‘৩ জনে ১ জন বা মৃত্যুহার ৪০ শতাংশ’ নিওকোভ কি এতটা ভীতিকর

নিওকোভ করোনাভাইরাসের নতুন ধরন, এই ধরনে সংক্রমণ হলে প্রতি ৩ জনে ১ জনের মৃত্যু বা মৃত্যুহার হতে পারে ৪০ শতাংশ—চীনের একটি গবেষণাকে উদ্ধৃত করে এমন একটি খবর প্রকাশ করে ভারতীয় গণমাধ্যম। সেই সূত্রে সংবাদটি প্রকাশ করে বাংলাদেশের গণমাধ্যম। সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে চারদিকে বেশ ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক ভ্রান্ত তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে।

নিওকোভ করোনাভাইরাসের নতুন ধরন, এই ধরনে সংক্রমণ হলে প্রতি ৩ জনে ১ জনের মৃত্যু বা মৃত্যুহার হতে পারে ৪০ শতাংশ—চীনের একটি গবেষণাকে উদ্ধৃত করে এমন একটি খবর প্রকাশ করে ভারতীয় গণমাধ্যম। সেই সূত্রে সংবাদটি প্রকাশ করে বাংলাদেশের গণমাধ্যম। সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে চারদিকে বেশ ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক ভ্রান্ত তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে।

আলোচনার শুরুতেই বলে নেওয়া দরকার, নিওকোভ কোভিডের নতুন কোনো ধরন নয়। নিওকোভ চলমান মহামারির নতুন কোনো রূপান্তরিত ভাইরাসও নয়। নিওকোভ নিয়ে আমাদের এখনই ভীতি বা দুশ্চিন্তার কোনো কারণই নেই। তবে, বিজ্ঞানীমহলে এই নতুন ভাইরাসটি নিয়ে বেশ আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে।

সম্প্রতি, চীনের উহান প্রদেশের একদল বিজ্ঞানী একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন প্রি-প্রিন্ট সার্ভার বায়োআর্কাইভে। এটি একটি উঁচুমানের এবং বিস্তারিত গবেষণা। অতি দ্রুতই হয়ত এটা নেচার জার্নালে প্রকাশিত হবে। গবেষণাপত্রটি আপাতত পীয়ার রিভিউ প্রক্রিয়াতে রয়েছে। এই গবেষণার ভিত্তিতেই আজকের এই লেখা।

করোনাভাইরাসের পরিবারটি বেশ বড়। এই পরিবারে বিভিন্ন বর্গ এবং গোত্রের করোনাভাইরাস রয়েছে। তার এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটো ভাইরাস হচ্ছে সার্স এবং মার্স ভাইরাস। এরা একই পরিবারের দুটি ভিন্ন বর্গের সদস্য। কোভিড-১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাব হয়েছে যে করোনাভাইরাসটি দিয়ে তার নাম নভেল করোনাভাইরাস বা সার্স কভ-টু। এটি সার্স গোত্রেরই একটি ভাইরাস। সার্স-কভ এবং সার্স কভ-টু ভাইরাস দুটির মধ্যে গঠনগত মিল রয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ এবং এই দুটি ভাইরাসই সংক্রমণ করে এসিই-টু রিসিপ্টরের মাধ্যমে। মূল উৎস বাদুড় থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পরেছে এই ভাইরাস দুটো। সার্স ভাইরাস দিয়ে দুটো মহামারি হয়েছে। একটা ২০০২ সালে চীনে শুরু হয়েছিল সার্স-কভ দিয়ে। আর বিভীষিকাময় চলমান কোভিড-১৯ মহামারি হচ্ছে সার্স কভ-টু দিয়ে। এটাও শুরু হয়েছে চীনে।

অন্যদিকে, নিওকোভ হচ্ছে মার্স ভাইরাস বর্গের অন্তর্গত। মার্স-কভের সঙ্গে নিওকোভের গঠনগত মিল রয়েছে প্রায় ৮৫ শতাংশ। দুটো ভাইরাসের প্রাকৃতিক পোষ্য বা আঁধার হচ্ছে এক প্রজাতির বাদুড়। মার্স-কভ ভাইরাসটি দিয়ে ২০১২ সালে মধ্যপ্রাচ্যে একটি মহামারির সূচনা হয়, যা পরবর্তীতে প্রায় ২৭টি দেশে ছড়িয়ে পরে। আক্রান্ত হয় প্রায় ২ হাজার ৫০০ মানুষ এবং মারা যায় প্রায় ৯০০ জন।

মার্স-কভ ভাইরাসটি প্রথমে বাদুড় থেকে উটে সংক্রমিত হয় এবং পরবর্তীতে তা উট থেকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পরে। মার্স-কভ ভাইরাসটি সংক্রমণ করে যে রিসিপ্টরের মাধ্যমে তার নাম ডিপিপি-ফোর। মানুষের নাসারন্ধ্র এবং শ্বাসনালীতে এই ডিপিপি-ফোর রিসিপ্টরের সংখ্যা খুবই কম। তবে ডিপিপি-ফোর রিসিপ্টর পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে ফুসফুসের অভ্যন্তরে বায়ুপ্রোকষ্ঠিতে। এ কারণেই মার্স ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় অপেক্ষাকৃত কম, কিন্তু একবার সংক্রমণ করলে তা ফুসফুসে সৃষ্টি করে মারাত্মক নিউমোনিয়া। আর এর ফলেই এই মার্স-কভ ভাইরাসে মৃত্যু হার প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, মার্স-কভ এবং নিওকোভ একই গোত্রের হলেও সংক্রমণের ক্ষেত্রে নিওকোভ ডিপিপি-ফোর রিসিপ্টর ব্যাবহার করে না। বরং নিওকোভ ব্যবহার করে এসিই-টু রিসিপ্টর। আর এর মূল কারণ হচ্ছে স্পাইক প্রোটিনের রিসিপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনের ভিন্নতা।

স্পাইক প্রোটিন হচ্ছে করোনাভাইরাসের দেহের একটি অংশ যা দিয়ে ভাইরাস নির্দিষ্ট রিসিপ্টরের সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টির মাধ্যমে পশু-পাখি বা মানুষকে সংক্রমিত করে। মূলদেহের গঠনগত অনেক সাদৃশ্য থাকলেও, নিওকোভের স্পাইক প্রোটিনের সঙ্গে মার্স-কভের স্পাইক প্রোটিনের মিল রয়েছে মাত্র ৪৫ শতাংশ। অন্য দিকে, জিনম সিকোয়েন্সিং এবং প্রোটিনের গঠনগত বিশ্লেষণে দেখা যায় নিওকোভের স্পাইক প্রোটিনের সঙ্গে সার্স কভ-টু করোনাভাইরাসের সাদৃশ্য রয়েছে অনেক। আর এ কারণেই নিওকোভ এবং সার্স কভ-টু উভয়ই এসিই-টু রিসিপ্টর ব্যাবহার করে সংক্রমণ করে।

গঠনগত দিক দিয়ে নিওকোভ হচ্ছে মার্স-কভ এবং সার্স কভ-২ এর একটি সংকর ভাইরাস। যার দৈহিক গঠন মার্সের মতো এবং সংক্রমণ করার মাধ্যম এবং প্রবণতা কোভিড রোগের ভাইরাস সার্স কভ-টু এর মতো।

তবে স্বস্তির কথা হচ্ছে, নিওকোভ শুধুমাত্র বাদুড়ের এসিই-টু রিসিপ্টরের সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টি করে শুধুমাত্র বাদুড়কেই সংক্রমণ করতে পারে। এই ভাইরাসটি এখনও মানুষকে সংক্রমণ করতে পারে না। তার কারণ হল বাদুড় এবং মানুষের এসিই-টু রিসিপ্টরের মধ্যে গঠনগত কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। আর এ কারণেই বাদুড় থেকে নিওকোভ ভাইরাস লাফ দিয়ে মানুষকে সংক্রমণ করতে পারে না। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত এই ভাইরাস থেকে আমরা নিরাপদ। মানুষের ভেতরে এই ভাইরাসের কোনো অস্তিত্ব নেই। সাধারণ জনগণ হিসেবে আমাদের দুশ্চিন্তার বা ভয়ের কোনো কারণ নেই।

এখন আসি নিওকোভ বিজ্ঞানী মহলে কেন মাথা ব্যথার কারণ?

উহানের বিজ্ঞানীরা পরীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে নিওকোভের স্পাইক প্রোটিনে মিউটেশনের মাধ্যমে সামান্য পরিবর্তন হলেই এই ভাইরাসটি মানুষের শরীরে থাকা এসিই-টু রিসিপ্টরের সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টি করার সক্ষমতা অর্জন করে এবং মানব কোষকে সংক্রমণ করতে পারে। একটি এমাইনো এসিডের পরিবর্তন হলে এই সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ৫ শতাংশ আর ৬টি এমাইনো এসিডের পরিবর্তন একসঙ্গে হলে সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ১৫ শতাংশ।

নিওকোভসহ অন্যান্য সকল করোনাভাইরাস হলো আরএনএ ভাইরাস। এই ধরনের ভাইরাসে মিউটেশন হয় নিয়মিত। আবার এদের আরএনএ রিকম্বিনেশন এবং জেনেটিক স্পিলওভারসহ এন্টিজেনিক ড্রিফ্টিং হয় অহরহ। এই কোভিড-১৯ মহামারিতেই গত ২ বছরে আমরা দেখেছি সার্স কভ-২ ভাইরাসের মিউটেশন। এখন আমরা দেখছি চারদিকে কীভাবে ওমিক্রন ছড়িয়ে পরছে। ওমিক্রনে মিউটেশন হয়েছে প্রায় ৫০টি।

বিজ্ঞানীদের আশংকা হচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকার এক বিশেষ প্রজাতির বাদুড়ের শরীরে থাকা এই নিওকোভ ভাইরাসে যদি কোনো ভাবে স্পাইক প্রোটিনের বিশেষ মিউটেশন হয় যাতে করে তারা মানুষের এসিই-টু রিসিপ্টের সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টি করার সক্ষমতা অর্জন করে, তাহলে তা অতিদ্রুত ছড়িয়ে পরবে মানুষের মাঝে এবং সঠিক সময় সঠিক ব্যবস্থা না নিলে এই রূপান্তরিত নিওকোভ সূচনা করতে পারে আরেকটি মহামারির। তাত্ত্বিকভাবে বলা যায়, নিওকোভ দিয়ে কোনো মহামারি হলে তা হবে অত্যন্ত ভয়ংকর। কারণ নিওকোভ মূলত একটি মার্স ভাইরাস যার সংক্রমণে মৃত্যু হার হতে পারে প্রায় ৪০ শতাংশ।

২০১২ সালে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘটিত মার্স মহামারিতে মৃত্যু হয়েছে ১ হাজারের কম। তার একটি প্রধান কারণ ছিল মার্স ভাইরাসটি একজন থেকে আরেকজনে খুব দ্রুত ছড়াতে পারে না। সার্স কভ-২ ভাইরাসের আর-নট নম্বর যেখানে ৩ থেকে ৬, সেখানে মার্সের আর-নট নম্বর ছিল ১ এরও কম। অর্থাৎ ওমিক্রন যখন একজন থেকে ৬ জনে ছড়ায়, মার্স ভাইরাসটি তখন একজন থেকে আরেকজনেই ভালো মতো ছড়াতে পারে না।

যে হাতিয়ারের মাধ্যমে সার্স ভাইরাস এত সংক্রামক, নিওকোভের সেই হাতিয়ার বা স্পাইক প্রোটিনটি রয়েছে, সঙ্গে বাড়তি রয়েছে মার্সের মতো মারাত্মক নিউমোনিয়া তৈরির ক্ষমতা। এই কারণেই বিজ্ঞানী মহল নিওকোভ নিয়ে এত সোচ্চার। তবে, আশার কথা হচ্ছে নিওকোভ নিয়ে আগেই বিস্তর গবেষণা মানুষের মাঝে এর বিস্তার রোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

কোভিড মহামারির কয়েক বছর আগে উহানের একদল বিজ্ঞানী একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে গবেষণার মাধ্যমে তারা দেখিয়েছিলেন চীনের বাদুড় থেকে কীভাবে সার্স ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পরে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। তখন পাশ্চাত্য বিশ্বের বিজ্ঞানীরা ওই গবেষণাকে হয়ত কোনো গুরুত্বই দেয়নি। তবে, এবার আর তা হবে না। এক ভুল নিশ্চয়ই বারবার হওয়ার কথা নয়। বিজ্ঞানীমহল নিওকোভ নিয়ে আরও গবেষণা করবে এবং এই ভাইরাসটির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখবে। এটা বিজ্ঞানীদের কাজ। আর সাধারণ মানুষের কাজ হচ্ছে নিওকোভ নিয়ে একদম দুশ্চিন্তা না করা। এত সহসাই এই ভাইরাসটি মানুষের ভেতরে ছড়িয়ে পরছে না।

ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম, এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka denounces US 2023 human rights report

Criticising the recently released US State Department's 2023 Human Rights Report, the foreign ministry today said it is apparent that the report mostly relies on assumptions and unsubstantiated allegations

1h ago