
নাম অঞ্জন ভূমিজ। বাংলাদেশের ভূমিজ সম্প্রদায়ের একজন। তিনি মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ভূমিজদের মধ্যে তিনিই প্রথম যিনি চা বাগানের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন।
অঞ্জনের বাবা স্থায়ী চা শ্রমিক আর মা অস্থায়ী। বাগানের কাজ ছাড়া বছরের বাকি সময় তারা দিনমজুরের কাজ করেন। এই পরিবারের সাপ্তাহিক আয় ১ হাজার ৫০ টাকা।
মৌলভীবাজার জেলার জুড়ি উপজেলার ফুলতলা চা বাগানের এলবিনটিলা চা পল্লিতে অঞ্জনের বেড়ে উঠা। মায়ের নাম রতনমনি ভূমিজ, বাবা অমৃত ভূমিজ। ৩ ভাই-বোনের মধ্যে অঞ্জন বড়। ছোট বোন অঞ্জলী পড়ছেন এশিয়ান ইউনিভারসিটি ফর উইমেন-এ। অন্যজন এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে।
অঞ্জন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বিষয়টি এক সময় স্বপ্নের মতো মনে হতো। ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে অনেক ভয় হয়েছিল। এতটাই আতঙ্কিত ছিলাম যে, কিছু প্রশ্নের উত্তর ভুল হয়েছিল।'
স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরে ভীষণ আনন্দিত অঞ্জন। বললেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষে এসে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, অন্ধকার দিনের শেষে আলো দেখছি। খুব ভালো লাগছে।'
শৈশবের কথা মনে করে তিনি বলেন, 'ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি আমাদের চা বাগানের সব পরিবার দরিদ্র। শিক্ষিতের হার খুবই কম। গ্রামের কারো আর্থিক অবস্থা ভালো না। আর্থিক সংকটের কারণে ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে দ্রুত ঝরে পড়ে। এটা দেখে আমার খুব খারাপ লাগে। চা বাগানের কেউ পড়ালেখার জন্য উৎসাহ দিতেন না।'

'বাবা বলতেন—"পড়াশোনা করে কী লাভ। চা শ্রমিকের সন্তান চা বাগানেই কলম কাটবি"—এসব কথা এক সময় কষ্ট দিলেও এখন আমি সেই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছি।'
'ছোটবেলা থেকে ইচ্ছা ছিল উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হব। গরিব হওয়াটা পথের বাধা হয়ে দাঁড়ায়।'
জন্মের পর থেকে যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তাদের একজন অঞ্জন। স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথাও কখনো ভাবেননি। পড়ালেখার প্রতি ছোটবেলা থেকে অদম্য ইচ্ছা থাকলে তাকে কী আর পড়ালেখা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়।
অঞ্জন বলেন, 'আর্থিক অনটনের কারণে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে লেখাপড়ার পাশাপাশি কাজ করছি। ছুটিতে বেশি করে কাজ করতাম। বাবার সামর্থ্য খুব একটা না থাকায় পরিবারের অনেক দায়িত্ব আমার কাঁধে এসে পড়ে। পড়ালেখার পাশাপাশি মায়ের সঙ্গে খাসিয়া পুঞ্জিতে গিয়ে দিনমজুরের কাজ করি।'
'ঈদ-পূজাসহ অন্যান্য ছুটিতে আমি পুঞ্জিতে কাজ করে পড়ার খরচ যুগিয়েছি,' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'পুঞ্জিতে কাজ করার সময় আমি সব রকমের কাজ করি। করোনা মহামারির সময় আমার ভার্সিটির ফিস যোগাড় করতে পুঞ্জির মানুষের পোষা প্রাণীদের খাওয়ানোর জন্য পাহাড় থেকে কচু এনে দিতাম। এতে মজুরির সঙ্গে ৫০ টাকা বেশি পেতাম।'
'মহামারির পুরো সময় পুঞ্জিতে কাজ করেছি। সকালে যেতাম সন্ধায় আসতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ কমানোর আশায় ছুটি পেলেই বাড়িতে এসে পুঞ্জির কাজে চলে যেতাম। আয় দিয়েই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ মেটাচ্ছি। করোনার প্রকোপ কমার পরও টিউশনি পাচ্ছি না।'
তিনি জানান, তার বাবাকে টাকার কথা বললে তিনি গরু বিক্রি করে বা মহাজন বা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে তাকে দেন। 'তারপর তিনি ঋণের বোঝা টানতে থাকেন। তাকে যেন এমনটি করতে না হয় সে জন্য আমি সবসময় কাজ খুঁজি।'
'বাড়িতে গেলেই কারো ধান কেটে দিই, কোদাল দিয়ে মাটি কাটি, ধান রোপন করি। কাজ না পেলে পুঞ্জিতে চলে যাই। তখন কিছু আয় হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকলে রুমে রুমে খাবার ডেলিভারি দিই। প্রতিদিন ১০০ টাকা পাই।'
অঞ্জনের চোখে স্বপ্ন। আজ সে স্বপ্ন তার নিজেকে ছাড়িয়ে নিজ সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'চা বাগানের সংস্কৃতি আমাকে অনেক বেশি টানে। আমি আমার সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য-ইতিহাস সবাইকে জানাতে চাই।'
গত বুধবার ফোন দিলে অঞ্জন বলেন, 'এই মাত্র খাবার ডেলিভারি দিয়ে আসলাম।' জানান, আত্মবিশ্বাসের কারণে প্রতিকূল পরিবেশেও পড়ালেখা থামেনি।
'দেশে ভূমিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে অঞ্জনই প্রথম যিনি কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন,' উল্লেখ করে বাংলাদেশ ভূমিজ ছাত্র সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কৃষাণ ভূমিজ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তাকে দেখে আমরা উৎসাহিত হই। তার কঠোর পরিশ্রম আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আশা করছি, তিনি ভূমিজ শিশুদের পড়ালেখায় অবদান রাখবেন।'
Comments