রাজাকার আখ্যা দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার বিপত্তি

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদেরকে সহায়তা করার জন্য স্থানীয়দের সমন্বয়ে একটি আধাসামরিক বাহিনী গঠন করেছিল, যেটি রাজাকার বাহিনী নামে পরিচিত হয়। যারা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে পাক হানাদার  বাহিনীর পক্ষে কাজ করেছে, তাদেরকে চিহ্নিত করার জন্য একটি অপমান ও উপহাসমূলক শব্দ হিসেবে স্বাধীনতার পর এটি বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়। ১৬ ডিসেম্বরে আমাদের বিজয়ের ঠিক আগে বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে রাজাকাররা সরাসরি জড়িত ছিলেন।
এক রাজাকারের আইডি কার্ড

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদেরকে সহায়তা করার জন্য স্থানীয়দের সমন্বয়ে একটি আধাসামরিক বাহিনী গঠন করেছিল, যেটি রাজাকার বাহিনী নামে পরিচিত হয়। যারা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে পাক হানাদার  বাহিনীর পক্ষে কাজ করেছে, তাদেরকে চিহ্নিত করার জন্য একটি অপমান ও উপহাসমূলক শব্দ হিসেবে স্বাধীনতার পর এটি বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়। ১৬ ডিসেম্বরে আমাদের বিজয়ের ঠিক আগে বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে রাজাকাররা সরাসরি জড়িত ছিলেন।

স্বাধীনতার পর আমাদের সমাজে রাজাকারদের অচ্ছুৎ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এমনকি তাদের বংশধররাও এই অপমানজনক তকমার হাত থেকে রক্ষা পাননি, এবং তাদেরকে সারা জীবন এই কলঙ্ক বহন করে বেড়াতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। তবে রাজাকারদের কোনো আনুষ্ঠানিক তালিকা না থাকায় সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিপক্ষদের আক্রমণ করার জন্য এই শব্দের অপব্যবহার করার সুযোগ পান। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে রাজাকারদের একটি আংশিক তালিকা তৈরি করা হয়, কিন্তু তীব্র সমালোচনা ও বিতর্কের মুখে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এই তালিকা প্রত্যাহার করে নেয়। ত্রুটিপূর্ণ এ তালিকায় ভাষা আন্দোলনের অনেক পথিকৃৎ এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরও নাম ছিল।

দেশকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করার সংগ্রামে নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগের কাছে রাজাকার হচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতীক। দেশের সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক দলটি বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর জন্য এই শব্দ ব্যবহার করেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই সন্দেহজনক তকমা ক্ষমতাসীন দলের জন্য শাঁখের করাত হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ তাদের নিজেদের নেতা ও কর্মীরাই এখন একে অপরকে ঘায়েল  করার জন্য এবং দলের ভেতরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের সুনাম ক্ষুণ্ণ করার জন্য 'রাজাকার' শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার করছেন। এক্ষেত্রে তারা প্রকৃতপক্ষে রাজাকার কী না, সে বিষয়টি একেবারেই বিবেচনায় থাকছে না।

গত ২৭ অক্টোবর সোনারগাঁও হোটেলে একটি অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেছিলেন, 'আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের যাচাই-বাছাইয়ের আমরা লক্ষ্য করি, দলের সদস্যরা এক অন্যের বিরুদ্ধে এই অপবাদ দিচ্ছেন।' বিরক্ত হয়ে তিনি এই বিষয়টিকে 'দুর্বিষহ' বলে মন্তব্য করেন।

'তুই রাজাকার' এই ম্লোগানটি মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পায় ৮০'র দশকের শেষের দিকে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক 'বহুব্রীহি' বিটিভিতে প্রচারিত হওয়ার পর। এটি এমন এক সময় ছিল, যখন ইচ্ছাকৃতভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে চাপা দিয়ে রাখা হতো।

ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ সময় 'বহুব্রীহি' দেখানো হয় এবং এই নাটকে সুকৌশলে সকল অভিযোগের ঊর্ধ্বে থাকা একটি 'টিয়া পাখির' মুখ দিয়ে ব্রাত্য শব্দ 'রাজাকার' উচ্চারণ করানো হয়েছিল। এই টিয়া পাখিকে সেন্সরশিপের বেড়াজালে আবদ্ধ জাতির রুদ্ধ কণ্ঠের প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছিল এবং প্রশিক্ষিত পাখিটি সুযোগ বুঝে 'তুই রাজাকার' বলে উঠতো। এর মাধ্যমে বলা যায় না এমন একটি কথাও তখন সুকৌশলে সবার সামনে চলে এসেছিল।

৯০ এর দশকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সন্তান হারানো শহীদ জননী জাহানারা ইমাম প্রথম বারের মতো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য চাপ তৈরি করেন। তিনি ৯০ এর দশকের প্রথম দিকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নজিরবিহীন আন্দোলন শুরু করেন। তিনি ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গণআদালত গঠনে নেতৃত্ব দেন, যেখানে যুদ্ধের সময় সংঘটিত নৃশংসতার নেপথ্যে থাকা সাবেক জামায়াতে ইসলামির প্রধান গোলাম আজমের বিচার করা হয়।

২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনের সময়, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য আবারো এই স্লোগানটি ফিরে আসে মানুষের মুখে মুখে। এর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়া গতিশীল হয়। আন্দোলনকারীরা যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে 'তুই রাজাকার' স্লোগান তোলেন।

তবে কালের প্রবাহে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে এই জনপ্রিয় শ্লোগানের অর্থই বদলে গেছে, যেটি একসময় অসাম্প্রদায়িক সমাজের সার্বজনীন দাবি আদায়ের আহ্বান ছিল। কাউকে রাজাকারের তকমা দেওয়া এখন অন্য আরও অনেক কিছুর মতই তৃণমূল পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের এক অপরকে দায়ী করার সাধারণ অস্ত্রে পরিণত হয়েছে, বিশেষ করে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে। দেশজুড়ে ক্ষমতাসীন দলের ইউনিয়ন পরিষদের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা একে অপরকে রাজাকার বা রাজাকারের পরিবারের সদস্য তকমা দিয়ে ঘায়েল করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন। কেউ কেউ সংবাদ সম্মেলন করছেন, এলাকায় মিছিল বের করছেন এবং এমনকি, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির কার্যালয়েও লিখিত অভিযোগ পাঠাচ্ছেন। এরই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অক্টোবর ২৭ এর বক্তব্যে উল্লেখ করেন।

উদাহরণস্বরূপ, রংপুরের পীরগাছা উপজেলার তাম্বুলপুর ইউনিয়নের তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা রংপুর ইউনিটের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে চিঠি পাঠিয়ে দলের ইউনিয়ন ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক শাহীন সরদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান। তারা অভিযোগ করেন, শাহীনের বাবা শান্তি কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। উল্লেখ্য, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে এই দল গঠন করেছিল। শাহীন সরদার তাম্বুলপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদের জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান।

একই অভিযোগ আনা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা, যশোরের মণিরামপুর উপজেলা, পাবনার সুজানগর উপজেলা এবং অন্যান্য কিছু জেলার আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে।

এই পরিস্থিতি নতুন কিছু নয়। ২০১৮ তে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের সময়ও এরকম হয়েছিল। সেসময় ছাত্রলীগ নেতা ও কর্মীরা একে অপরের বিরুদ্ধে রাজাকার পরিবারের সঙ্গে অথবা বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনেন।

যদি তর্কের খাতিরে আমরা মেনেও নেই যে তৃণমূল নেতাদের আনা অভিযোগগুলো সত্য, তাহলে পরবর্তী প্রাসঙ্গিক এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে এতজন রাজাকার আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করেছে, যে দল এককভাবে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক হিসেবে নিজেদেরকে দাবি করছে? কীভাবে এসব অনুপ্রবেশকারী দলে পদ ও মনোনয়ন পাচ্ছে?

সম্প্রতি বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগ নেতারা অভিযোগ করেছেন যে জামায়াতে ইসলামি ও তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সুযোগসন্ধানী কর্মীরা দলে অনুপ্রবেশ করেছেন এবং এখন তারা দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছেন।

যেহেতু তৃণমূল নেতারা একে অপরকে রাজাকারের তকমা দিচ্ছেন এবং এমনকি তাদের বিরুদ্ধে দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে লিখিত অভিযোগও জমা দিচ্ছেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এই অনুপ্রবেশকারীরা দলের মধ্যেই পুনর্বাসিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং দলের অপর শীর্ষস্থানীয় নেতারা বারবার 'অনুপ্রবেশকারীদের দলে স্থান দেওয়া হবে না' বলে সতর্ক করলেও এসব ঘটনা ঘটছে।

২০২০ এ দলটি দাবি করেছিল যে তারা অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা তৈরি করেছে এবং তালিকাভুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির বিপরীতে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

আওয়ামী লীগ ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে, যেটি বাংলাদেশের যেকোনো দলের জন্য সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে দীর্ঘতম সময়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যুক্তি দেন, যদি কোনো দল দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকে, তাহলে স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের মানুষ সেখানে অনুপ্রবেশ করবে এবং ক্ষমতাসীন দলের নামে বিভিন্ন অপকর্ম করবে। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলকেই এর দায় নিতে হবে। এখানে আরও একটি বিষয় হচ্ছে, প্রতিপক্ষের অভাবে দলের ক্ষমতাসীন দলের একটি অংশ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

আওয়ামী লীগ যদি উদার ও মুক্ত-চিন্তার মানুষের দল হিসেবে তাদের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে চায়, তাহলে এই অনুপ্রবেশ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির পুনর্বাসন প্রক্রিয়া থামানোর দায়িত্ব তাদের ওপরেই বর্তায়। তবে এক্ষেত্রে বড় প্রশ্ন হচ্ছে: বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?

পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য: চিফ রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Pak PM lauds Bangladesh’s economic progress

Says ‘we feel ashamed when we look towards them’

1h ago