শ্রীলঙ্কা: বাঁচতে হলে শিখতে হবে…

মানুষ দুভাবে শেখে। প্রথমত দেখে, দ্বিতীয়ত ঠেকে। শ্রীলঙ্কায় এখন যা হচ্ছে, সেটা দেখে আমরা শিখছি। এই দেখা থেকে না শিখলে আমরা দ্রুতই ঠেকে যাব এবং সেই ঠেকে শেখাটি অধিকতর কঠিন হবে।

মানুষ দুভাবে শেখে। প্রথমত দেখে, দ্বিতীয়ত ঠেকে। শ্রীলঙ্কায় এখন যা হচ্ছে, সেটা দেখে আমরা শিখছি। এই দেখা থেকে না শিখলে আমরা দ্রুতই ঠেকে যাব এবং সেই ঠেকে শেখাটি অধিকতর কঠিন হবে।

শ্রীলঙ্কা এখন যে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেরকম পরিস্থিতি আমাদের দেশে হবে কি না—তা এখনই বলা না গেলেও বেশ কিছু বিষয়ে দেশটির সঙ্গে আমাদের যেহেতু মিল রয়েছে, অতএব আমরা নিজেদেরকে নির্ভার কিংবা ১০০ ভাগ ঝুঁকিমুক্ত ভাবতে পারি না। আমাদের কিছুই হবে না—এই মানসিকতা পরিহার করে বরং শ্রীলংকার কাছ থেকে যদি শিখতে পারি সেটা ভবিষ্যতে এরকম পরিস্থিতি এড়াতে সহায়তা করবে।

শ্রীলঙ্কায় কী হচ্ছে এবং এটা নিয়ে কেন আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে—সেটা নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা জরুরি।

অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে পতন হয় শ্রীলঙ্কা সরকারের, যেটি ছিল মূলত একটি প্রভাবশালী কর্তৃত্ববাদী পরিবারের হাতে। বৈদেশিক ঋণে বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ, বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়া, বড় আয়ের পথ পর্যটন খাতে মহামারির ধাক্কাসহ বিভিন্ন কারণে দেশটির এমন পরিণতি। দেশটির আমদানি সক্ষমতা এখন শূন্যের কোঠায়।

ভ্যাট কমানোর ফলে জাতীয় আয় কমে যাওয়া এবং প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চাষের জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশক আমদানি নিষিদ্ধ করার ফলে কৃষিজাত ও খাদ্য উৎপাদনে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। এর মধ্যে পর্যটন নির্ভর দেশটিতে করোনার হানা। তাছাড়া বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো কমে যাওয়ার রিজার্ভ অতি দ্রুত কমে ৫০ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। রিজার্ভ না থাকায় খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ আমদানি ব্যাহত হয়। চীনের ঋণে দেশটি অনেকগুলো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প করেছে।

শ্রীলঙ্কার এই বাস্তবতার বিপরীতে বাংলাদেশের অবস্থা কেমন?

১. বাংলাদেশেও বেশ কয়েক বছর ধরে এক ধরনের প্রভাবশালী কর্তৃত্ববাদী সরকার ব্যবস্থা চালু রয়েছে—যা মূলত পরিবারতান্ত্রিক। বিশেষ করে গত ২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশে-বিদেশে সমালোচিত হয়েছে। কারণ মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি।

২. করোনা মহামারিতে বিশ্বের অনেক শক্তিশালী অর্থনীতি দেশও যেখানে ভয় পেয়েছে, বাংলাদেশের মতো তুলনামূলক কম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ এবং যেখানে জনঘনত্ব অত্যন্ত বেশি, যেখানে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, সেখানের অর্থনীতি খুব একটা বিপর্যয়ে পড়েনি। এর পেছনে মূলত কাজ করেছে শক্তিশালী, সাহসী ও দূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আলোকে দীর্ঘমেয়াদে লকডাউন না দেওয়া এবং অর্থনীতির চাকাগুলো সচল রাখা।

৩. বৈদেশিক ঋণ এবং নিজস্ব অর্থায়নে অনেকগুলো মেগা বা বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে যার অনেকগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। যেমন রাশিয়ার কাছ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে মাত্র ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। পদ্মা সেতুর রেললাইন প্রকল্প হচ্ছে ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে। এখান থেকে যে আয় হবে তা দিয়ে ঋণের কিস্তি শোধ করার সম্ভাবনা নেই। সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ। এটা হওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোরের অধীনে। কিন্তু সেই করিডোর মরে গেছে। কারণ, ভারত এই প্রকল্প থেকে বের হয়ে গেছে। এডিবি থেকে নেওয়া ঋণে কক্সবাজার পর্যন্ত যে রেললাইন হচ্ছে তার কিস্তির টাকা এর থেকে আয়ের টাকায় শোধ হবে না। পায়রা বন্দর গভীর সমুদ্র বন্দর করার জন্য করা হয়েছিল। এর পেছনে কয়েকশ কোটি টাকা এরই মধ্যে খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু এখন আর সেখানে গভীর সমুদ্র বন্দর হবে না, সমুদ্র বন্দর হবে (দ্য ডেইলি স্টার অনলাইন, ১৪ মে ২০২২)।

৪. বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ সচল আছে—যা করোনার ভেতরেও দেশের অর্থনীতি সচল রাখার বড় ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মার্চ মাসের তথ্য অনুযায়ী ১৮৬ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনা মহামারির মধ্যেও ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে।

৫. এ মুহূর্তে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৪ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার (পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের ফেসবুক পোস্ট, ১২ মে ২০২২)।

৬. করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও বাংলাদেশ রপ্তানি আয়ে চমক দেখিয়েছে। গত অর্থবছরে ১৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) প্রবৃদ্ধি হয়েছে তারও দ্বিগুণ ৩৩ দশমিক ৪১ শতাংশ।

৭. বাংলাদেশের আমদানি সক্ষমতা ভালো আছে। সেইসঙ্গে ট্যাক্স ও ভ্যাট আদায় ভালো হওয়ায় জাতীয় আয় কমেনি।

৮. চাল-ডাল-সবজি-ফল-মাছ-মাংস-ডিমের উৎপাদন যথেষ্ট ভালো। শুধু তা-ই নয়, এ মুহূর্তে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয়, আলু উৎপাদনে ষষ্ঠ, আম উৎপাদনে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে রয়েছে। ২০০৯ সালে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমানে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন। তাছাড়া মাংস ও ডিমের উৎপাদন বিদেশে রপ্তানির পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে দাবি করেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম (ঢাকা পোস্ট, ৪ মার্চ ২০২২)। ভোজ্য তেল ও পেঁয়াজ আমদানি নির্ভর হলেও এখন পর্যন্ত এই খাতে ভয়াবহ সংকট দেখা দেয়নি। বরং ভোজ্য তেল হিসেবে সয়াবিন ও পাম তেলের বিকল্প হিসেবে অন্যান্য তেলের সরবরাহ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। সব মিলিয়ে দেশে খাদ্য ঘাটতি বা খাদ্য সংকটের কোনো শঙ্কা আপাতত নেই। এটি একটি বিরাট আশার সংবাদ।

৯. এ মুহূর্তে দেশে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের উৎপাদন বেশি। যদিও সরবরাহ লাইনে ত্রুটি এবং কিছু সিস্টেম লসের কারণে কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দেয়।

১০. বাংলাদেশ এখন ওষুধে স্বয়ংসম্পূর্ণই নয়, বরং ওষুধ এখন রপ্তানিও হয়।

কী শিখছি?

বাংলাদেশের যখন এই পরিস্থিতি তখন শ্রীলঙ্কায় ক্ষমতাসীনদের আন্ডারওয়্যার বেরিয়ে যাওয়ার ছবি আসছে গণমাধ্যমে। এটা শ্রীলঙ্কার মতো একটি শিক্ষিত জাতির দেশের জন্য অত্যন্ত বেদনার এবং সেইসঙ্গে এটি পৃথিবীর সকল উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য একটি বার্তা যে, ভুল উন্নয়ন পরিকল্পনার খেসারত এভাবেই দিতে হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ যেখানে একসঙ্গে অনেকগুলো মেগা প্রকল্প চলছে এবং যে মেগা প্রকল্প মানেই মেগা দুর্নীতি—এমন অভিযোগও রয়েছে। ফলে আমাদের এখানে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি হবে না, তা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায় না। তবে যেহেতু শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি থেকে আমাদের সরকার বা নীতিনির্ধারকরা বার্তা নিয়েছেন এবং শিখছেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে, অতএব আমরা আশাবাদী হতেই পারি।

যেমন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ ও কম গুরুত্বপূর্ণ আমদানি নির্ভর প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ঘাস কাটা, মধু চাষ, পুকুর খনন, সাঁতার শেখার মতো হাস্যকর কাজের নামে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা যে অপচয় হতো, সেটি বন্ধ হবে। বস্তুত এই ধরনের অনর্থক বিদেশ সফর, যেগুলো সম্পূর্ণই জনগণের টাকার অপচয়, তা আরও অনেক আগেই বন্ধ করা উচিত ছিল। এখন শ্রীলঙ্কার ধাক্কায় যদি সেটি বন্ধ করা যায়, তাও 'বেটার লেট দ্যান নেভার'।

দ্বিতীয়ত, দেশে আর কোনো নতুন সড়ক নির্মাণ না করে তার বদলে বিদ্যমান সড়কগুলো রক্ষণাবেক্ষণের পরিধি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশে সড়কের ঘনত্ব বেশি। নতুন সড়ক নির্মাণে বিরতি দিয়ে যেগুলো বানানো হয়েছে, সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। দেশে যথেষ্ট সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, এই সিদ্ধান্ত আসার পেছনেও ভূমিকা রেখেছে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি।

স্মরণ করা যেতে পারে, সম্প্রতি বাঁধ ভেঙে হাওরের ফসল তলিয়ে গেলে সেখানে ভবিষ্যতে আর কোনো সড়ক নির্মাণ না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অথচ পরিবেশবাদীরা শুরু থেকেই হাওরের ভেতর দিয়ে সড়ক নির্মাণের বিরোধিতা করেছিলেন। সেটি উপেক্ষা করেই সড়ক নির্মাণ করা হয় এবং এখন যার খেসারত দিতে হচ্ছে। অবশেষে নীতিনির্ধারকদের বোধোদয় হলো যে, হাওরে সড়ক নির্মাণ ভুল ছিল। এটি হচ্ছে ঠেকে শেখা। তাও ভালো যে, অন্তত তারা ঠেকে শিখলেন।

এবার আমাদের জন্য একটি শেখার সুযোগ করে দিয়েছে শ্রীলঙ্কা। এই বোধোদয়গুলো বিলম্বে হলেও ভালো। পাশের ঘরে আগুন লেগেছে দেখে আমরা যদি নিজেদের ঘরের ফায়ার ফাইটিং সিস্টেমগুলো দ্রুত পরীক্ষা না করি, ফায়ার সার্ভিসকে প্রস্তুত না রাখি, ইমার্জেন্সি ফায়ার এক্সিটগুলো সচল না রাখি, আগুন লাগলে কোন পথ দিয়ে দ্রুততম সময়ে নিরাপদে ভবন থেকে বেরিয়ে যেতে পারব এবং আগুন নেভানোর মতো পর্যাপ্ত পানি ও অন্যান্য সরঞ্জাম প্রস্তুত না রাখি—তাহলে ওই দেখে শেখাটাই আমাদের হবে না। তখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঠেকে শেখাটা খুব কঠিন হবে। সেই কঠিন পরিস্থিতি আমাদের কারোই কাম্য হওয়া উচিত নয়।

সর্বোপরি, শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশে না হোক এটাই প্রত্যাশা। কারণ যদি ওইরকম পরিস্থিতি হয়, তাহলে সেটা সামগ্রিকভাবে দেশের জন্যই অমঙ্গলজনক হবে। কারণ এরকম ঘটনায় শুধু দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-এমপিদের বাড়িঘরই শুধু জ্বলে না, বরং দেশের অন্যান্য সম্পদও ধ্বংস হয়। শ্রীলংকায় যা ক্ষতি হয়ে গেছে বা হচ্ছে, তা কটিয়ে উঠতে অনেক বছর লাগবে।

বাংলাদেশে যদি শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরোধীরা খুশি হবেন। তারা ভাববেন, স্বৈরশাসনের অবসান হলো। তারা ভাবছেন, এরকম পরিস্থিতি তৈরি হলে দেশ থেকে দুর্নীতি ও লুটপাট হাওয়া হবে যাবে। দেশ গণতন্ত্রের সাগরে ভাসবে। অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। সয়াবিন তেলের লিটার ৮০ টাকা হয়ে যাবে। চালের কেজি হবে ২০ টাকা। গণমাধ্যমে সাংবাদিক এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ যা খুশি লিখতে পারবেন ইত্যাদি।

আসলে এর কিছুই হয়তো হবে না। বরং দেশটা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যতটা এগিয়েছে, অনেক দুর্নীতি ও অনিয়মের মধ্যেও অর্থনীতির যেসব সূচকে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে, তাও ধ্বংস হবে এবং পরবর্তী কয়েক বছর যাবে ওই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে। অথবা সেই ক্ষতি হয়তো কোনো দিনই কাটিয়ে ওঠা যাবে না। তারচেয়েও বড় কথা, এখন যারা ভাবছেন যে বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হলে তারা ভালো থাকবেন, আসলে তারাও ভালো থাকবেন না।

সবচেয়ে বড় কথা, কোনো একটি দল বা সরকার যদি জনগণের প্রত্যাশা পুরোপুরি পূরণে ব্যর্থ হয়, তারপরও সেই দেশের জনগণের এমন কোনো প্রত্যাশা করা উচিত নয় যা ওই সরকার ও দলের সঙ্গে সঙ্গে দেশকেও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়। আজকে শ্রীলঙ্কায় দুর্নীতিবাজ ও গণবিরোধী সরকারের পতন হয়েছে এটা ঠিক। কিন্তু সেখানে কি রাতারাতি সব বদলে যাবে? বাংলাদেশেও অতীতে দেখা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার কারণে ক্ষমতা চলে গেছে আর্মিদের হাতে। তাতে কিছু সময় দেশে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ ছিল বটে, কিন্তু আখেরে দেশটা পিছিয়ে গেছে।

তাহলে উপায় কী?

উপায় হচ্ছে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশে তৈরি হোক, সেটা কামনা না করা এবং সব সময় নিজের দেশের জন্য কল্যাণ প্রার্থনা করা। দ্বিতীয়ত, সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি এমনভাবে সম্পন্ন করা যাতে বিগত ২টি নির্বাচন যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা যায়।

যদি মানুষ বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের ভোট দেয় তাহলে তারা আবার সরকার গঠন করবেন। যদি তা না হয় তাহলে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতার পালাবদল ঘটবে। এর জন্য এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যাতে মানুষ স্বাধীনভাবে তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারে। অর্থাৎ নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যমান সংবিধানের আলোকেই নির্বাচন হবে নাকি এখানে কোনো পরিবর্তন আসবে; নির্বাচনকালীন নতুন কোনো সরকার গঠন করা হবে নাকি বর্তমান সরকার ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই নির্বাচন হবে; যদি এরকম হয় তাহলে সেই নির্বাচনে বিএনপিসহ অন্যান্য বড় দলগুলো অংশ নেবে কি না; যদি নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণে নিশ্চিত করা না যায় তাহলে পরিস্থিতি কী হবে—এসব নিয়েও ভাবতে হবে।

কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংকট যাতে দেশকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে না দেয় বা কেউ যাতে এই সংকট পুঁজি করে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করতে না পারে, সে বিষয়ে সরকার, বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষকে সচেতন থাকতে হবে।

শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি এড়াতে এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের। তাদের আচরণ, কথাবার্তা ও সিদ্ধান্তে যাতে মানুষ ক্ষুব্ধ না হয়, সে বিষয়ে তাদের যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে। নিশ্চয়ই তাদের অনেক ভুলত্রুটি ও বিচ্যুতি আছে। সেগুলোর পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। পক্ষান্তরে বিরোধীদেরও উচিত হবে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয় বা কেউ যাতে এরকম পরিস্থিতি তৈরিতে উসকানি না দেন, সে বিষয়ে সচেতন থাকা। কারণ দেশে আগুন লাগলে তার ঘরটিও পুড়বে।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments