খসড়া ই-কমার্স নীতিমালা: কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কঠোর নজরদারি

দেশের প্রতিটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে শিগগির একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের আওতায় নিয়ে আসা হবে। সেই প্ল্যাটফর্মের নিরীক্ষণ করবে একাধিক রাষ্ট্রীয় সংস্থা। সম্প্রতি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে অনিয়মের ঘটনা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার এই খাতের ওপর নজরদারি বাড়াতে এই উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রতীকী ছবি | স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

দেশের প্রতিটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে শিগগির একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের আওতায় নিয়ে আসা হবে। সেই প্ল্যাটফর্মের নিরীক্ষণ করবে একাধিক রাষ্ট্রীয় সংস্থা। সম্প্রতি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে অনিয়মের ঘটনা আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার এই খাতের ওপর নজরদারি বাড়াতে এই উদ্যোগ নিয়েছে।

অন্তত ১৩টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কয়েক হাজার কোটি টাকার দেনায় পড়ে যাওয়ায় একটি কঠোর ই-কমার্স নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়।

খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, নিরীক্ষণ করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি), কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থা এবং ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)।

গত মাসে এনটিএমসির তৈরি খসড়া নীতিমালার একটি অনুলিপি সংগ্রহ করেছে দ্য ডেইলি স্টার।

এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অর্ডার ও ডেলিভারি সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য থাকবে। এ ছাড়াও এর মাধ্যমে ডিলারদের ব্যাপারে তথ্য এবং তাদের আর্থিক লেনদেনের বিস্তারিত জানা যাবে।

এই নীতিমালার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একটি অ্যাপ্লিকেশান প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (এপিআই), যার মাধ্যমে এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এবং পেমেন্ট গেটওয়ে উভয়ই সংযুক্ত থাকবে। এপিআই হচ্ছে এক ধরণের মধ্যস্থতাকারী প্রযুক্তি, যেটি দুটি ভিন্ন ধরণের প্ল্যাটফর্মকে একে অপরের সঙ্গে তথ্য আদান প্রদানের সুবিধা তৈরি করে দেয়।

বেশিরভাগ ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে তাদের গ্রাহক ও ডিলারদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করে থাকেন। নীতিমালার ভাষ্য অনুযায়ী, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিংবা পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে দ্রুত তথ্য বের করতে হলে উভয় প্ল্যাটফর্মে এপিআই সুবিধা থাকতে হবে।

নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, এই সুবিধা থাকলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের নিরীক্ষণ সহজ হবে।

ব্যবসা চালিয়ে যেতে প্রতিটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক।

নিবন্ধনের সময় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের ব্যবসায়িক মডেল সম্পর্কে তথ্য প্রদান করতে হবে।

খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, 'ব্যবসায়িক মডেল বলতে আমরা বোঝাতে চাইছি, কীভাবে একটি প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করবে, কীভাবে তারা ভোক্তার কাছ থেকে অর্থ আয় করবে, কীভাবে পণ্য সরবরাহ করবে এবং কীভাবে আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন হবে, ইত্যাদি।'

নিবন্ধনের আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যাচাই করবে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি কোনো ধরনের পঞ্জি স্কিম, মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কিংবা অন্য কোনো অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে কি না।

এতে আরও বলা হয়েছে, এনটিএমসি আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্যও যাচাই করবে।

একইসঙ্গে বিএফআইইউ প্রস্তাবিত প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও আর্থিক লেনদেনের বিস্তারিত যাচাই করবে বলে খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা তদন্ত করে দেখবে কোনো ধরণের অপরাধমূলক কার্যক্রম চলছে কি না।

এসব তথ্য বিসিসির সার্ভারে সংরক্ষিত থাকবে এবং উল্লিখিত এপিআইর কল্যাণে ৬টি সংস্থা যেকোনো সময় এই তথ্য জানতে পারবে।

সার্ভারে অর্ডার সম্পন্ন হওয়া, কুরিয়ার সেবার ব্যবস্থাপনা, লেবেল দেওয়া, অর্ডারের ইনভয়েস তৈরি করা, অর্ডার নিশ্চিত করা ও ট্র্যাক করা এবং সকল আর্থিক লেনদেনের তথ্য থাকবে।

এনটিএমসির পরিচালক জিয়াউল আহসান দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, সরকারের এ ধরণের সুনির্দিষ্ট তথ্য জানার উপায় থাকলেও এর মানে এই না যে তারা সারাক্ষণ এই তথ্য দেখবেন।

তিনি বলেন, 'উদাহরণস্বরূপ, আমরা চাইলে সব কল নিরীক্ষা করতে পারি। কিন্তু তার মানে এই না, যে আমরা তা করতে চাই।' তিনি আরও যোগ করেন, এটি শুধুমাত্র অবৈধ কার্যক্রম খুঁজে বের করার জন্য প্রয়োজনীয় একটি উদ্যোগ।

নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি সংস্থা কী কী তথ্য দেখতে পাবে, সেটি সেই সংস্থার কাজের ধরণ অনুযায়ী নির্ধারণ করা হবে।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, 'কে কতটুকু দেখতে পাবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের হাতে ইউজার অ্যাক্সেস অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে।'

উদাহরণস্বরূপ, বিএফআইইউ নিয়মিত নিরীক্ষণের জন্য এপিআই ব্যবহার করে আর্থিক লেনদেনের তথ্য বের করতে পারবে। তারা আগের সব লেনদেনের বিস্তারিত তথ্যও দেখতে পারবে।

অপরদিকে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো জাতীয় পরিচয় তথ্য, পাসপোর্টের তথ্য এবং কোনো ধরণের অপরাধ সংক্রান্ত তথ্য দেখতে পাবে। এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সব শর্ত ও নিয়ম মেনে চলছে কি না, সেটাও চাইলে যাচাই করতে পারবে।

তারা এটাও দেখতে পারবে যে, ভোক্তারা সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে তাদের অর্ডার করা পণ্য বুঝে পাচ্ছেন কি না।

যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এই নিয়মগুলো মেনে চলবে, শুধুমাত্র তাদেরকেই নিবন্ধিত করা হবে। সব প্রতিষ্ঠানকে একটি বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (বিআইএন) দেওয়া হবে।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অথবা পেমেন্ট সিস্টেম সেবাদাতার মতো বেসরকারি অংশীজনদের সঙ্গে এখনও খসড়া নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করা হয়নি বলে জানান জিয়াউল আহসান।

প্রতিষ্ঠানগুলোও এই প্ল্যাটফর্ম থেকে উপকৃত হবে। তিনি জানান, প্রতিষ্ঠানগুলো জানতে পারবে কোন পণ্যগুলো বেশি বিক্রি হচ্ছে এবং তারা সে অনুযায়ী ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

তবে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের তথ্যের গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সহসভাপতি মো. সাহাব উদ্দিন বলেন, 'সরকারকে এটা নিশ্চিত করতে আহ্বান জানাচ্ছি যে, ভোক্তাদের ডেটা যেন সবার কাছে উন্মুক্ত হয়ে না যায়। সরকারের হাতে ডেটা যাওয়ার মাধ্যমেও সবার কাছে এই তথ্য উন্মুক্ত হয়ে যেতে পারে।'

এ বছরের জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া নীতিমালা অনুযায়ী বর্তমানে ই-কমার্স খাত পরিচালিত হচ্ছে।

এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন মাহমুদুল হাসান

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
books on Bangladesh Liberation War

The war that we need to know so much more about

Our Liberation War is something we are proud to talk about, read about, and reminisce about but have not done much research on.

15h ago