ব্যাংক কেন মূলধন সংকটে পড়ে?

মূলধন ছাড়া কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি, বছরের পর বছর কোনো রকম মূলধন ছাড়াই বাংলাদেশের অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ব্যবসা পরিচালনা করছে। এসব ব্যাংকের মালিক সরকার। সংকট থেকে মুক্তি পেতে ইতোপূর্বে ব্যাংকগুলোকে হাজার হাজার কোটি টাকার মূলধন যোগান দেওয়া হয়েছিল। সাধারণ মানুষের করের টাকায় এই মূলধনের যোগান দিয়েছিল সরকার। এরপরও মূলধন স্বল্পতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি এসব ব্যাংক। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির তুলনা করা হয়, তাদের চেয়ে এখানকার ব্যাংকখাতের মূলধনের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক।

মূলধন ছাড়া কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি, বছরের পর বছর কোনো রকম মূলধন ছাড়াই বাংলাদেশের অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ব্যবসা পরিচালনা করছে। এসব ব্যাংকের মালিক সরকার। সংকট থেকে মুক্তি পেতে ইতোপূর্বে ব্যাংকগুলোকে হাজার হাজার কোটি টাকার মূলধন যোগান দেওয়া হয়েছিল। সাধারণ মানুষের করের টাকায় এই মূলধনের যোগান দিয়েছিল সরকার। এরপরও মূলধন স্বল্পতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি এসব ব্যাংক। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির তুলনা করা হয়, তাদের চেয়ে এখানকার ব্যাংকখাতের মূলধনের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক।

এতো মূলধন যায় কোথায়- এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন থাকার অবকাশ খুবই কম। এই উন্নয়নকে অবারিত রাখার জন্য একটি কার্যকর ও শক্তিশালী ব্যাংকখাতের বিকল্প নেই। কারণ ব্যাংকের মাধ্যমেই সরকারি-বেসরকারি খাতের উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালিত হয়। আর উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে পর্যাপ্ত তহবিল নিশ্চিত করা। এই ধরনের তহবিল পর্যাপ্ততার নিশ্চয়তা দেয় একটি শক্তিশালী ব্যাংকখাত। কিন্তু মূলধন সংকট বলছে, আমাদের ব্যাংকখাত যথেষ্ট দুর্বল, যা পর্যাপ্ত তহবিল সরবরাহের নিশ্চয়তা দেয় না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ১০টি ব্যাংক গত বছর ৩৪ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এতো মূলধন ঘাটতি কখনো দেখা যায়নি। ব্যাংকগুলো হচ্ছে- সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন, আইসিবি ইসলামিক, বাংলাদেশ কমার্স ও ন্যাশনাল ব্যাংক। তালিকার শেষের তিনটি বেসরকারি ব্যাংক।

সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, গত বছর ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক একাই ১২ হাজার ৪২৮ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে ছিল। ইতোপূর্বে ২০০২-২০০৩ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ২০ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকার মূলধন যোগান দিয়েছিল সরকার। কিন্তু, এরপরও এই উদ্যোগ ইতিবাচক কোনো কিছু বয়ে আনতে পারেনি ব্যাংকগুলো জন্য।

মূলধন ঘাটতির নেপথ্য কারণ খুঁজতে গেলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বিষয়টি সামনে চলে আসে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ সংকটে আছে দীর্ঘদিন ধরে।

গত বছর ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালের চেয়ে ১৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি। আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ছিল ৪৮ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা, যা সমস্ত ব্যাংকখাতের ৪৭ শতাংশ।

খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে ব্যাংকের প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয় বেশি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নিয়মিত বা ভালো ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের প্রভিশন রাখতে হয় এক বা দুই শতাংশ। কিন্তু, খেলাপি ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন জমা রাখতে হয়। ব্যাংকের স্বাস্থ্য রক্ষা ও আমানতকারীদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখার জন্যই প্রভিশন রাখার এই ব্যবস্থা। খেলাপি হওয়া ঋণ উদ্ধার করার সম্ভাবনা কমে যায়। ফলে এর বিপরীতে নগদ টাকা প্রভিশন রাখার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু, অতিরিক্ত এই প্রভিশন রাখতে গিয়ে অনেক ব্যাংক প্রয়োজনীয় মূলধন রাখতে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। কেননা, দিন শেষে মূলধন থেকে তহবিল সরিয়ে তা প্রভিশন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয় ব্যাংকগুলোকে।

বাংলাদেশের ব্যাংকখাত গত বছর সম্মিলিতভাবে ১৪ হাজার ৭ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতির মুখে পড়ে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত বা অন্যান্য দুর্বল বেসরকারি ব্যাংকগুলো কেন ধারাবাহিকভাবে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এর অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে দুর্নীতি। অনিয়মের মাধ্যমে এসব ব্যাংক থেকে ঋণের নামে বের করে ফেলা হয়েছে বড় অঙ্কের টাকা। হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, ক্রিসেন্ট বা অ্যাননটেক্স গ্রুপের দুর্নীতির কথা সবাই জানে। প্রধানত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে এই টাকা সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। এসব কেলেঙ্কারীর জের ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ব্যাপক হারে বেড়ে যায়।

বিভিন্ন সময় বৈশ্বিক মানদণ্ড এড়িয়ে খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য গত চার-পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার জারি করে আসছে। এতে খেলাপি ঋণ সময়-সময় কিছুটা কমলেও তা আবার বেড়ে যায়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, করোনাভাইরাস মহামারির জের ধরে ঋণগ্রহীতারা গত বছর তাদের ঋণের প্রদেয় মোট কিস্তির ১৫ শতাংশ দিতে পারলেই খেলাপি তকমা এড়িয়ে যেতে পারবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশনা দেয়। আর ২০২০ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছিল, বছরজুড়ে কোনো কিস্তির টাকা দিতে না পারলেও ঋণগ্রহীতা খেলাপি হবে না। এ ধরনের কোনো সুযোগ চলতি বছর আর থাকছে না। ফলে খেলাপি ঋণ ব্যাপকহারে বাড়ার সংকট তৈরি হয়েছে আবারো। এতে চলমান মূলধন সংকট আরও তীব্র হবে ব্যাংকগুলোতে।

খেলাপি ঋণ বেড়ে গেলে ব্যাংকের মূলধন রাখতে হয় বেশি। ব্যাংকের মূলধন হিসাবায়নের জন্য আছে আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন। এক্ষেত্রে বৈশ্বিক অর্থনীতির গতি প্রকৃতিকে সামনে রেখে মূলধন রাখার বিভিন্ন নিয়ম ঠিক করে থাকে ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট (বিআইএস)। এই প্রতিষ্ঠানটি সুইজারল্যান্ডের ব্যাসেল শহরে অবস্থিত। এর অংশ হিসেবে বিআইএসের নিয়মকে ব্যাসেল গাইডলাইন্স হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। দুনিয়াজুড়ে ব্যাংকগুলো এখন মূলধন সংরক্ষণ করার যে নিয়ম অনুসরণ করছে, তাকে ব্যাসেল-৩ হিসেবে অভিহিত করা হয়।

ব্যাসেল গাইডলাইন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদও বাড়ে। ঋণের মান অনুযায়ী ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ নির্ণয় করা হয়। ভালো ঋণের বিপরীতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ কম হিসাব করা হয়। আবার খেলাপি ঋণের বিপরীতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই ধরনের সম্পদকে কেন্দ্র করে কোনো ব্যাংককে কতো মূলধন রাখতে হবে তা নির্ণয় করা হয়। ব্যাসেল-৩ অনুসারে মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়, যাকে মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়লে এর বিপরীতে বেশি মূলধন রাখতে হয় ব্যাংকগুলোকে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দিকে নজর দিলে দেখা যায়, ২০২০ সালে পাকিস্তানের ব্যাংকগুলোতে মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত ছিল ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ভারতে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ। আর বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে ওই সময় এই অনুপাত ছিল ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

ওই তিন দেশের ব্যাংক খাতে মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত ২০২১ সালে কেমন ছিল তা নিয়ে এখনও তথ্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে গতবছর এই অনুপাত কমে হয়েছে ১১ দশমিক ০৮ শতাংশ। অর্থাৎ, এখানকার ব্যাংকিং খাতের মূলধনের ভিত্তি আরও দুর্বল হয়েছে।

কোনো দেশের ব্যাংকখাতে মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত কম থাকলে তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বেশ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশে বিনিয়োগ বা ব্যবসা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ব্যাংক খাতের শক্তিমত্তা নিরূপনের জন্য এই আর্থিক সূচকটি বেশ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে।

আবার বিদেশি ব্যাংকগুলো আমদানি নিষ্পত্তি করার জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন রাখতে ব্যর্থ হওয়া ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ঋণপত্র খুলতে চায় না। তখন এসব ব্যাংককে আমদানি নিষ্পত্তি করার জন্য বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে গ্যারান্টি নিতে হয়। সাধারণ, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনামধারী বিদেশি ব্যাংকগুলো এই ধরনের গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। এর জন্য আবার অতিরিক্ত ফি গুণতে হয় মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ ব্যাংকগুলোকে। এর ফলে সংকটে থাকা ব্যাংকের আয় কমে যায়।

দুর্নীতি মোকাবিলার পাশাপাশি করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশের মূলধন সংকটে থাকা ব্যাংক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারে। যেসব বেসরকারি ব্যাংক এখন মূলধন সংকটে ভুগছে, সেখানেও এক সময় বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারী হয়েছিল। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করা যেমন জরুরি, তেমনি বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে মুক্ত রাখতে হবে পরিচালকদের কবল থেকে। সরকারের সদিচ্ছা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের শক্তিশালী তদারকি নিশ্চিত করার মাধ্যমেই ব্যাংকের মূলধন ভিত্তি শক্তিশালী হতে পারে। এতে কমবে দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণ।

লেখক: সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার

Comments

The Daily Star  | English

Create right conditions for Rohingya repatriation: G7

Foreign ministers from the Group of Seven (G7) countries have stressed the need to create conditions for the voluntary, safe, dignified, and sustainable return of all Rohingya refugees and displaced persons to Myanmar

5h ago