বিশ্ববাজারে জামদানির বাণিজ্যিক সুবিধা করতে পারেনি বাংলাদেশ
দেশের প্রথম ভৌগলিক নির্দেশক বা জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) পণ্য হিসেবে ২০১৬ সালে স্বীকৃতি পায় জামদানি। জিআই সনদ পাওয়ার প্রায় ছয় বছর হয়ে গেলেও বিশ্ববাজারে সুবিধা করতে পারেনি বাংলাদেশ।
জিআই স্বীকৃতির পর জামদানি নিয়ে বাণিজ্যিক পরিকল্পনা এবং তাঁতিদের প্রশিক্ষণ, উৎপাদন ও বিপণনের কোনো গাইডলাইন নিয়ে কাজ করেনি মেধাস্বত্ত্ব পাওয়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)।
জামদানির মেধাসম্পদ স্বত্ব (আইপি) পেতে জিআই-এর জন্য ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর পেটেন্টস, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরে (ডিপিডিটি) আবেদন করে বিসিক। এরপর ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর বিসিক জামদানির জিআই স্বীকৃতি লাভ করে।
ওয়ার্ল্ড ইনটেলেকটুয়াল প্রপারটি অর্গানাইজেশন (ডাব্লিউআইপিও) নিয়ম অনুযায়ী, ডিপিডিটি ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন ২০১৩ অনুসারে এই সনদ দেওয়া হয়।
স্বাভাবিকভাবেই এরপর তাঁতিদের জন্য বাণিজ্যিক পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ, উৎপাদন ও বিপণনের জন্য একটি কাঠামো তৈরি প্রত্যাশিত ছিল বিসিকের কাছে।
তবে, আজ পর্যন্ত এই নিয়ে তাদের কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। সংস্থাটির একমাত্র দৃশ্যমান কাজ ছিল আন্তর্জাতিকভাবে সংগঠিত দুটি মেলায় তাঁতিদের অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করা।
কিন্তু, এটি খুব বেশি কাজে আসেনি। কারণ বিসিকের কাছে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে কোনো তথ্য নেই। যেমন- এ পর্যন্ত বিক্রি হওয়া জামদানির সংখ্যা, যেসব দেশে রপ্তানি করা হয়েছিল সেখানে ক্রেতাদের চাহিদা, তারা অন্যদের কাছে এর সুপারিশ করবে কিনা ইত্যাদি।
তবে, জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর ৬৬ জন তাঁতিকে জামদানি উৎপাদনের জিআই সনদ দিয়েছে বিসিক। কিন্তু, এই সনদের কাজ কী কিংবা এই সনদে লাভ কী, সে সম্পর্কে কিছুই জানেন তাঁতিরা।
তারা বলছেন, এই সনদ ঘরে টানিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো সুফল পাননি। উৎপাদন ও বিপণনের কোনো গাইডলাইন, প্রশিক্ষণ কিংবা নির্দেশনা তাঁতিদের দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি তাদের কোনো মনিটরিং করা হয়নি বলেও দাবি করেছেন তাঁতিরা।
জিআই নিবন্ধন সনদ পাওয়া এই ৬৬ জন তাঁতির একজন হলেন বিল্লাল হোসেন। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০১৮ সালে জিআই সার্টিফিকেট পাইছি। বলা যায় শুধু কাগজটাই (সার্টিফিকেট) পাইছি। এর বিনিময়ে আর কোনোকিছুই পাই নাই।'
বিল্লাল আরও বলেন, 'এইটা নাকি অনেক মূল্যবান। এত মূল্যবান একটা জিনিস (জিআই সার্টিফিকেট) ঘরের এক কোনো টানানো রয়েছে। আগে যেভাবে জামদানি তৈরি ও বিক্রি করতাম, এখনো সেভাবেই করছি। বাড়তি কোনো সুবিধা নাই।'
দ্য ডেইলি স্টারের এই প্রতিবেদক ৬৬ জন তাঁতির মধ্য থেকে ৫ জন তাঁতির সঙ্গে কথা বলেছেন, তারা প্রত্যেকেই একই ধরনের মন্তব্য করেছেন।
বিসিক সূত্র জানায়, যে ৬৬ জন তাঁতিকে জামদানি তৈরির নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল, এরপর আর তাঁতির সংখ্যা বাড়েনি। কারণ তারপর তাঁতির সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
তবে, বিসিকের বিপণন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক অখিল রঞ্জন তরফদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিশ্ববাজারে ব্রান্ডিংয়ের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন কোনো মেলা হয়, তখন এই পণ্যগুলো পাঠানো হয়। গত প্রায় পাঁচ বছরে কতটি এক্সপো অংশগ্রহণ করেছি, সেটি বলা কঠিন হবে। চায়না, ভারত ও আরেকটি ফেয়ারে অংশ গ্রহণ করা হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'জিআই ট্যাগধারী কত টাকার পণ্য বা কতটি পণ্য বিক্রি করা হয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। জামদানি এখনো জিআইয়ের প্রোপার সুফলটা পায়নি। তবে আমরা সুফল পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছি। মাঝখানে আমাদের লোকবলের সংকট ছিল।'
এ ছাড়া, তাঁতিরা সুবিধা পাননি- বিষয়টি মানতে নারাজ অখিল রঞ্জন তরফদার। তিনি বলেন, 'জিআই ট্যাগ পাওয়ার পর তারা কোনো লাভবান হয়নি, সেটা ঠিক নয়। তবে তাঁতিদের নিয়ে আমরা কাজ করছি।'
এ বিষয়ে ডিপিডিটির রেজিস্ট্রার আবদুস সাত্তার জানান, যেহেতু মেধাসম্পদ স্বত্ব সংরক্ষণের দায়িত্ব পেয়েছে বিসিক, তাই আন্তর্জাতিক বাজারে জামদানি পণ্যের ঐতিহ্য ও সুনাম তুলে ধরে ব্রান্ডিং, বাজারজাত ও বিক্রি বাড়ানোর দায়িত্বও তাদের।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের (বিএফটিআই) এক গবেষণায় বলা হয়, বিশ্বব্যাপী ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের চাহিদা ভালো। বিভিন্ন দেশে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি দাম দিয়ে এসব পণ্য কেনেন ক্রেতারা। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জিআই পণ্য নিবন্ধিত হলে ওই পণ্যকে ঘিরে বিদেশি বিনিয়োগও আসে।
'জিআই সনদের গুরুত্বটাই এখনো আমরা বুঝতে পারিনি'-এমনটা জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'জিআই সনদ পাওয়ার পর ৫ বছর হয়ে গেলো, এরপর আর কোনো অগ্রগতি নেই। এতো বড় একটা বিষয়, নিজেদের উদ্যেগী হয়ে কাজ করতে হবে। কিন্তু, সেই জায়গাটাতে সংশ্লিষ্টরা যথাযথ মনোযোগ দেননি।'
তিনি বলেন, 'বিসিক তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তবে, সময় ফুরিয়ে যায়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে জামদানি পণ্যের বিক্রি বাড়াতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে।'
সাধারণত বাংলাদেশে মান ও ডিজাইন ভেদে জামদানির দাম ৩ হাজার টাকা থেকে শুরু করে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বিসিক জামদানি শিল্পনগরী সূত্রে জানা যায়, তারা বছরে প্রায় ৬০ হাজার পিছ জামদানি পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করে থাকেন। এতে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা আয় হয়। তবে, এই শিল্পনগরীর বাইরেও জামদানি পণ্যে বাজার আছে, যা বছরে ৫-৬ কোটি টাকার মতো বলে জানান এই খাতের ব্যবসায়ীরা।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বিসিক জামদানি শিল্পনগরীতে ২ হাজারের বেশি তাঁতি আছেন। সবমিলিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় পাঁচ হাজারের মতো তাঁতি আছেন।
Comments