অ্যান্টার্কটিকা: যাদুকরী এক শুভ্র মহাদেশ

এটা কি বাস্তব? মানুষের কোলাহলের বাইরে রহস্যময় চোখ ধাঁধানো ধবধবে সাদা চারপাশ। যতদূর চোখ যায় কেবল শুভ্রতা।
ছবি: রেজাউল বাহারের সৌজন্যে

এটা কি বাস্তব? মানুষের কোলাহলের বাইরে রহস্যময় চোখ ধাঁধানো ধবধবে সাদা চারপাশ। যতদূর চোখ যায় কেবল শুভ্রতা।

পৃথিবীর শেষ ভাগের এই পুরো মহাদেশটি একেবারে বিচ্ছিন্ন, মোটা বরফের চাদরে আচ্ছাদিত। এখানে মানুষের নয়, রাজত্ব চলে পেঙ্গুইন, তিমি আর অ্যালবাট্রসের।

ছবি: রেজাউল বাহারের সৌজন্যে

এই রাজ্যের নাম অ্যান্টার্কটিকা। সম্প্রতি আমার স্ত্রী শারমিনের সঙ্গে ঘুরে এসেছি এই জাদুকরী মহাদেশ থেকে।

২০০৮ সালে আমরা যখন প্রথম নিজেদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণে বাহামা যাই, তখন বুঝতেই পারিনি ভ্রমণের এমন নেশা আমাদের পেয়ে বসবে। এরপর থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারির মধ্যে আমরা ঘুরেছি বিশ্বের প্রতিটি কোণায়, সাতটি মহাদেশে, ৮৩টি দেশ।

ছবি: রেজাউল বাহারের সৌজন্যে

কিন্তু অ্যান্টার্কটিকা কখনো যাব সেটা আমাদের পরিকল্পনায় ছিলই না। এর সবচেয়ে বড় কারণ ছিল খরচ। আমরা ২ জনই রোজগার করলেও অ্যান্টার্কটিকা যাওয়ার জন্য অর্থ গোছাতে আমাদের বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।

অনেক পরিকল্পনার পর ২০১৯ সালের আগস্টে শেষ পর্যন্ত আমরা সিদ্ধান্তটি নিয়েই ফেলি। ৩২ হাজার ডলারের চেক লিখে ফেলি এই ভ্রমণের জন্য। নির্ধারিত হয় ২০২০ সালের নভেম্বরে যাব অ্যান্টার্কটিকায়। যাওয়ার প্রায় ১৫ মাস আগেই পরিশোধ করা হয় খরচের টাকা।

কিন্তু হঠাৎ করেই চলে আসে করোনা মহামারি। আমাদের ট্যুর অপারেটর সিলভারসি ভ্রমণের তারিখ পরিবর্তন করে। ঠিক হয় ২০২১ সালে ২১ ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৫ দিনের ক্রুজ প্যাকেজ হবে আমাদের। সব খরচ অন্তর্ভুক্ত এই প্যাকেজের দাম এখন ৪৮ হাজার ডলার। ভাগ্যিস, প্রায় আড়াই বছর আগে প্যাকেজ নেওয়ায় আমাদেরকে আর বাড়তি টাকাটা দিতে হয়নি।

ছবি: রেজাউল বাহারের সৌজন্যে

অবশেষে ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর আমাদের যাত্রা শুরু হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট থেকে আমাদের গন্তব্য চিলির সান্তিয়াগো। সিলভারসির চার্টার্ড ফ্লাইট আমাদের নিয়ে যায় পুন্টা এরিনাসে। সেখান থেকে ২১ ডিসেম্বর আমরা উঠি সিলভারসি ক্লাউড এক্সপিডিশনশিপে।

জাহাজটি বন্দর ছেড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে আমরা সত্যিই অ্যান্টার্কটিকায় যাচ্ছি। এত বছরের পরিকল্পনা, এত বাধা পেড়িয়ে শেষ পর্যন্ত সত্যিই আমরা অ্যান্টার্কটিকায় যাচ্ছি।

রহস্যে ঢাকা মহাদেশটিতে পৌঁছাতে আমাদের ড্রেক প্যাসেজ অতিক্রম করতে হয়েছে। এর জন্য সময় লেগেছে ২ দিন। এটা কোনো মজার জায়গা না। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সমুদ্রপথের মধ্যে এটি অন্যতম। আমরা কিছুটা নির্ভয়ে থাকতে পারি সিলভারসির অভিজ্ঞ নাবিকদের কারণে। বছরের পর বছর ধরে তারা এই পথে যাত্রা করেন। তবে প্রকৃতি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা চিন্তা করলে পুরোপুরি নির্ভয়ে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব হয় না।

ছবি: রেজাউল বাহারের সৌজন্যে

যাত্রাপথে জাহাজে আমরা কাটিয়েছি ৩ রাত। তার মধ্যে একটি রাত ছিল ড্রেক প্যাসেজ অতিক্রম করার সময়। নিদ্রাহীন সেই রাতটি ভোলার মতো না। সেই সময়টুকুতে চারপাশে কেবল নীল সমুদ্র ছাড়া আর কিছুই দেখিনি।

তারপর একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে স্লিপিং স্যুট আর ব্যালকনির মাঝের পর্দা খুলে নিজের চোখকে আর বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

আমরা এসে গেছি!

চোখের সামনে কুয়াশায় ঢাকা সাদা রহস্যময় বরফের মাঝ দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে আমাদের জাহাজ।

ছবি: রেজাউল বাহারের সৌজন্যে

আমরা ৮ দিন অ্যান্টার্কটিকা উপদ্বীপে ঘুরে বেড়ালাম। দক্ষিণ শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ, এলিফ্যান্ট আইল্যান্ড এবং বন্যপ্রাণী সমৃদ্ধ ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ দেখেছি। ২ বার অ্যান্টার্কটিক সাউন্ড অতিক্রম করেছি। আমরা বেশ কয়েকটি উপকূল ঘুরেছি, কায়াকিং করেছি। আর যেটা না বললেই নয় সেটা হলো, প্রচুর ছবি তুলেছি। কিন্তু এই জায়গায় এতকিছু আছে যে তার একটি ভগ্নাংশও কেউ ছবিতে ধারণ করতে পারবে না।

আপনি কি জানেন, কিছু বড় হিমশৈলের নিজস্ব নাম রয়েছে? অ্যান্টার্কটিক উপদ্বীপে ভাসমান বৃহত্তম হিমশৈলটি সিঙ্গাপুরের চেয়ে ৫ গুণেরও বেশি বড়।

ছবি: রেজাউল বাহারের সৌজন্যে

সিদ্ধান্ত নিলাম পানিতে নামব। এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াটা মোটেই সহজ ছিল না। মায়ের কথা ভাবলাম। কয়েক মাস আগেই তাকে আমি হারিয়েছি। সে ছিল আমার শেষ আশ্রয়। সন্তানদের মঙ্গলের জন্য তিনি তার পুরোটা জীবন কষ্ট করেছেন। সিদ্ধান্ত নিলাম, মায়ের জন্যই আমি কাজটি করব।

তারপর লাফ দিলাম। আমি জানি, মা আমার পাগলামি দেখে হাসছেন।

এটা ঠিক যে আমরা অ্যান্টার্কটিকায় গিয়েছি, নির্জন সাদা মহাদেশটিতে ঘুরেছি, বরফ, হিমবাহ, হিমশৈল ও অন্যান্য এমন কিছু প্রাণী দেখেছি যা অন্য কোথাও দেখতে পাইনি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা কেবল অ্যান্টার্কটিকার কেবল ছোট্ট একটি অংশ দেখেছি। বিশাল এই মহাদেশটি আমাদের নাগালের বাইরে।

ছবি: রেজাউল বাহারের সৌজন্যে

অ্যান্টার্কটিকায় ভ্রমণ ছিল আমার জীবন বদলে দেওয়া এক অভিজ্ঞতা। এ যেন স্বপ্ন। আমি জানি আমি সেখানে গিয়েছিলাম, কিন্তু কোথায় ছিলাম তা ঠিক প্রকাশ করতে পারব না।

এখানেই শেষ নয়। আমরা আমাদের গল্প তৈরি করতে চাই। আমরা পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার আগে পুরো পৃথিবী দেখতে চাই।

খরচ

সাধারণত আর্জেন্টিনা ও চিলি থেকে এই সফর শুরু হয়। অ্যান্টার্কটিকা ক্রুজে গড়ে জনপ্রতি খরচ প্রায় ৮ হাজার ডলার। সবচেয়ে কম বাজেটের ভ্রমণেও খরচ হবে প্রায় ৫ হাজার ডলার। তবে এই প্যাকেজগুলো সাধারণত যাত্রার কয়েক মাস এমনকি প্রায় এক বছর আগেও বুক করা হয়। বিলাসবহুল ভ্রমণ করতে চাইলে আপনাকে খরচ করতে হবে ১৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার ডলার। খরচের বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভর করে আপনি কী কী নিচ্ছেন এবং কোন ধরনের সেবা নিচ্ছেন তার উপর।

ছবি: রেজাউল বাহারের সৌজন্যে

শারমিন ও রেজাউল বাহার সম্পর্কে

২০০৫ সালে বিয়ে করেন শারমিন শাহারিয়াথ ও রেজাউল বাহার। ভ্রমণ পিপাসু এই দম্পতি যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাটে বসবাস করেন। শারমিন স্ট্যানলি ব্ল্যাক অ্যান্ড ডেকার ইনকর্পোরেটেডে সিনিয়র প্রজেক্ট ম্যানেজার এবং বাহার মার্কিন কোস্টগার্ড একাডেমিতে ফ্যাসালিটিজ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত।

Comments