আর্থিকখাতের ‘পারমাণবিক বোমা’ সুইফট থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব?

ইউক্রেন হামলার প্রাক্কালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্বকে আবার স্মরণ করে দিয়ে বলেছেন, মস্কো পারমাণবিক বোমার অধিকারী। এর পাল্টা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপ বলছে তাদের হাতেও রয়েছে অন্য এক ধরনের পারমাণবিক বোমা। এটি রাশিয়ার আর্থিকখাতকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেবে। ইউক্রেনে বর্বরোচিত হামলার পাল্টা হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে এই বোমা।

ইউক্রেন হামলার প্রাক্কালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্বকে আবার স্মরণ করে দিয়ে বলেছেন, মস্কো পারমাণবিক বোমার অধিকারী। এর পাল্টা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপ বলছে তাদের হাতেও রয়েছে অন্য এক ধরনের পারমাণবিক বোমা। এটি রাশিয়ার আর্থিকখাতকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেবে। ইউক্রেনে বর্বরোচিত হামলার পাল্টা হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে এই বোমা।

জাপানের হিরোশিমা বা নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ফলাফল সবার জানা আছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঘোষিত নতুন এই পারমাণবিক বোমা আক্ষরিক অর্থে কোনো মানুষ বা অন্যকিছুকে তাৎক্ষণিকভাবে জ্বালিয়ে দেবে না। তবে, একটি দেশের অর্থনীতিকে গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি এখন এই বোমার দিকে, যার নাম সুইফট।

পারমাণবিক বোমার প্রভাব শুধুমাত্র একটি অঞ্চলের ওপর পড়ে না। পৃথিবীর জীব-বৈচিত্র্যের ওপর নিয়ে আসে নেতিবাচক প্রভাব। তেমনি সুইফট নামক বোমার গভীরতার দিকে তাকালে বোঝা যায়, সত্যিকার অর্থে এটিও একটি পারমাণবিক বোমা। এর বিস্ফোরণ রাশিয়ার বিরুদ্ধে হলেও পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে বিশ্ব অর্থনীতি।

সুইফট কীভাবে পারমাণবিক বোমায় রূপান্তরিত হলো এটি বুঝতে হলে পেছনে ইতিহাসের বাঁক বোঝাটা জরুরি। 

সুইফট-এর সম্প্রসারিত নাম হচ্ছে ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন্স, যা ১৯৭৩ সালে গড়ে উঠে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ব্যাংকগুলো প্লাটফর্মটি গড়ে তুলেছে।

বেলজিয়ামভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত আছে বিভিন্ন দেশের ১১ হাজারের বেশি ব্যাংক ও আর্থিকপ্রতিষ্ঠান। ন্যাশনাল ব্যাংক অব বেলজিয়াম এর তদারকি করে।

এটি কোনো পেমেন্ট সিস্টেম নয়। মূলত এটি মেসেজিং প্লাটফর্ম। ব্যবসায়ীদের হয়ে আমদানি-রপ্তানি করার সময় পণ্যের বিস্তারিত বিবরণ ও এর মূল্য সুইফটের মাধ্যমে দেওয়া-নেওয়া করে ব্যাংকগুলো। এর ভিত্তিতে নিজেদের মধ্যে পণ্যের দাম মেটায় ব্যাংকগুলো। মূলত প্রত্যেক ব্যাংকের একাধিক অ্যাকাউন্ট থাকে বিদেশে অবস্থিত অন্য ব্যাংকগুলোতে। সুইফট-এর মাধ্যমে পাঠানো তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ওইসব অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি মূল্য নিষ্পত্তি করা হয়। 

শুধুমাত্র ব্যাংক নয়, বিভিন্ন দেশের সরকারও নিজেদের মধ্যে লেনদেন করে থাকে সুইফট চ্যানেল ব্যবহার করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এসব সরকারি লেনদেন হয়ে থাকে। সুইফট চ্যানেল ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক প্রতিদিন গড়ে চার কোটির উপর মেসেজ আদান-প্রদান করে।    

একটি ব্যাংক নিজের মধ্যেও মেসেজ আদান-প্রদান করে এই প্লাটফর্মের মাধ্যমে। সুইফট বিশ্বে জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে- এর সিকিউরিটি সিস্টেমের শক্তিশালী নিরাপত্তা বেষ্টনী।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে সুইফটের কি কোনো বিকল্প আছে? ইতিমধ্যে ইমেইল, টেলিফোন বা মোবাইল ফোনকে কেন্দ্র করে অনেক মেসেজিং প্লাটফর্ম গড়ে উঠেছে। কিন্তু, দ্রুত, নিরাপদ, বিশাল নেটওয়ার্ক ও সাশ্রয়ী মূল্য আমলে নিলে সুইফট-এর বিকল্প এখনও গড়ে উঠেনি।

ফলে সুইফট থেকে যদি কোনো দেশকে বের করে দেওয়া হয়, তাহলে দেশটির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ভয়াবহ সঙ্কটের মুখোমুখি হতে বাধ্য। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে ইরান। পারমাণবিক কর্মসূচি অব্যাহত রাখার কারণে ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ইরানের একাধিক ব্যাংককে সুইফট প্লাটফর্ম থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এর ফলে দেশটির তেল থেকে আয় অর্ধেকের বেশি কমে গিয়েছিল। সঙ্কুচিত হয়েছিল দেশটির মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের অন্তত ৩০ শতাংশ।

খেয়াল রাখতে হবে, রাশিয়া কিন্তু ইরান নয়। কারণ, বৈশ্বিক বাণিজ্যে রাশিয়ার অংশগ্রহণ অনেক বিস্তৃত। সুইফট-এ রাশিয়ার অংশগ্রহণও ব্যাপক। দেশটির ২৯১টি আর্থিকপ্রতিষ্ঠান সুইফট-এর গড় লেনদেনের ১ দশমিক ৫ শতাংশ সম্পন্ন করে থাকে। সুইফট ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়ার অবস্থান ষষ্ঠ। দেশটি বছরে ৮০০ বিলিয়ন ডলারের লেনদেন সুইফটের মাধ্যমে করে থাকে। ২০২০ সালের হিসাবমতে, রাশিয়ার জিডিপির অবয়ব ছিল ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার।

রাশিয়া দুনিয়ার ১১তম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশ। বিশ্বের জ্বালানি তেলের ১০ শতাংশ সেখানে উৎপাদিত হয়। একইসঙ্গে ইউরোপের মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ গ্যাস ওই দেশ থেকে সরবরাহ হয়। শস্য ও সার রপ্তানিতে বিশ্বে এক নাম্বার। কয়লা ও স্টিল রপ্তানিতে বিশ্বে তৃতীয় এবং কাঠ রপ্তানিতে পঞ্চম। আরও বেশকিছু ব্যবসায় দুনিয়াতে শীর্ষস্থানগুলোতে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে রাশিয়া।

ফলে গোটা বিশ্ব রাশিয়ার বিভিন্ন পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। দেশটির ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর নির্ভরতা বুঝার জন্য কিছু পরিসংখ্যানের দিকে নজর দেওয়া যাক। গত ২১ ফ্রেরুয়ারি পূর্ব ইউক্রেনের দুইটি অঞ্চলকে স্বাধীন ঘোষণা করে রাশিয়া। ওই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্মিলিতভাবে রাশিয়া থেকে ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের দাম দিয়ে ৩৫ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেল কিনে। এর পাশাপাশি অ্যালুমিনিয়াম, কয়লা, স্বর্ণসহ অন্যান্য পণ্যও কেনা হয়। এসব পণ্যের মোট দাম হচ্ছে ৭০০ মিলিয়ন ডলার।

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর সুইফট থেকে দেশটিকে বহিষ্কার করার ঘোষণা ইতিমধ্যে এসেছে।

গত শনিবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এই বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে অবস্থান নিয়েছে। পাশাপাশি রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে। এই শাস্তি এখনও কার্যকর হয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ একাধিক দেশ রাশিয়ার আর্থিকখাত ও বিভিন্ন ব্যবসায়ীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এখনও পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না, রাশিয়ার মোট কয়টি ব্যাংক এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে। এর মাধ্যমে রাশিয়ার বড় কোম্পানিগুলোকে ক্ষতির মুখে ফেলাই হচ্ছে মূল উদ্দেশ্য।

এই ধরনের নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়ার কোম্পানিগুলোর জন্য বৈশ্বিক বাণিজ্যে অংশ নেওয়া দুরূহ হয়ে যাবে। বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর দেশটিকে সরাসরি নিজস্ব প্লাটফর্মের মাধ্যমে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এতে দেশটির খরচ হবে অনেক বেশি। ক্রিমিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জের ধরে ২০১৪ সালে রাশিয়াকে সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। ওই হুমকির পর সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা থেকে রক্ষা পেতে রাশিয়া সেই সময় নিজস্ব একটি ন্যাশনাল পেমেন্ট কার্ড সিস্টেম তৈরি করে। এর মাধ্যমে সম্পন্ন করা হতো কার্ডের লেনদেন। কয়েকটি দেশ এই প্লাটফর্ম এখন ব্যবহার করছে। এবার যদি সুইফট থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, তাহলে দেশটি অর্থনীতি কমপক্ষে পাঁচ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে। 

কিন্তু, ক্ষতি কি শুধু রাশিয়ার একাই হবে? বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার রপ্তানি-আমদানির পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলারের বেশি। দুই দেশের বাণিজ্য পড়ে যাবে সঙ্কটের মুখে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের জের ধরে ইতিমধ্যে তেলের দাম বিশ্ববাজারে ২০১৪ সালের পর প্রথমবারের মতো ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়েছে। সুইফট থেকে বহিষ্কৃত হলে বাণজ্যিকভাবে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল দেশগুলো চরম সঙ্কটের মুখে পড়বে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

ইতিমধ্যে জার্মানি আতঙ্কের সুরে বলেছে, রাশিয়া থেকে আমদানি করা গ্যাস ও জ্বালানি তেল যদি ডলারের মাধ্যমে পরিশোধ করা না যায় তাহলে মূল্যস্ফীতি আরও বড় রূপ নিবে।

এর আগে সুইফট নামক এই অস্ত্র ইরানের ওপর প্রয়োগ করার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

অতীতে সুইফটকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করায় এর বিকল্প নেটওয়ার্ক জনপ্রিয় করতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশ চীন বসে নেই। দেশটি ইতিমধ্যে সুইফট-এর মতোই একটি প্লাটফর্ম তৈরি করেছে, যার নাম হচ্ছে সিআইপিএস বা ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম। ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়াকে যদি শেষ পর্যন্ত সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়, তাহলে চীনের এই প্লাটফর্ম ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক লেনদেন সম্পন্ন করবে মস্কো। 

এছাড়া ব্রিকস-এর অন্তর্ভুক্ত পাঁচটি দেশ -- ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা -- সম্মিলিতভাবে আর্থিকখাতে বিকল্প একটি মেসেজিং প্লাটফর্ম ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে।

সুইফট ব্যবহারে রাশিয়ার ওপর সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞা শেষ পর্যন্ত যদি আরোপ হয়, ব্রিকস-এর প্লাটফর্ম তৈরির কাজটি আরও দ্রুতগতিতে এগুবে। এ ধরনের প্লাটফর্ম তৈরির প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে, বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ডলারকে পরিহার করা। পৃথিবীতে এখন অর্ধেকের বেশি পণ্য বিনিময় হয় মার্কিন ডলারের মাধ্যমে।

এসব দেশের এই ধরনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা যদি সফল হয়, তাহলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মার্কিন একাধিপত্য সঙ্কটে পড়তে বাধ্য। ফলে সুইফট নামক পারমাণবিক বোমার আঁচ মার্কিন অর্থনীতিতেও পড়বে।

তবে বৈশ্বিক বাণিজ্যে রাতারাতি যুক্তরাষ্ট্রকে উপড়ে ফেলা কঠিন। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ এখন পর্যন্ত দুনিয়ার ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফেডারেল রিজার্ভে ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা আছে।

Comments

The Daily Star  | English

Pollution claims 2.72 lakh lives in one year

Alarming levels of air pollution, unsafe water, poor sanitation, and exposure to lead caused over 2.72 lakh premature deaths in Bangladesh in 2019.

5h ago