পশুপাখির প্রতি যে নৃশংস, সে মানুষের ক্ষেত্রেও নিষ্ঠুর হতে পারে

চলতি বছরের জুলাইয়ের প্রথম থেকে লকডাউন শুরুর পর রাজধানীর কাঁটাবনে বৃহত্তম পোষা প্রাণীর মার্কেটে প্রায় চারশ পাখি এবং কয়েক ডজন কুকুর, বিড়াল, খরগোশ, ইঁদুর এবং গিনিপিগ মারা গেছে। এ ঘটনা নতুন নয়। যখন করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউ আঘাত হানে, তখনো লকডাউনে এই মার্কেটের বহু প্রাণী মারা যায়, কষ্টে ছিল। বিপন্ন ও বন্দী পশুপাখিদের কান্নার আওয়াজে এলাকাবাসীর নজরে আসে বিষয়টি।
রাজধানীর কাঁটাবনে বৃহত্তম পোষা প্রাণীর মার্কেট। স্টার ফাইল ফটো

চলতি বছরের জুলাইয়ের প্রথম থেকে লকডাউন শুরুর পর রাজধানীর কাঁটাবনে বৃহত্তম পোষা প্রাণীর মার্কেটে প্রায় চারশ পাখি এবং কয়েক ডজন কুকুর, বিড়াল, খরগোশ, ইঁদুর এবং গিনিপিগ মারা গেছে। এ ঘটনা নতুন নয়। যখন করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউ আঘাত হানে, তখনো লকডাউনে এই মার্কেটের বহু প্রাণী মারা যায়, কষ্টে ছিল। বিপন্ন ও বন্দী পশুপাখিদের কান্নার আওয়াজে এলাকাবাসীর নজরে আসে বিষয়টি।

আবারও সেই একই ঘটনার ভয়াবহ পুনরাবৃত্তি দেখলাম। ঢাকা শহরে পশুপাখি বিক্রির এই মার্কেটে যারা গেছেন তারা জানেন কতটা অস্বাস্থ্যকর ও ভয়াবহ পরিবেশে সেখানে পশু-পাখিগুলো রাখা হয়। এর ওপর যখন লকডাউনে দোকান বন্ধ থাকে- তখন গরমে, খাবারের অভাবে এরা দয়ামায়াহীন অবস্থায় মারা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে- লকডাউনের আগে কেন এদের রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না? ব্যবসায়ীরা শুধু ব্যবসা বুঝেন, এদের কষ্ট তাদের মন স্পর্শ করে না! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অধীনে এই মার্কেট, কাজেই তাদেরও একটা দায় থেকে যায়। শুরু হচ্ছে ঈদের ছুটি ও লকডাউন, তাহলে কি প্রাণীগুলো আবারও একইভাবে মারা যাবে?

বাংলাদেশে পশুপাখি ও গরিব মানুষের মৃত্যুর মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য তো দেখছি না। সবাই মায়া-মমতাহীন ব্যবসার শিকার। সেই যে নারায়ণগঞ্জে আগুনে পোড়া ৫২টি শিশুর মরদেহ আর এই চারশ পশুপাখির মধ্যে কি কোন ফারাক খুঁজে পাওয়া যায়? যায় না। যদি নিরাপদ কারখানার উপযোগী করে হাসেম ফুড তাদের ভবন বানাতো, যদি সঠিক অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা রাখতো, যদি কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতো, যদি শিশু শ্রমিক না রাখতো- তাহলে কি আগুনে পুড়ে এতগুলো শিশু অঙ্গার হতো?

সেক্ষেত্রে হয়তো তারা ব্যবসায় এত উন্নতি করতে, স্বল্প সময়ে এতগুলো প্রতিষ্ঠান গড়তে বা এত কর দিতে পারত না। সুতরাং, এই পুরো প্র্রক্রিয়া একটি শোষণ। এই প্রক্রিয়ায় দরিদ্র শিশুদের জন্য চিনি গোলা রং ও কেমিক্যাল দিয়ে জুস বিক্রি করা যায়, আবার তাদের দিয়েই বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করিয়ে সেই জুস তৈরি করিয়ে নেওয়া যায়।

ছয়তলা বিশাল কারখানার ভবন থেকে বের হওয়ার পথ (সিঁড়ি) মাত্র দুটি। বলা যায় শিশু শ্রমিকগুলো একপ্রকার আবদ্ধ ছিল। সেদিন কারখানা ভবনের ভেতর থেকে সাদা ব্যাগে করে একে একে ৪৯টি পোড়া মরদেহ বের করে আনা হয়েছিল, ঠিক একইভাবে বের করে আনা হলো চারশ প্রাণীর মরদেহ। এরা সবাই ব্যবসার বলি হলো। যদি শুধু লাভের চিন্তা না করে পশুপাখিগুলো উন্নত পরিবেশে রাখা হতো, হয়তো এমন পরিস্থিতি দেখতে হতো না। মানুষ বা প্রাণীদের এভাবে বন্দি করে রাখা হলে যে কোনো খারাপ পরিস্থিতিতে তারাই আগে বিপদে পড়ে।

পরপর বেশ কয়েকটি খবর দেখে মনটা ভেঙে গেল। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর ও ছবি দেখে এত কষ্ট পেলাম যে, মনে হলো কিছু একটা আর্জি জানাই কর্তৃপক্ষ সমীপে। দিনাজপুর থেকে বাসের তিনটি লকারে ৪৬টি ছাগল সিলেটে আনা হয়েছে কোরবানির জন্য। বুঝতে পারেন এই প্রচণ্ড গরমে, বাসের লকারে থাকা প্রাণীগুলো বাতাস-পানি-খাবারের অভাবে কতটা কষ্ট পেয়েছে। ছবিতে দেখলাম ১৪ ঘণ্টা যাত্রা শেষে এদের টেনে-হেঁচড়ে বাস থেকে নামানো হচ্ছে।

ঢাকার সাভারে তীব্র জ্যামে আটকা পড়ে প্রচণ্ড গরমে মারা গেছে ২৭ মণের একটি গরু। অসুস্থ হয়ে পড়েছে আরও পাঁচটি। পাবনা থেকে এসব গরু আনা হচ্ছিল কোরবানির জন্য। সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দামের এই গরুটিকে নিশ্চয় বিশেষ আদর-যত্ন করেই কোরবানির জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু, কোরবানির ময়দানে পৌঁছানোর আগেই গরুটির জান কোরবান হয়ে গেল।

অনেক জায়গায় গরু অসুস্থ হওয়ার খবরও আসছে। পশুবাহী গাড়ির ক্ষেত্রে আমাদের আলাদা কোনো নির্দেশনা নেই। তীব্র যানজটের সঙ্গে প্রচণ্ড গরমে ছটফট করতে করতে শরীয়তপুর-চাঁদপুর ফেরিঘাটে এ পর্যন্ত ২০টি গরু মারা গেছে। নিরুপায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতির কথা ভেবে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। একজন পশুপ্রেমী হিসেবে আমিতো কষ্ট পাচ্ছি।

কেন ঈদের সময় আমরা পশু পারাপার ও রাজধানীতে আনার সময় ন্যনতম মানবিকতা দেখায় না, কেন ভাবি না ওরা কীভাবে আরাম করে আসতে পারে? কেন আমরা এমন কোনো সিস্টেম চালু করি না- যাতে মৃত্যুর আগে প্রাণীটির যাত্রা নিরাপদ ও সুখের হয়।

কোরবানির মতো একটি পবিত্র কাজে যার জীবনকে উৎসর্গ করা হচ্ছে, সে বা তারা আমাদের কাছে এতটা মূল্যহীন ও অনাদরের হয় কীভাবে? এদের মূল্য তো নিজের সন্তানের মতোই প্রিয় হওয়া উচিত। পশু ব্যবসায়ীরা নিজেদের সম্বল ও পুঁজি বাঁচাতে ফেরির সংখ্যা বাড়ানো ও দ্রুত পারাপারের দাবি জানাচ্ছেন- আর আমরা মানবিকতার স্বার্থেই চাইছি এদের জন্য একটু ভালবাসা, একটু সুবিধা। অধিকাংশ মানুষের মনে পশুপাখির প্রতি ভালবাসা প্রায় নেই বললেই চলে। এদের আমরা শুধু পশু হিসেবেই বিবেচনা করি। কাজেই এরা কষ্ট পেলে আমাদের কারো কিছু এসে যায় না। সে কোরবানির পশুই হোক, অথবা অন্য পশুই হোক।

সেদিন শ্রীমঙ্গলে ধান খেত থেকে আহত অবস্থায় একটি মেছোবাঘ উদ্ধার করা হয়েছে। যার কোমরে কেউ লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে। এরমধ্যে সীমান্ত ঘেঁষা নাগর নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল ছোট্ট একটি নীলগাই। স্থানীয়রা নীলগাইটি দেখে এমনভাবে ধাওয়া করে যে, সেই ধাওয়া খেয়ে পালাতে গিয়ে মারা যায় সেটি।

দু’বছর আগে ফেনীর সোনাগাজীতে গভীর রাতে কৃষকের একটি অন্তঃসত্ত্বা গাভী চুরি করে চামড়াযুক্ত গাভীর মাথা গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা। চট্টগ্রামে একজন প্রবাসী এক হরিণ শাবককে খাবার দিয়ে ভুলিয়ে কাছে এনে গুলি করে হত্যা করল এবং পরে মৃত হরিণের পাশে দাঁড়িয়ে সদলবলে ফটোসেশন করল। পুরো দৃশ্যটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভিডিও চিত্র শেয়ারও করেছিল সেই প্রবাসী বাঙালি। লালমনিরহাটে কৃষকের ধান খেয়েছে বলে প্রাণ দিতে হয়েছে শতাধিক পাখিকে। এগুলো সব নিউজ হয়ে এসেছে।

একটা মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করলে তার যে কষ্ট হয়, একটা পশুরও তাই হয়। দেশে নৃশংসভাবে পশু হত্যার হার ব্যাপকভাবে বাড়ছে, বাড়ছে প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা। এতে আমাদের চিন্তিত হওয়ার কারণ আছে। কারণ যে মানুষ নিরীহ পশুপাখির ওপর নৃশংস হতে পারে, তার পক্ষে পরবর্তীতে মানুষের ওপর নিষ্ঠুর হওয়া খুব কঠিন হয় না। নৃশংসতায় তার অভ্যস্ততা তৈরি হয়।

পত্রিকায় পড়লাম মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা অপরাধ বিষয়ক একটি গবেষণার তথ্য হাতে পেয়ে অবাক হয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে- যে কোনো বড় ধরনের অপরাধের সূত্রপাত হয় পশুর ওপর নৃশংস হওয়ার অভ্যস্ততা থেকে। এফবিআই মনে করে, আজকে যে একটা নিরীহ পশুকে অত্যাচার বা হত্যা করছে, কাল সে মানুষ মারতে দ্বিধা করবে না।

রাজধানীতে দুই মা কুকুরসহ ১৪টি বাচ্চাকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হয়েছিল। মনিপুরি পাড়ায় বাথরুমে বন্দি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় আরেক কুকুরকে। হত্যার ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল করা হয়। রাজবাড়ীতে একটি ঘোড়ার চার পা বেঁধে পায়ুপথে ও মূত্রনালিতে বাঁশের লাঠি ঢুকিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। শত্রুতা ছিলো ঘোড়ার মালিকের সঙ্গে, কিন্তু মারা যেতে হলো ঘোড়াটিকে।

এই কথাগুলো বলার কারণ হচ্ছে- মানুষ হত্যার সঙ্গে পশু হত্যার একটি সম্পর্ক আছে। ঘোড়াটিকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেই একইভাবে হত্যা করা হয়েছিল বগুড়ার কাহালু এবিসি টাইলস কারখানায় রাসেলকে ও রুবেলকে। খুলনায় শিশু রাকিব এবং নারায়ণগঞ্জে শিশু সাগর বর্মণকে একইভাবে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।

বেগমগঞ্জে এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে, বেঙ্গালুরুতে একটি মেয়েকে পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করা হলো… এগুলোর কোনোটাই হঠাৎ ঘটেনি। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এই অমানুষগুলো প্রাণীর ওপর নির্যাতন করেই হাত পাকিয়েছে। হত্যা হত্যাই, নির্যাতন নির্যাতনই, সেটা হোক মানুষ বা পশু। তাই আমরা আশা করব পশুর প্রতি অন্যায় ও বর্বর নির্যাতন যারা করছে, তাদের প্রতি দৃষ্টি দিন। কোনো পশুপাখিকে অত্যাচার বা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা ও শাস্তি হওয়া উচিত।

শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Secondary schools, colleges to open from Sunday amid heatwave

The government today decided to reopen secondary schools, colleges, madrasas, and technical education institutions and asked the authorities concerned to resume regular classes and activities in those institutes from Sunday amid the ongoing heatwave

20m ago