বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কায় নতুন ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

করোনাভাইরাস সংক্রমণ হ্রাস, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে ২০২২ সালের শুরুতে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুতগতিতে বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর ফেব্রুয়ারির শেষদিক থেকে পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কায় নতুন ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

করোনাভাইরাস সংক্রমণ হ্রাস, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে ২০২২ সালের শুরুতে বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুতগতিতে বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর ফেব্রুয়ারির শেষদিক থেকে পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে।

রাশিয়া বা ইউক্রেন কেউই বাংলাদেশের জন্য বড় কোনো রপ্তানি গন্তব্য বা আমদানির সোর্সিং দেশ নয়। তবে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য যে দেশগুলোর ওপর নির্ভর করে, সেসব দেশের জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ।   

মর্গ্যান স্ট্যানলির অর্থনীতিবিদদের মতে, ৪০ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকায় এবং মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভোক্তাদের চাহিদা ও দাম কমানোর জন্য ক্রমবর্ধমানভাবে আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করায় বিশ্বব্যাপী মন্দার ঝুঁকি বাড়ছে।

'আমরা কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বিশৃঙ্খল এবং ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন, এমন একটি সময়ে অবস্থান করছি। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মন্দার উপাদানগুলো একেবারেই স্পষ্ট', বলেন মর্গ্যান স্ট্যানলির অর্থনীতিবিদরা।

সংকোচনমূলক আর্থিক নীতির কারণে আগামী ২ বছরে মন্দার পূর্বাভাস দিয়েছে ব্যাংক অফ আমেরিকা এবং ডয়েচে ব্যাংকসহ ওয়াল স্ট্রিট সংস্থাগুলো।

'এই মুহূর্তে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে মন্দার আশঙ্কা তীব্র ও ক্রমবর্ধমান', লিখেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও জননীতির অধ্যাপক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কেনেথ রোগফ।

২০০৭ ও ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের সময় এবং এমনকি মহামারিতেও বাংলাদেশ মন্দার মুখোমুখি হয়নি। কিন্তু বর্তমানে দেশের অর্থনীতি বিভিন্ন কারণে চাপের মধ্যে পড়েছে।

জুলাই থেকে মার্চের মধ্যে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি সর্বকালের সর্বোচ্চ ২৪ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে আমদানি পরিশোধ বছরে ৪৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে।

১১ মে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। উচ্চতর আমদানি অর্থপ্রদান এখন রিজার্ভ আরও কমিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করছে। রেমিট্যান্স চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

এ বছর বাংলাদেশ ব্যাংক ৪ বার মার্কিন ডলারের বিপরীতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করলেও টাকার বিনিময় হার অস্থিতিশীল। মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৬ দশমিক ২২ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ১৭ মাসে সর্বোচ্চ।

একমাত্র উৎসাহব্যঞ্জক অর্থনৈতিক সূচক হল রপ্তানি আয়। এটি এখন পর্যন্ত দুর্দান্ত। জুলাই থেকে এপ্রিলের মধ্যে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩৫ দশমিক ১৪ শতাংশ।

সরকারও এ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। বুধবার সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ করার সিদ্ধান্ত এবং কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠে।    

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন, পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২২ সালের শেষের দিকে মন্দা হবে এবং জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

'যেহেতু বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার ইউরোপের ওপর অতি নির্ভরশীল, ফলে ইউরোপে মন্দা দেখা দিলে দেশের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে', যোগ করেন তিনি।

পশ্চিম ইউরোপে স্বল্প দক্ষ শ্রমের চাহিদা বেড়েছে এবং অনেক বাংলাদেশি সেই সুযোগ ব্যবহার করছেন। এ বিষয়টিও প্রভাবিত হতে পারে।

জেনেভায় আন্তর্জাতিক শ্রম অফিসের কর্মসংস্থান খাতের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, 'বিশ্বব্যাপী আরেকটি মন্দা আঘাত হানুক বা না হানুক, মার্কিন প্রবৃদ্ধি ইতোমধ্যেই থমকে গেছে। চীনও চাপের মুখে আছে কোভিডের কারণে। ইউরোপে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কার্যত শূন্য। তাই, বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান ইঞ্জিন যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই।'

যুক্তরাষ্ট্রে জানুয়ারি-মার্চ ত্রৈমাসিকে মোট দেশীয় আয় অপ্রত্যাশিতভাবে ১ দশমিক ৪ শতাংশ বার্ষিক গতিতে হ্রাস পেয়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিসটিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মন্দার আশঙ্কা বাড়ছে।

'যদি আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হয়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রভাবিত হবে', মত দেন তিনি।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান মনে করেন, আমদানিভিত্তিক পণ্যের উচ্চমূল্য এবং রপ্তানি পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রভাবিত হবে।

প্রথমত, দেশে পণ্যের মূল্য বাড়তে পারে এবং দ্বিতীয়ত, রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে।

ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, 'যেহেতু বাংলাদেশ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কম দামি তৈরি পোশাক রপ্তানি করে এবং এগুলো মৌলিক চাহিদারই অংশ, তাই রপ্তানি খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নাও হতে পারে। তবুও আগামী বাজেটে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।'

তিনি অবশ্য উল্লেখ করেছেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কাঁচামালের দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রপ্তানি আয় বেড়েছে।

'সুতরাং, যদি আপনি পরিমাণ এবং মান-সংযোজন বিশ্লেষণ করেন, তবে রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে খুব সন্তুষ্ট হওয়ার মতো কিছু নেই', বলেন তিনি।

সিপিডির মুস্তাফিজুর রহমান বিনিময় হার যুক্তিযুক্ত করা এবং সরকারি ব্যয়ে কার্যকারিতা আনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। জাহিদ হোসেন একটি ভাসমান বিনিময় হারের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি এবং রপ্তানিকে উৎসাহিত করার সুপারিশ করেন।

রিজওয়ানুল ইসলাম যোগ করেন, 'আমাদের আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকতে হবে।'

অধ্যাপক রায়হান সব সাপ্লাই চেইনের ত্রুটি দূর করার আহ্বান জানান, যাতে কেউ অনৈতিকভাবে লাভ করতে না পারে।

Comments