ভাষা আন্দোলনের গান যাকে অমরত্ব দিয়েছে

২০০৯ সালের ডিসেম্বরে নারী প্রগতি সংঘ আয়োজিত বেগম রোকেয়া স্মারক বক্তা ছিলেন আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। তার সঙ্গে আরেকজন বক্তা ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। সময়ের ব্যবধানে দুই কৃতী বাঙালিই আজ প্রয়াত।
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

২০০৯ সালের ডিসেম্বরে নারী প্রগতি সংঘ আয়োজিত বেগম রোকেয়া স্মারক বক্তা ছিলেন আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। তার সঙ্গে আরেকজন বক্তা ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। সময়ের ব্যবধানে দুই কৃতী বাঙালিই আজ প্রয়াত।

তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ক্যাম্পাসে বা ক্যাম্পাস-সংলগ্ন কোথাও সেমিনার ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনা সভা দেখলে আমরা দলবেঁধে গুণীজনদের কথা শুনতে যেতাম, আলোচনা শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশগ্রহণ করতাম। এরকম এক সেমিনারেই প্রথম দেখার সৌভাগ্য হয় কিংবদন্তি সাংবাদিক, লেখক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীকে। বিলেত প্রবাসী হওয়ায় ঢাকায় তার উপস্থিতি বেশ দুর্লভই বলা যায়; মাঝে মধ্যে ঢাকায় আসতেন। কিন্তু তার লেখালেখির সঙ্গে পরিচয় স্কুলজীবনে পত্রিকা পড়া শুরুর বয়স থেকেই। বিশেষ করে কলেজে ভর্তি হবার পর মনে হয় না কোনো পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে সেটা মিস করেছি। সিলেট তথা উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন একটি গ্রন্থাগার কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে ক্লাস শেষে নিয়মিত বিকেল বেলা পড়তে যেতাম। কোনো বিশেষ কারণে তার কলাম পড়া মিস হলে গ্রন্থাগার-সহকারীকে বলে পত্রিকা রুমে ওইদিনের পুরনো ফাইল ঘেঁটে বের করে পড়ে নিতাম।

এভাবে আমরা বড় হয়েছি, বেড়ে উঠেছি—তার কলাম পড়ে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নাদর্শ ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে আমৃত্যু এমন অবিচল আপসহীন বাঙালি এ জীবনে খুব কম দেখেছি। এক যুগ আগে যখন ২০০৯ সালে এই কিংবদন্তির সঙ্গে জাতীয় জাদুঘরে দেখা হয়, বলেছিলাম- আপনার কলামের একজন নিষ্ঠ পাঠক। শুনে সস্নেহে জড়িয়ে ধরেছিলেন। চর্মচক্ষে এ দেখাই ছিল শেষ দেখা। আর কখনোই দেখা হয়নি ত্রিকালদর্শী বরেণ্য বাঙালির সঙ্গে।

গাফ্‌ফা‌র চৌধুরী এদেশে পত্রিকায় রাজনৈতিক কলামকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। জনপ্রিয় ও পাঠকপ্রিয় করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের আমৃত্যু অকৃত্রিম সুহৃদ ও শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। কিন্তু সরকার ও দলের ভুল ভ্রান্তিতে কঠোর সমালোচনা করতেও কার্পণ্য করেননি। চাইতেন গণমানুষের আন্দোলন সংগ্রাম থেকে উঠে আসা দলটি যেন তার আদর্শিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত না হয়। অন্যায়কে অন্যায় বলায় তার কণ্ঠ ও কলম সবসময়ই জাগ্রত ছিল। এভাবে তিনি বুদ্ধিজীবীর বিবেকী দায়িত্ব পালন করেছেন। এদেশে পাঠকেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম তার লেখা পড়েছে। সপ্তাহে তিন চারটা পত্রিকায়ও নিয়মিত তিনি কলাম লিখেছেন। দেখে বিস্ময় জাগত। এরকম সাবলীল রাজনৈতিক কলাম দশকের পর দশক এদেশে দ্বিতীয় কেউ লিখেছেন বলে জানা নেই। তবে সাংবাদিকতার পাশাপাশি একজন শক্তিমান কথাসাহিত্যিক হিসেবে তার লেখালেখির জীবন শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেই সৃজনশীল লেখকসত্তার আয়ু দীর্ঘ হয়নি। সেজন্য নিজেই দুঃখ করেছেন। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে বিলেতে এক অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'প্রথমত, আমার একটা ধারণা ছিল, আমি একজন বড় সাহিত্যিক হব। কিন্তু হতে পারিনি। কারণ আর্থিক টানাপেড়েন। বিয়ে করার পর যখন দেখলাম, গল্প লিখে প্রকাশকের কাছে গেলে ১০০ টাকা দেয়, তাও আবার ১০০ দিন ঘুরিয়ে। এতে সংসার চলে না। কিন্তু খবরের কাগজে রাজনৈতিক কলাম লিখলে মাসে ৪০০ টাকা আসে। ওই যে ঝুঁকে পড়লাম, এরপর আর ফেরা হয়নি। এরপর আবার বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেলাম। তখন তো রাজনৈতিক লেখার খোরাক আরও বেশি করে পেতাম। তিনিও মাঝেমধ্যে ফরমাশ দিতেন—এটা লেখো, ওটা লেখো। সেই কারণে সাহিত্যিক হওয়ার স্বপ্ন আমার সফল হয়নি।'

দ্বিতীয়ত, আমার ধারণা ছিল, যে কোনো কারণেই হোক, বাংলাদেশ একটা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে—হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টানের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। কারণ, উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশের বিশেষত্বই ছিল মিশ্র সংস্কৃতি, পলি মাটিসমৃদ্ধ সাগরবিধৌত দেশ। এছাড়া বিভিন্ন সংস্কৃতি আরব-পারস্য-টার্কিশ-পতু‌র্গিজ সব সংস্কৃতির একটা মিলন-মোহনা মনে করতাম দেশটাকে। তাই ভাবতাম, এ দেশটা আর যা-ই হোক, কখনও সাম্প্রদায়িক হবে না। সুতরাং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তিতে যখন স্বাধীনতার ডাক দিলেন, আমি তাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি। মৃত্যুর মুখোমুখিও হয়েছি, কিন্তু ভয় পাইনি। আমার সেই আশাটা পূরণ হয়নি। আমার তো মনে হয়, পাকিস্তান আমলে আমরা যতটা অসাম্প্রদায়িক ছিলাম, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছি।' বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া জুনিয়র মাদরাসায় ক্লাস সিক্স পর্যন্ত লেখাপড়া করলেও গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতা তাকে কখনো স্পর্শ করেননি উলটো আজীবন ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি লিখে গেছেন।

আমৃত্যু আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক অগ্রসর প্রগতিশীল এই বাঙালির শুন্যতা আক্ষরিক অর্থেই অপূরণীয়। ভাষা আন্দোলনের অবিস্মরণীয় "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কী ভুলিতে পারি" গানের রচয়িতা, 'চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান', 'সম্রাটের ছবি' কিংবা 'আমরা বাংলাদেশী নাকি বাঙ্গালী'র লেখক বরিশালের জলবেষ্টিত এক গ্রাম উলানিয়ার চৌধুরী বাড়ির এই সন্তান বেঁচে থাকবেন বাঙালির হৃদয়ে, বেঁচে থাকবেন এই দেশ ও বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে।

 

আলমগীর শাহরিয়ার: কবি ও গবেষক

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments