে গেস্টরুমে ডাকা হয়েছে বলে জানায় হল শাখা ছাত্রলীগ। গেস্টরুমে মূলত গণরুমে থাকা শিক্ষার্থীদের ডেকে শাসন করা হয়। হলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই এটি করে থাকেন।
জানতে চাইলে জহুরুল হক হলের ছাত্রলীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলের গণরুমেই শিক্ষার্থীরা উঠে গেছেন।'
গেস্টরুমের বিষয়ে তিনি বলেন, 'আমরা শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে সচেতন করতে গেস্টরুমে ডেকেছি।'
শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এসওপি'র নিয়মাবলী ভঙ্গ করা হয়েছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'রাজনীতি করতে হলে এগুলো করতে হয়, সেটা সবাই জানেন।'
গণরুম সংস্কৃতি বিলুপ্ত করতে বেশ কঠোর পরিকল্পনা ছিল প্রশাসনের। প্রত্যেক হলের গণরুম হিসেবে ব্যবহৃত কক্ষগুলোতে অন্য রুমের মতো খাট বসিয়ে সেখান নিয়মিত শিক্ষার্থীদের বরাদ্দ দেওয়া হয়।
বিজয় একাত্তর হলে প্রাধ্যক্ষ ও প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিজয় একাত্তর হলের গণরুমে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা উঠেছেন, এটা সত্য কথা। কিন্তু তাদের আমরা সাময়িক সময়ের জন্য সেখানে অবস্থান করতে দিয়েছি। দুয়েক দিনের মধ্যে তাদের কক্ষ বরাদ্দ দিয়ে দেওয়া হবে। এরপর তারা নিজ নিজ কক্ষে চলে যাবেন। গণরুম থাকছে না।'
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো . আখতারুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হল কেবল খুলেছে। দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত সংকট সবার সহযোগিতা পেলে নিরসন হবে।'
Comments