২৫ কোটি ডলারের ‘কারেন্সি সোয়াপ’ ঋণ নিয়ে শ্রীলঙ্কার পাশে বাংলাদেশ

বৈদেশিক ঋণের চাপে জর্জরিত শ্রীলঙ্কাকে এই বছরের মধ্যে ৩৪০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক ঋণ শোধ করতে হবে। মার্চে শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্ট  মাহিন্দ রাজাপাকসের অনুরোধে চরম সংকটে থাকা দেশটিকে ২৫ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। এক ধরনের মুদ্রা বিনিময় প্রথা বা কারেন্সি সোয়াপের নিয়ম মেনে এই ধার দেওয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

বৈদেশিক ঋণের চাপে জর্জরিত শ্রীলঙ্কাকে এই বছরের মধ্যে ৩৪০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক ঋণ শোধ করতে হবে। মার্চে শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্ট  মাহিন্দ রাজাপাকসের অনুরোধে চরম সংকটে থাকা দেশটিকে ২৫ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। এক ধরনের মুদ্রা বিনিময় প্রথা বা কারেন্সি সোয়াপের নিয়ম মেনে এই ধার দেওয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

গত ১৮ আগস্ট বাংলাদেশ প্রথম কিস্তিতে শ্রীলঙ্কাকে ৫ কোটি ডলার দিয়েছে এবং দ্বিতীয় কিস্তিতে আরও ১০ কোটি ডলার পাঠিয়েছে গত ৩০ আগস্ট।

শ্রীলঙ্কার জন্য এই ঋণটি খুবই জরুরি। পর্যটন শিল্প এবং গার্মেন্টস ব্যবসার উপর নির্ভরশীল দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ এখন তলানিতে। ২০২১ এর এপ্রিলের শেষে শ্রীলঙ্কার মজুদ ছিল ৪০০ কোটি ডলার, যা করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবে ক্রমশ কমতে থাকে।

উপরন্তু চলতি বছরের জুলাইয়ে দেশটি ১০০ কোটি ডলারের একটি ঋণ পরিশোধ করলে এর বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমে দাঁড়ায় মাত্র ২৪০ কোটি ডলারে।

সাধারণত কমপক্ষে ৩ মাসের আমদানি বিল পরিশোধ করার সক্ষমতা থাকলে কোনো দেশের অর্থনীতি অপেক্ষাকৃতভাবে ঝুঁকিমুক্ত থাকে। অথচ এখন শ্রীলঙ্কার হাতে আছে মাত্র ১ দশমিক ৮ মাসের আমদানি বিলের সমপরিমাণ রিজার্ভ।

পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয় যখন গত ১৪ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার এই অসম্ভব চাপ সামলাতে না পেরে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ওয়েলিগামাগে ডন লাক্সমান পদত্যাগ করেন।

তাই শ্রীলঙ্কা এখন ঋণের এই বিশাল বোঝা সামাল দিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যার অংশ হিসেবে শ্রীলঙ্কান প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে গত মার্চ মাসে তার বাংলাদেশ সফরের সময় শেখ হাসিনা সরকারের কাছে কারেন্সি সোয়াপ পদ্ধতির মাধ্যমে ঋণ সহায়তা চান।

বাংলাদেশ কিছু শর্ত সাপেক্ষে এই ঋণ দিতে রাজি হয়

প্রথম শর্ত ছিল এই ঋণের পরিমাণ একবারে ২০ কোটি ডলারের বেশি হতে পারবে না। এখন পর্যন্ত যেহেতু শ্রীলঙ্কা ১৫ কোটি ডলার পেয়ে গেছে তাই ঋণের বাকি ১০ কোটি ডলার একসাথে নিতে হলে দেশটিকে কমপক্ষে ৫ কোটি ডলার শোধ করে দিতে হবে অথবা বাংলাদেশ চাইলে আরও ৫ কোটি ডলার পাঠাতে পারবে।

প্রথম কিস্তি পরিশোধ করার জন্য শ্রীলঙ্কা তিন মাস সময় পাবে এবং এসময় সুদের হার হবে LIBOR+ ২ শতাংশ। LIBOR বা London Interbank Offered Rate হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বল্পমেয়াদে ঋণ দেয়ার জন্য প্রচলিত সুদের হার।

প্রথম তিন মাসে ঋণ শোধ করতে না পারলে শ্রীলঙ্কাকে আরও তিন মাস সময় দেয়া হবে। দ্বিতীয়বারের তিন মাসেও সুদের হার সমান থাকবে। তবে ছয় মাস এক দিন পর থেকে পরের তিন মাসে সুদের হার হবে LIBOR+ ২.৫ শতাংশ।

বর্তমানে ৩ মাস মেয়াদি LIBOR সুদ হার হচ্ছে ০ দশমিক ১২ শতাংশ আর ছয় মাস মেয়াদি LIBOR সুদ হার হচ্ছে ০ দশমিক ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশ এই ঋণ থেকে ২ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশের মতো সুদ পাবে, যা অন্যান্য যে কোনো বিনিয়োগ থেকে বাংলাদেশ যা লাভ করে তার প্রায় দ্বিগুণ।

শ্রীলঙ্কার এই দুরবস্থার কারণ

দেশটির অর্থনীতির দিকে তাকালে দেখা যায় প্রায় আড়াই দশকের গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত শ্রীলঙ্কা তার অর্থনীতিকে দাঁড় করানোর জন্য বৈদেশিক ঋণের উপর নির্ভর করে এবং এই নির্ভরশীলতা দিন দিন বাড়তেই থাকে।

১৯৯৭ সালে বিশ্বব্যাংক যখন শ্রীলঙ্কাকে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় তখন নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে শ্রীলঙ্কা যেসব বৈদেশিক ঋণ পেত তা বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে দেশটিকে ঋণের জন্য নতুন মাধ্যম খোঁজা শুরু করতে হয়।

২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে ঋণ নেয়ার জন্য দেশটি প্রথমবারের মতো ৫০ কোটি ডলার সমমূল্যের সভ্রেইন বন্ড ছাড়ে এবং আস্তে আস্তে এই বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নেয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে।

এই বন্ডের শর্তগুলো বেশ কঠিন। এই ঋণ শোধ করার জন্য সময় দেয়া হয় ৫ থেকে ১০ বছর, সুদের হার ৬ শতাংশের ওপরে এবং সময়সীমা পার হয়ে গেলে বিনা জরিমানায় ঋণ পরিশোধ করার জন্য এখানে কোনো অতিরিক্ত সময়ও দেয়া হয় না।

সবচেয়ে কঠিন শর্ত হলো এই বন্ডের মূল বা আসল টাকা বন্ডের মেয়াদপূর্তির সময় একবারে পরিশোধ করতে হয়। অন্যান্য বন্ডের মতো কয়েক বছর মিলিয়ে শোধ করার সু্যোগ নেই। তাই বন্ডের মেয়াদপূর্তির সময় ঋণগ্রহীতা দেশের উপর বড় ধাক্কা আসে, যা শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে হয়েছে।

২০২০ এর শেষে এসে দেখা যায় শ্রীলঙ্কার মোট বৈদেশিক ঋণের অর্ধেকই এসেছে সভ্রেইন বন্ডের মাধ্যমে।

এর আগে মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে কিছুটা উন্নতি করায় ২০১৯ সালের জুলাইতে বিশ্বব্যাংক শ্রীলঙ্কাকে উচ্চ মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করে। কিন্তু এর ঠিক পরের বছরের জুলাইয়ে বিশ্বব্যাংক মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশকে রেটিং করার জন্য একটি নতুন মানদন্ড ঠিক করে, যেখানে শ্রীলঙ্কা পুনরায় নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে নেমে আসে।

শ্রীলঙ্কার জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে যায় যখন মাত্রাতিরিক্ত ঋণের কারণে আন্তর্জাতিক সভ্রেইন রেটিংয়ে দেশটি আরও নিচে নেমে যায়, যার ফলে দেশটির আন্তর্জাতিক বাজার থেকে নতুন করে ঋণ নেয়ার সক্ষমতা কমে যায়।

২০২০ সালে ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ফিচ শ্রীলঙ্কাকে ট্রিপল সি রেটিং দেয়, যার মানে হচ্ছে আমেরিকান প্রতিষ্ঠানটির মতে নতুন ঋণ নিলে শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে তা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

করোনাভাইরাসের আক্রমণের পর লকডাউনের সময় ২০২০ সালে শ্রীলঙ্কার ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন বা ৪৫০ কোটি ডলারের পর্যটন শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং এর প্রভাব দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির উপরও পড়ে এবং দেশটির রপ্তানি কমে যায় ১৭ শতাংশ।

২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার ৮৮ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ২০১৯ সালে এসে কমে ৮৩ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন স্পর্শ করে এবং ২০২০ সালে আরও কমে ৮০ দশমিক ৭ বিলিয়নে নেমে আসে।

বৈদেশিক মূদ্রার সংকট এত বেশি তীব্র হয়ে যায় যে শ্রীলঙ্কান সরকার ২০২০ সালের মার্চে আমদানির উপর অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

শ্রীলঙ্কা কীভাবে বাংলাদেশ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করবে

বাংলাদেশ ডলার পাঠাবে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে যেখানে দ্বীপ রাষ্ট্রটি আগে থেকেই ২৫ কোটি ডলারের সমপরিমাণ প্রায় ৪৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন শ্রীলঙ্কান রুপি জামানত হিসেবে জমা করে রাখবে।

পরবর্তীতে শ্রীলঙ্কা ওই অ্যাকাউন্টে মার্কিন ডলার জমা দিয়ে ক্রমান্বয়ে তাদের ঋণ পরিশোধ করবে। আর পরিশোধ করতে না পারলে বাংলাদেশ প্রতিবছর ৫ থেকে ৫ দশমিক ৫ কোটি ডলার মূল্যের যে পণ্য শ্রীলঙ্কা থেকে আমদানি করে তার মূল্য পরিশোধ করা হবে ওই অ্যাকাউন্টে জমা থাকা শ্রীলঙ্কান মুদ্রা দিয়ে।

উল্লেখ্য গত বছর শ্রীলঙ্কান রুপির দাম মার্কিন ডলারের বিপরীতে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ কমে গেছে। এই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর ১ মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ১৯৯ দশমিক ৯৯ শ্রীলঙ্কান রুপি।

Comments

The Daily Star  | English
wage workers cost-of-living crisis

The cost-of-living crisis prolongs for wage workers

The cost-of-living crisis in Bangladesh appears to have caused more trouble for daily workers as their wage growth has been lower than the inflation rate for more than two years.

1h ago