তাছলিমা শিরিন মুক্তার স্বপ্নজয়ের ইতিবৃত্ত

স্বপ্নের ডানা মেলে নীল আকাশে ওড়ার সাধ আশৈশবের লালিত। দারিদ্রপীড়িত সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত দেশের দ্বীপাঞ্চলে জন্ম নেওয়া এক কিশোরী তাছলিমা শিরিন মুক্তা। ১৪ বছর বয়সে তার যখন মা-বাবার স্নেহের আঁচলে বেড়ে ওঠার কথা তখন তাকে হতে হয় সামাজিক সমস্যার দুষ্টচক্রের শিকার। নবম শ্রেণীতে থাকতেই বিয়ে হয়ে যায় তার। আকাশে ওড়ার ডানাগুলো বিকশিত হতে দেওয়ার পরিবর্তে কেটে দেওয়া হয় সব পালক।
তাছলিমা শিরিন মুক্তা। ছবি: সংগৃহীত

স্বপ্নের ডানা মেলে নীল আকাশে ওড়ার সাধ আশৈশবের লালিত। দারিদ্রপীড়িত সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত দেশের দ্বীপাঞ্চলে জন্ম নেওয়া এক কিশোরী তাছলিমা শিরিন মুক্তা। ১৪ বছর বয়সে তার যখন মা-বাবার স্নেহের আঁচলে বেড়ে ওঠার কথা তখন তাকে হতে হয় সামাজিক সমস্যার দুষ্টচক্রের শিকার। নবম শ্রেণীতে থাকতেই বিয়ে হয়ে যায় তার। আকাশে ওড়ার ডানাগুলো বিকশিত হতে দেওয়ার পরিবর্তে কেটে দেওয়া হয় সব পালক।

২০০৩ সালের ১৬ অক্টোবর তার স্বপ্ন ভঙ্গের শুরু। সেদিন তার বিয়ে হয়। যখন তার উড়ে বেড়ানোর কথা দুনিয়া জুড়ে, তখন তিনি কোনো এক ছোট্ট বাড়ির রান্না ঘরে রান্নায় ব্যস্ত। নিজের স্বপ্নগুলো চোখের জলে কবর দিতে দিতেই ছোট্ট মনে প্রশ্ন জাগে, বিয়ে মানেই সব শেষ? তার ভেতর থেকে উত্তর আসে, মোটেও না। যখন অন্য কেউ আলোকবর্তিকা হয়ে পথ দেখায় না, তখন নিজের পথের আলো নিজেকেই জ্বালাতে হয়। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রতিরাতে বই নিয়ে পড়তে বসে গেলেন কিশোরী মেয়েটি।

নবম শ্রেণি পেড়িয়ে যখন তিনি দশম শ্রেণিতে তখন টের পেলেন তার ভেতরে বেড়ে উঠছে আরেকটি শিশু। ধীরে ধীরে পরিবারের সবাই তার পড়ালেখার প্রতি বিরক্ত হতে থাকে। সব দিক থেকে চাপ আসে, আর পড়াশুনার দরকার নেই। তাদের মতে, এতে বাচ্চার ক্ষতি হবে।

অথচ তাছলিমা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন, নিজের এবং অনাগত সন্তানের জন্য একমাত্র আলোকবর্তিকাই হবে লেখাপড়া। ৭ মাসের বাচ্চা গর্ভে নিয়ে সামাজিক লজ্জা, ভয় আর সংশয় নিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় বসেন তিনি। চারপাশে উৎসাহ দেওয়ার মানুষ না পেলেও স্বপ্ন ভেঙে দেওয়ার প্রচেষ্টাকারীর অভাব ছিল না। যেদিন এসএসসির ফল এলো, সেদিন তিনি ১৬ বছরের শিশু। তার এক হাতে ২৯ দিনের সন্তান আর অন্য হাতে পরীক্ষার ফল।

সব ভয় আর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এক অসীম সাহস নিয়ে এক অখ্যাত কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। বিজ্ঞান বিভাগে ৪ দশমিক ৯৪ পেয়েও মানবিকে ভর্তি হন। ২ বছর সংসার, রান্না আর আনাড়ি হাতে মায়ের ভূমিকা নেভাতে ক্লান্ত তিনি। রাত ছাড়া বই হাতে নিতেই পারতেন না।

সবাই যখন ঘুমাতে যায়, তিনি তখন নিশাচর হয়ে বইয়ের নেশায় বুদ হয়ে থাকেন। বাচ্চা উঠে যাওয়ার চিন্তায় মন বসে না পড়ায়। এমনও সময় কেটেছে, সারারাত বাচ্চা ঘুমাচ্ছে না। সারা রাত জেগে আবার দিনের বেলায় গৃহিণীর কাজ। দিনের পর দিন কেটেছে তার পড়াশুনা থেকে দূরে। যখন তার সহপাঠীরা মায়ের পাশে পরম যত্নে বইয়ের পাতায় চোখ বুলাচ্ছে, হাজারো বায়না ধরছে বাবা-মায়ের কাছে, তখন তার রাত কাটে কোলের শিশু পালনের নিয়ম শেখার যুদ্ধে।

একাদশের ফাইনাল পরীক্ষার সময় তার সন্তানের ডায়রিয়া শুরু হয়। ৪টি পরীক্ষা দেওয়ার পর ৭ দিন তাকে কাটাতে হয় হাসপাতালে। তখন কলেজ কর্তৃপক্ষ যদি সহায়তা না করত, হয়ত একটা বছর নষ্ট করতে হতো তাকে। তিনি শেষ পর্যন্ত এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করলেন জিপিএ ৪ দশমিক ৩ পেয়ে।

তার সহপাঠীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধে প্রবল ব্যস্ত তখন তিনি ব্যস্ত পড়ালেখার অনুমতি পাওয়ার যুদ্ধে। প্রতিবাদ করতে শুরু করলেন, 'পড়ালেখা আমার অধিকার, কারো অনুমতি আমার চাই না।' এতো বড় কথা! এ নিয়ে হওয়া প্রবল ঝগড়ায় শাপে বর পেলেন তিনি। চলে গেলেন বাবার বাড়ি, কাউকে না জানিয়ে।

চট্টগ্রাম কলেজে তিনি অনার্সে ভর্তি হন। বিষয় হিসেবে পান রাষ্ট্রবিজ্ঞান। ১ম বর্ষে ফার্স্ট ক্লাস পান তিনি। সেই সময়েই তার গর্ভে আসে দ্বিতীয় সন্তান। দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার সময় সন্তানের বয়স ৩ মাস। চোখে অন্ধকার দেখেন তিনি। এই ছোট্ট শিশু কার কাছে রেখে ৪ ঘণ্টার পরীক্ষা দেবেন? মেজ বোনের কোলেও দুধের বাচ্চা থাকায় তার কাছে রেখেই পরীক্ষা দিলেন। ক্লাস শরীরে ঘরে ফিরে নিতে পারেননি বিশ্রাম। আবার সেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বাড়ির কাজে।

অনার্সের পরীক্ষা শেষ করে তার চিন্তা আসে, এখন কী করবেন। পরামর্শ দেওয়ার কাউকে পাননি। পরীক্ষা শেষে বাসায় ফেরার সময় পান একটি লিফলেট, বিসিএস কোচিংয়ের।

তিনি বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে চান শুনে সবার মধ্যে হাসাহাসি শুরু হয়। সব ভুলে তিনি মন দেন পড়ায়।

৩৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পাস করে তিনি স্বপ্ন দেখতে থাকেন বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। অক্লান্ত পরিশ্রমে পাস করেন লিখিত পরীক্ষাতেও। সব পর্ব পেরিয়ে ২০১৬ সালের আগস্টে পান ফল।

প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিলেন তাছলিমা। এটা তার ১৩ বছরের সাধনার ফসল। নবম শ্রেণি পাস গৃহিনী থেকে হয়ে গেলেন সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট।

দ্য ডেইলি স্টারকে তাছলিমা বলেন, 'সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগদান করেছি হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। জেলা প্রশাসনের অন্যতম চ্যালেঞ্জিং পদ নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি)। হবিগঞ্জ জেলায় প্রথম নারী নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। হবিগঞ্জ থেকে বদলি হয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে, ফেনী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে, সোনাগাজী উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে কাজ করেছি।'

বর্তমানে তিনি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

তিনি আরও বলেন, 'এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রায় ৫ বছরে ৪টি জেলায় ৩০০টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছি। সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে কাজ করতে গিয়ে খাস জমি রক্ষা, নদীতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, অবৈধ উচ্ছেদসহ নানান চ্যালেঞ্জিং কাজ করেছি। অনেক সময় প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়েছে, বিরাগভাজন হতে হয়েছে প্রভাবশালী মহলের।'

করোনা মহামারির সময় মাঠে কাজ করতে করোনা পজিটিভ হয়েছিলেন তাছলিমা। সুস্থ হয়ে আবার যোগ দেন কাজে।

'কাজ করতে চাই নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায়। বিশেষ করে তাদের নিয়ে কাজ করতে চাই যারা অকালে পড়ালেখা থেকে ঝড়ে পরে এবং কম বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৫০টিরও বেশি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছি এবং অসচ্ছল কিশোরীদের পড়ালেখার সুযোগ নিশ্চিতের জন্য কাজ করে যাচ্ছি,' বলে যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'বিয়ে মানেই শেষ নয়—এই বিশ্বাস নারীদের মধ্যে জাগ্রত করতে চাই। চাইলেই সম্ভব স্বপ্ন জয় করা। তবে চাইতে হবে শক্তভাবে।'

চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার হারামিয়া ইউনিয়নের হারামিয়া গ্রামের মুসলিম মাঝির বাড়ি'র মনজুরুল ইসলাম ও সালমা বেগমের সন্তান তাছলিমা শিরিন এবার নিজ উপজেলা ও জেলায় শিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী ক্যাটাগরিতে জয়ীতা হয়েছেন।

জেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয়ের উপপরিচালক নাসরিন সুলতানা বলেন, 'আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ এবং "বেগম রোকেয়া দিবস" উপলক্ষে দেশের প্রতিটি উপজেলায় ৫ ক্যাটাগরিতে ৫ জনকে "জয়ীতা অন্বেষণে বাংলাদেশ" কার্যক্রমের আওতায় জয়ীতা নির্বাচন করা হয়। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে আমরা যাচাই-বাছাই করে জয়ীতা নির্বাচন করি।'

মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুর লতিফ বলেন, 'তাছলিমা শিরিন অত্যন্ত দায়িত্ববান এবং তড়িৎকর্মা। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তিনি একজন সংগ্রামী নারী। দেশের নারী এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি একটি অনুপ্রেরণার উৎস।'

Comments

The Daily Star  | English

The war that we need to know so much more about

Our Liberation War is something we are proud to talk about, read about, and reminisce about but have not done much research on.

8h ago