বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভাবমূর্তি’ কী এবং কীভাবে তা ‘ক্ষুণ্ন’ হয়

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোয়াককোয়ারেল সাইমন্ডস (কিউএস) বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করে যে তালিকা দিয়েছে, সেখানে ৮০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। অন্যদিকে গত কয়েক বছর ধরে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে নানা অনিয়ম, গাফিলতি ও দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে।

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোয়াককোয়ারেল সাইমন্ডস (কিউএস) বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করে যে তালিকা দিয়েছে, সেখানে ৮০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। অন্যদিকে গত কয়েক বছর ধরে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে নানা অনিয়ম, গাফিলতি ও দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যমে যে সংবাদ প্রকাশ এবং সমালোচনা হয়, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ হয় বলে অভিযোগ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সামাজিক ও গণমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’ হবে এমন কিছু লেখা যাবে না জানিয়ে বিভিন্ন সময় বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভাবমূর্তি’ কী এবং কীভাবে তা ‘ক্ষুণ্ন’ হয়? দ্য ডেইলি স্টার টেলিফোনে কথা বলেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের সঙ্গে।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন ও অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। (বাম দিক থেকে)

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা, সেখান থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়রে ভাবমূর্তি তৈরি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সামাজিক ও বুদ্ধিভিত্তিক দায় নিয়ে মুক্ত চিন্তা করে সৃজনশীলতার মধ্যে থাকবে, গবেষণার মধ্যে থাকবে এবং পুরো সমাজের জন্যে প্রয়োজনীয় অনেক কাজ করবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মেরুদণ্ড থাকবে এবং তারা স্বাধীন চিন্তা করতে সক্ষম হবে। তাদের চিন্তা, মতামতের ওপর রাজনৈতিক দল বা সরকার নির্ভর করবে। এগুলোই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে প্রত্যাশা এবং এগুলো থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি তৈরি হয়।’

তিনি বলেন, ‘যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্ত চিন্তার পরিবেশ থাকে না, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গবেষণার চাইতে সরকারের তোষামোদি করায় ব্যস্ত থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া দুষ্টচক্রের মধ্যে আবদ্ধ থাকে, নিয়োগ প্রক্রিয়া অর্থ বা তদবিরের ওপর নির্ভরশীল হয়, গবেষণা গুরুত্ব না পেয়ে যেখানে দলাদলি বেশি গুরুত্ব পায় এবং এমন সব লোককে সরকার নিয়োগ দেয় যাদের কাজ শিক্ষা গবেষণা নয়, তাদের কাজ হচ্ছে সরকারের শ্রুতিগান গাওয়া বা সরকারের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রিত করা, তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।’

‘বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে যখন বিনা বাধায় ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের টর্চার চেম্বারে নিয়ে নির্যাতন করে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়’, বলেন তিনি।

আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘এই বিষয়গুলোর প্রতিবাদ যদি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্থাপিত হয়, সেটিই বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে। কারণ, তখন প্রমাণিত হয় যে সব শিক্ষক বা শিক্ষার্থী এই দুষ্টচক্রের মধ্যে নিমজ্জিত হয়নি। মেরুদণ্ড হারায়নি বা মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় হয়নি।’

বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যে স্বাধীন ভূমিকা, সমাজের মধ্যে যে স্বাধীন মতামত, সেটির বিরুদ্ধে এক ধরনের সরকারি জিহাদ চলছে উল্লেখ করে আনু মোহাম্মদ বলেন, ‘সরকার ব্যাপকমাত্রায় এগুলো দমনের জন্যে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি নিচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থেকে শুরু করে, বিভিন্ন দমন-নিপীড়ন, হুমকি-ধামকি, হামলা-গুম নানা কিছু ব্যবহার করছে অস্ত্র হিসেবে। অন্যদিকে অযোগ্য তোষামোদি, মেরুদণ্ডহীন লোকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। তাদেরকে বিভিন্ন উচ্চ পদে বসাচ্ছে।’

‘সরকার ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে এবং শিক্ষক নেতাদের দিয়ে অন্য শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। যাদের মধ্যে দাসানুদাস চিন্তা থাকে, তারা কখনো স্বাধীনভাবে কিছু ভাবতে পারে না। তার সারাক্ষণ আতঙ্কের মধ্যে থাকে যে কখন তাদের প্রভু তাদের ওপরে ক্ষিপ্ত হয়। এই আতঙ্কের মধ্যে যারা থাকে, তারা অসুস্থ লোকজন। তারা কোনোভাবেই মত প্রকাশ সহ্য করতে পারে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা চাপের মধ্যে পড়ে যায়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এখন এই ধরনের লোকজন দিয়ে চলছে।’

তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আত্মসম্মানবোধ হারিয়ে যখর প্রভুর পেছনে ছুটতে থাকে, তখন মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলতে আর কিছু থাকে না। সমাজে যদি চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকে, তবে ভুল বা জনবিরোধী চিন্তা পরাজিত হবে। আর যদি তা না থাকে, তবে ক্ষমতার অনুগ্রহে ভুল ও জনবিরোধী চিন্তাই প্রাধান্য লাভ করে এবং তাকে মোকাবিলা করার জন্য সমাজের যে শক্তি, তা কখনই তৈরি হয় না। আর সমাজ তা মোকাবিলা করতে না পারলে সেই সমাজ সামনে এগিয়ে যেতে পারে না।’

অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেমন যোগ্য লোকের প্রয়োজন, তেমন লোককে চেয়ারে বসানো হয় না বলে তারা বুঝতে পারে না আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাব কী। তখন তারা কল্পনা করে একটি মূর্তি বানায়, যেটি অনেক ভঙ্গুর। তাদের দৃষ্টি থাকে এই বুঝি কেউ মূর্তিটাকে ভেঙে ফেলল। অযোগ্য মানুষ সবসময়ই ভাবমূর্তি নিয়ে টেনশনে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে শিক্ষার্থী কোথায় যায়, কোন জায়গায় চাকরি করে, শিক্ষকরা কত বড় গবেষক, প্রশাসন কত ভালো, এসব দিয়েই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি তৈরি হয়। যারা বড় বড় পদে আছেন বা যারা বিশ্ববিদ্যালয় চালায়, তাদের অযোগ্যতার কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। কোনো সাধারণ শিক্ষক বা শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি কখনই নষ্ট করতে পারে না।’

অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ক্ষেত্র বিশেষে নিজের অনিয়ম, অযোগ্যতা ঢাকতে, প্রতিশোধ নিতে, কারো প্রতি রাগ মেটাতে বিভিন্ন সময়ে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগ তোলে। যারা প্রশাসনের মতে চলে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয় না। অভিযোগ আনা হয় তাদের বিরুদ্ধে, যারা সত্য কথা বলে।’

‘বিশ্ববিদ্যালয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত। বিশ্ববিদ্যালয় হলো স্বাধীনভাবে চলার একটি ক্ষেত্র। দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মাথা উঁচু করে চলতে পারার নাম হলো বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হলে সেই বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়াতে পারে না’, যোগ করেন তিনি।

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি হলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক এবং এখানে জ্ঞান চর্চা কীভাবে হয়, তা। গবেষণা কতটা হয়। শিক্ষার্থীরা হলে ভালোভাবে থাকতে পারে কি না। সবমিলে একটা মেধার চর্চা হয় কি না। বিশ্ববিদ্যালয় গুণগত, মানগত শিক্ষা দিতে পারে কি না। অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব তৈরি করতে পারে কি না, সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ।’

‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তির মূল জায়গা হচ্ছে একটা ধর্ম নিরপেক্ষ, আধুনিক বিজ্ঞানমনষ্ক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পারা। যে দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে মানুষের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হবে, পরিবেশ প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা তৈরি হবে। এমন একটি মানবিক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে পারলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি বাড়ে।’

রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় যদি এই মানবিক জায়গায় না থাকে, বিশ্ববিদ্যালয় যদি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সূতিকাগার হয়ে ওঠে, গবেষণা ঠিকমতো না হয়, জ্ঞান চর্চা ঠিকমতো না হয়, নিয়োগ প্রক্রিয়া যদি দলীয় বিবেচনায় হয়, মেধা যদি পেছনে পড়ে থাকে, আবাসিক হলে যদি শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো না থাকতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্বাচনের নামে যদি ভোট চুরি হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।’

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু জনগণের টাকায় চলে, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ ও গঠনমূলক সমালোচনা শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমের রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কোনো স্বাধীনতাই সীমাহীন না। কারো স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন না করে নিজের মতপ্রকাশ করা যাবে। দায়িত্বশীলতার সঙ্গে নিজের মনের ভাব চর্চা করার নাম হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এই মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের আছে।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমান সময়ে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চায় না মত প্রকাশ হোক। উভয়ই ভয় পায়। তারা এক ধরনের “ভয়ের সংস্কৃতি” তৈরি করে রাখে। কোনো কিছু বললেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে এমন অভিযোগ তোলে।’

‘রাষ্ট্রে যেহেতু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত। তার প্রতিফলন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর পড়েছে। রাষ্ট্রে যদি মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকে, তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও থাকবে। কিন্তু, রাষ্ট্র সেই সুযোগ দিচ্ছে না বলেই বিশ্ববিদ্যালয়েও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই’, যোগ করেন অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।

Comments

The Daily Star  | English

Trade at centre stage between Dhaka, Doha

Looking to diversify trade and investments in a changed geopolitical atmosphere, Qatar and Bangladesh yesterday signed 10 deals, including agreements on cooperation on ports, and overseas employment and welfare.

2h ago