কেন আমাদের আইনি ব্যবস্থায় ব্যক্তি স্বাধীনতাকে এত হেলাফেলা করা হয়?

একটি ফেসবুক পোস্টে হেফাজত-ই-ইসলামের নেতা মামুনুল হকের সমালোচনা করার অপরাধে প্রায় সাত মাস কারাদণ্ড ভোগ করার পর অবশেষে গত মঙ্গলবার জেল থেকে বের হয়ে এসেছেন ঝুমন দাশ। এটি নিঃসন্দেহে খুশি হওয়ার মতো একটি সংবাদ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মামুনুল নিজেই এখন আটক আছেন এবং তার বিরুদ্ধে প্রায় ২৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
jhumon_das_1oct21.jpg
ছবি: সংগৃহীত

একটি ফেসবুক পোস্টে হেফাজত-ই-ইসলামের নেতা মামুনুল হকের সমালোচনা করার অপরাধে প্রায় সাত মাস কারাদণ্ড ভোগ করার পর অবশেষে গত মঙ্গলবার জেল থেকে বের হয়ে এসেছেন ঝুমন দাশ। এটি নিঃসন্দেহে খুশি হওয়ার মতো একটি সংবাদ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মামুনুল নিজেই এখন আটক আছেন এবং তার বিরুদ্ধে প্রায় ২৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

যার মধ্যে আছে সহিংসতায় ইন্ধন জোগানো, সন্ত্রাস, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, দোকান ভাঙচুর ইত্যাদি অভিযোগ। এমন একজন ব্যক্তি, যার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র দুই ডজনেরও বেশি মামলা দায়ের করেছে, তার সমালোচনা করার জন্য তাহলে কেন বাংলাদেশের একজন নাগরিককে হাজতে পাঠানো হলো এবং কেনইবা তার জামিনের জন্যে ৬ মাস সময় লাগলো? কেনইবা তাকে জামিনের জন্য হাইকোর্ট পর্যন্ত আসতে হলো?

ঝুমনের বেশ কয়েক মাস ধরে হাজতে থাকার নেপথ্যের ঘটনাগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যাক। ১৫ মার্চ, হেফাজত সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় একটি মিছিলের আয়োজন করে। পরের দিন ঝুমন একজন হেফাজত নেতার সমালোচনা করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস পোস্ট করেন, যার ফলশ্রুতিতে তার (নেতার) সমর্থকরা ঝুমনকে গ্রেপ্তার করার দাবি জানান এবং অন্যথায় হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামটিতে হামলা চালানোর হুমকি দেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান প্রতিবাদকারীদের দাবি মেনে নিয়ে ঝুমনকে পুলিশের হাতে তুলে দেন।

তারপরেও ১৭ মার্চ ঝুমনের গ্রামে হামলা চালানো হয় এবং বেশ কিছু বাড়িতে লুটপাট ও ৪টি মন্দিরের ক্ষতি করা হয়। এ ঘটনার সূত্রে ২০ মার্চ সারমঙ্গল ইউনিয়ন থেকে একজন ইউপি সদস্য এবং আরও ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ভাঙচুর ও মন্দিরের ক্ষতি করার মামলার মূল অভিযুক্ত আসামিকে ২ মাস পরে ২১ জুন জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। এ ছাড়া, বিভিন্ন সময়ে বাকি ১৮ জনকে জামিন দেওয়া হয়। কিন্তু ঝুমনের স্ত্রী ও সম্প্রদায়ের অন্যান্য সদস্যরা সহিংসতা ও আতঙ্কের শিকার হওয়া সত্ত্বেও ঝুমনকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৭ মাস আটক রাখা হয়।

শুরুতে তাকে ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ৫৪ ধারায় অভিযুক্ত করা হলেও তিনি আটক থাকার কোনো এক পর্যায়ে তার বিরুদ্ধে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (ডিএসএ) অভিযোগ আনা হয়, যার বেশিরভাগ ধারা অজামিনযোগ্য। ফলশ্রুতিতে, ঝুমনের জামিনের আবেদনে জটিলতা দেখা দেয়। তার জামিনের আবেদন ৬ থেকে ৭ বার নামঞ্জুর হয়ে পরিশেষে মঞ্জুর হয়।

ঝুমনকে গ্রেপ্তার করার সময় তার নিজের নিরাপত্তা ও হেফাজত কর্মীদের হাত থেকে গ্রামবাসীদের রক্ষা করার কারণ দেখিয়ে তাকে পুলিশের নিরাপত্তা হেফাজতে নেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু আটক করার পরেও তার গ্রাম আক্রান্ত হয়েছে, তার স্ত্রীকে আক্রমণ করা হয়েছে এবং তার নিজেরসহ বেশ কিছু বাড়ি-ঘর ভাঙচুর ও ৪টি মন্দিরের ক্ষতি করা হয়েছে। তারপরও, তাকেই ৬ মাসেরও বেশি সময় হাজতে কাটাতে হয়েছে, আর তাকে যারা নির্যাতন করেছেন অর্থাৎ যারা প্রকৃতপক্ষে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন, তাদেরকে ২ মাসের মধ্যে মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং তারা এখন ঝুমন, তার স্ত্রী ও সম্প্রদায়ের সদস্যদের প্রতি সম্ভাব্য ঝুঁকি হিসেবে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এত কিছু ঘটেছে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির সমালোচনা করায়, যার বিরুদ্ধে সরকার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ২৭টি মামলা দায়ের করেছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ব্যক্তি স্বাধীনতা আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় খুবই ক্ষুদ্র একটি জায়গা নিয়ে আছে। ঝুমনের জীবনের ৬ মাসেরও বেশি সময় চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে একটি 'অপরাধের' জন্য, যার ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না এবং এতে তার এমন একটি 'দোষ' হয়েছে, যেটি প্রমাণিত হয়নি। পরিশেষে, তাকে হয়তো দোষী সাব্যস্ত করা হবে না। তাহলে কে তার জীবনের এই হারিয়ে যাওয়া সময়ের দায় নেবেন? কে দায় নেবেন এর সঙ্গে সংযুক্ত খরচ, ভোগান্তি এবং এই মামলা চালিয়ে যাওয়ার কলঙ্কের, যা হয়তো আজীবন চলতে থাকবে? কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ১০ মাস জেলে ছিলেন এবং তার জামিনের আবেদন ৬ বার নামঞ্জুর হওয়ার পর মঞ্জুর হয়। ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলও গ্রেপ্তার হওয়ার ১০ মাস পর জেল থেকে ছাড়া পান। এর আগে ১৩ বার তার জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করা হয়েছিল। একটি নিরীহ ফেসবুক পোস্ট দেওয়ার কারণে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত সম্মানিত শিক্ষক সিরাজুম মুনিরাকে তার বাসা থেকে গভীর রাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তিনি ২ মাস পর জামিন পেলেও চাকরি হারান।

বাংলাদেশে একজন নাগরিককে গ্রেপ্তার করে আটক রাখার ক্ষেত্রে পুলিশের হাতে অসীম ক্ষমতা রয়েছে, অন্তত প্রথম ২৪ ঘণ্টার জন্য। এই সময়ে পুলিশ তার সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করবে, তা সহজেই অনুমানযোগ্য। পুলিশের হেফাজতে মৃত্যু আর নির্যাতনের ঘটনাগুলো সময়ে সময়ে ঘটেছে। পুলিশের হেফাজতে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা তো দূরে থাক, নিজের জীবনেরই কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশ দণ্ডবিধি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, বিস্ফোরক আইন, অস্ত্র আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং নিপীড়নমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার জন্য পুলিশের হাতে বিপুল ক্ষমতা তুলে দিয়েছে। উল্লিখিত প্রতিটি আইনে দায়ের করা মামলার ক্ষেত্রে জামিন পাওয়া বেশ জটিল, ঝামেলাপ্রদ এবং এর জন্য দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ডিএসএ'র আওতায় বেশিরভাগ শাস্তিমূলক ধারাগুলো অজামিনযোগ্য, যার কারণে কেউ এই আইনে গ্রেপ্তার হলে তার জন্য জামিন পাওয়া অতিমাত্রায় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

এককালে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা ঢালাও অপব্যবহারের জন্য পরিচিত ছিল। এ কারণে হাইকোর্ট এই ধারার অপব্যবহার রোধে কিছু স্পষ্ট নির্দেশনা দেন, যার মধ্যে ছিল সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেপ্তার নিষিদ্ধ করা, যে বিষয়টি মানুষের মনে তীব্র ভীতির সঞ্চার করেছিল। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোক হিসেবে পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাক পরিহিত ব্যক্তিরা রাতের অন্ধকারে, কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই মানুষকে তুলে নিয়ে যেতেন এবং এ ক্ষেত্রে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, সেটাও জানানো হতো না। তারা কোন সংস্থার পক্ষে কাজ করছেন সেটাও জানাতেন না, আর এ ক্ষেত্রে জোরাজুরি করা হলে তারা পরবর্তীতে আরও খারাপ পরিণতির হুমকি দিতেন। হাইকোর্টের নির্দেশনা এই ধারার ব্যবহারকে বড় আকারে কমিয়ে এনেছে। তবে গুমের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের এই নির্দেশনাগুলো খুব একটা কাজে লাগে না, কারণ ভুক্তভোগীরা অভিযোগ দায়ের করার সুযোগটিও পান না।

বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা— যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।' সংবিধানের তৃতীয় ভাগের শিরোনাম 'মৌলিক অধিকার' এবং এর ২৬ থেকে ৪৭ক অনুচ্ছেদ আইনের দৃষ্টিতে সমতা, আইনের আশ্রয়-লাভের অধিকার, জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকাররক্ষণ, চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতা ইত্যাদি সহ আরও বেশ কয়েক ধরনের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে।

৩২ ধারায় বলা হয়েছে, 'আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না' এবং ৩৩ ধারায় বেআইনি গ্রেপ্তার ও আটকের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। এই ধারার প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।' দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেপ্তারের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের স্থান হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে (আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে) হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাঁহাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না।'

সংবিধানে ব্যক্তি স্বাধীনতার এ রকম সুস্পষ্ট নিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও কেন বাংলাদেশের নাগরিকদের জামিনের অপেক্ষায় অনির্দিষ্ট সময় কারাগারে আটক থাকতে হয়? সংবিধানে এত ধরনের 'অধিকারের' কথা বলা হলেও, কেন ব্যক্তি স্বাধীনতা আমাদের শাসকগোষ্ঠী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও ব্যবহারিক দিক বিবেচনায় সবচেয়ে নিম্ন পর্যায়ে থাকা পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের খেলনায় পরিণত হয়েছে? কয়েকটি আইনে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যেতে পারে কিন্তু আরও সুস্পষ্ট উত্তর পেতে আইনের বাস্তবায়নের দিকে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশের আরও অনেক কিছুর মতোই বিধানে যা লেখা আছে তার চেয়ে মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা অনেকাংশে ভিন্ন।

অনেক বছর ধরে বাংলাদেশে জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতার অধিকার ক্ষয়িষ্ণু। আমরা এমনকি সংবিধানে দেওয়া অধিকারের ব্যাপারেও ভালো করে জানি না এবং যখন এই অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়, সেটা নিয়েও আমরা খুব বেশি ভাবি না। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয়টি হচ্ছে, আমরা এখন আর আগের মতো নিজের অধিকারের জন্য লড়তে আগ্রহী নই, যার কারণে সার্বিকভাবে আমাদের গণতন্ত্রে এক ধরনের হতাশাজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

যতবার একজন ব্যক্তির মুক্ত জীবনযাপনের অধিকারের অবমাননা করা হচ্ছে, ততবার আমাদের সংবিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে। আমরা সম্ভবত ভুলে গেছি, সরকার নয়, জনগণের হাতকে শক্তিশালী করার জন্যই আইনের অস্তিত্ব। আজ আমাদের বিধানে অনেক বেশি অশুভ আইন রয়েছে, যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাধীনতা খর্ব করা এবং এসব আইনের যথেচ্ছ প্রয়োগে আমাদের সব ধরনের স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে খর্ব হয়েছে।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Student politics, Buet and ‘Smart Bangladesh’

General students of Buet have been vehemently opposing the reintroduction of student politics on their campus, the reasons for which are powerful, painful, and obvious.

1h ago