শেয়ারবাজারে যা দরকার আর বিএসইসি যা করছে

যে খাতে বিনিয়োগ করলে মুনাফা হয়, সে খাতে আপনাআপনিই বিনিয়োগ আসে, এটি মুক্তবাজার অর্থনীতির একটি সাধারণ নিয়ম। সুতরাং, প্রশ্ন উঠেছে কেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) প্রাতিষ্ঠানিক এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য বারবার অনুরোধ করছে এমনকি বিদেশে রোড শো আয়োজন করেও, তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে পারছে না।

যে খাতে বিনিয়োগ করলে মুনাফা হয়, সে খাতে আপনাআপনিই বিনিয়োগ আসে, এটি মুক্তবাজার অর্থনীতির একটি সাধারণ নিয়ম। সুতরাং, প্রশ্ন উঠেছে কেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) প্রাতিষ্ঠানিক এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য বারবার অনুরোধ করছে এমনকি বিদেশে রোড শো আয়োজন করেও, তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে পারছে না।

বিএসইসির তথ্য অনুযায়ী, শেয়ারবাজারের লেনদেনে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ মাত্র ২০ শতাংশ যা বিশ্ববাজারের গড়ে ৪১ শতাংশ। ভারতে, ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে টার্নওভারের ৫৫ শতাংশ করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। পাকিস্তানের করাচি স্টক এক্সচেঞ্জে এটি ৩৫ শতাংশ।

বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ কম হওয়ার পেছনে বিশ্লেষকরা বিনিয়োগের উপযোগী পরিবেশ না থাকাকে দায়ী করছেন। এক্ষেত্রে মোটাদাগে পাঁচটি কারণ রয়েছে যেগুলো উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করছে।

এক. তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই, তাই তারা বাজারে বিনিয়োগ করতে ভয় পান। কারণ একটি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে প্রকৃত পরিস্থিতির ভুল উপস্থাপনের কারণে রাতারাতি তার আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। বাংলাদেশের স্টক মার্কেটে এটি বেশ কয়েকবার ঘটেছেও। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অনেক কোম্পানি স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে বড় সম্ভাবনা এবং মুনাফা দেখায়, কিন্তু তালিকাভুক্তির পরে তাদের মুনাফা কমে যায়, ফলে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্তির আগে তাদের মুনাফা কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেখায়।

এছাড়া, তালিকাভুক্ত কিছু কোম্পানি বছরের পর বছর ভাল মুনাফা দেখাচ্ছে যাতে তাদের শেয়ারের দাম বেশি থাকে, তবে তারা শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয় খুব কমই। বেশিরভাগক্ষেত্রেই এর অর্থ হচ্ছে আর্থিক প্রতিবেদন কোম্পানির প্রকৃত চিত্র দেখায় না। ফলে তারা মুনাফা দেখালেও লভ্যাংশ দিতে পারছে না।

দুই. বেশ কয়েকটি কোম্পানি প্রতি বছর মুনাফা করছে এবং ভালো লভ্যাংশও দিচ্ছে কিন্তু তাদের শেয়ারের দাম তুলনামূলকভাবে কম। এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে গবেষণা ভিত্তিক বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগ করতে চান না।

তিন. বেশির ভাগ সময় ছোট কোম্পানি, লোকসানী কোম্পানি এবং বন্ধ কারখানার শেয়ারও বাজারে প্রচুর বিক্রি হয় এবং দাম বাড়তে থাকে। এমনকি শীর্ষ দরবৃদ্ধির তালিকায়ও উঠে আসে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এ বাজারকে জুয়ার বাজার হিসেবে গণ্য করে। যা তাদেরকে এ বাজারে বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত করে।

চার. বিএসইসি ছাড়া অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকেও তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলিতে ঘন ঘন নীতিগত হস্তক্ষেপ করা হয় যা অনেক সময় কোম্পানিগুলির আয়কে প্রভাবিত করে এবং শেষ পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির কারণ হয়। তাই তারা এই ধরনের বাজারে বিনিয়োগ করতে উৎসাহ বোধ করে না।

উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) বিএসইসির সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ না করেই না করে গ্রামীণফোনকে একটি উল্লেখযোগ্য বাজার শক্তি (এসএমপি) ঘোষণা করে। পরে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে শেয়ারটি ব্যাপকভাবে বিক্রি করতে শুরু করে। কারণ, এসএমপি ঘোষণার মধ্যদিয়ে কোম্পানিটির উপর উচ্চ চার্জ প্রত্যাশিত ছিল। যা কোম্পানিটির আয় কমিয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি করে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের ঘটনা, এটিই প্রথম নয়। ২০১৫ সালে, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন তিতাস গ্যাসের বিতরণ চার্জ কমিয়ে দেয়। ফলস্বরূপ, রাষ্ট্র পরিচালিত গ্যাস ইউটিলিটি কোম্পানির শেয়ারের দাম বাজার মূল্যে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি হারায় এবং এটি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আঘাত করে।

পাঁচ. বিনিয়োগের পরিবেশ যাই হোক না কেন কোন বড় বিনিয়োগকারী যদি স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করতে চায়ও বাজারে বিনিয়োগ করার মতো শেয়ারের সংখ্যা খুবই কম। মোট শেয়ারের সংখ্যাও বেশি নয়। ডিএসইতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা মিউচুয়াল ফান্ড এবং বন্ড ছাড়া ৩৪৯টি যেখানে মুম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জে ৫ হাজার ২৫৪টি এবং করাচি স্টক এক্সচেঞ্জে ৫৭৬টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। কর্পোরেট গভর্ন্যান্স এবং সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে ডিএসই-এর কোম্পানির সংখ্যা মাত্র ৩০, যেগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিদেশি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ রয়েছে।

ইতিবাচক দিক হলো বিএসইসি শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছে যে বাজার যদি রিটেইল ইনভেস্টরদের উপর ভিত্তি করে চলে তাহলে যে কোনো ঘটনায় বাজার আতঙ্কিত হয়ে যায় এবং সূচক ভঙ্গুর হয়ে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে।

কিন্তু, বিএসইসি ব্যাংক, স্টক ডিলার, সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলিকে তাদের বিনিয়োগ বাড়াতে অনুরোধ করার মধ্যেই তাদের কাজ সীমাবদ্ধ রেখে আসল সমস্যাগুলো সমাধান করছে না। এই ধরনের অনুরোধের ফলে, বড় বিনিয়োগকারীরা অনুরোধটি রাখতে সাময়িকভাবে কিছু বিনিয়োগ করতে পারেন এবং ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক দিনের জন্য স্টক সূচকও বাড়তে পারে। তবে, এটি বিএসইসির ইচ্ছা পূরণ করবে না এবং বাজারকে টেকসইভাবে উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে না।

এদিকে, বাংলাদেশের শেয়ার বাজার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাংক খাতের উপর নির্ভরশীল। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকগুলোকে বিভিন্নভাবে উচ্চ বিনিয়োগে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেই বিএসইসিসহ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের নিন্দার মুখে পড়ে। বাস্তবতা হলো ব্যাংকগুলোর এমন ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায় বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করা উচিত নয়। কারণ স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করা তাদের মূল ব্যবসা নয় এবং তারা সাধারণ আমানতকারীদের অর্থ দিয়ে ব্যবসা করছে। ফলে ক্ষতির শিকার হলো পুরো ব্যাংক সমস্যায় পড়ে যেতে পারে।

অধিকন্তু, জীবন বীমা তহবিল এবং পেনশন তহবিলগুলি বিশাল এবং এ তহবিলগুলো থেকে দীর্ঘ সময়ের জন্য বিনিয়োগ করার বিশাল সুযোগও রয়েছে তাই বিএসইসির উচিত এ তহবিলগুলোকে বাজারে আকৃষ্ট করা। বর্তমানে দেশের জীবন বীমা তহবিল প্রায় ৫০০ বিলিয়ন টাকা এবং যার বেশিরভাগই সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে।

এ তহবিলগুলোকে পুঁজিবাজারে আকৃষ্ট করার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এটি করার জন্য স্টক মার্কেট নিয়ন্ত্রককে যেকোনো মূল্যে কারসাজি বন্ধ করতে হবে। বিএসইসির উচিত সূচকের ওঠানামা নয় বরং বাজারে সুশাসন নিশ্চিত করা। এমনকি যদি কঠোর তদারকির কারণে বাজারের সূচক প্রাথমিকভাবে কমেও যায় পরবর্তীতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণে তা আবার সুদৃঢভাবে ঘুরে দাঁড়াবে। বর্তমানে বিএসইসি কখনও কখনও দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে ভয় পায় কারণ এই ধরনের কার্যকলাপ সূচকের পতনের কারণ হতে পারে।

এছাড়া বিএসইসির উচিত হবে তালিকাভুক্ত কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের সঙ্গে একযোগে কাজ করা। বিনিয়োগের সুযোগ বাড়াতে ভালো কোম্পানিগুলোকেও শেয়ারবাজারে আনতে হবে।

আহসান হাবীব: সিনিয়র রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার

Comments

The Daily Star  | English

Cuet students suspend protests

Say authorities assured them of meeting their major demands

Now