পরীমনি: মানবাধিকার লঙ্ঘনের কেস স্টাডি

পরীমনির ঘটনাটি যেন দেশের দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক রিয়েলিটি শো। জনগণের করের টাকা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় পরিবেশিত এই শো পরিচালনায় কারা জড়িত ছিলেন তা ধারণা করা কঠিন নয়।
ছবি: সংগৃহীত

পরীমনির ঘটনাটি যেন দেশের দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক রিয়েলিটি শো। জনগণের করের টাকা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় পরিবেশিত এই শো পরিচালনায় কারা জড়িত ছিলেন তা ধারণা করা কঠিন নয়।

দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিশ্লেষণ ও উন্নয়নে এ ঘটনা একটি গুরুত্বপূর্ণ কেস স্টাডি হতে পারে। কারণ এর সঙ্গে জড়িত বিদ্যমান সমাজ কাঠামো, নারী ও সাধারণ মানুষের প্রতি সমাজ-রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচরণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেশাদারিত্ব, সরকারের দায়বদ্ধতা, সাধারণ-মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি।

তুলনামূলকভাবে পরীমনি কম সুবিধাভোগী মানুষ— অর্থাৎ তিনি নারী, অল্পবয়সী, বাবা-মা হারা, মফস্বলের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। গণমানুষের প্রচলিত ধারণা— কম সুবিধাভোগী মানুষের প্রতি দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের নেতিবাচক দৃষ্টি রয়েছে।

পরীমনির প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নিম্ন আদালতের আচরণে এই ধারণা আরও দৃঢ় হওয়ারই কথা। এজন্য সচেতন মানুষ পরীমনির জন্যে ন্যায়বিচার চেয়েছেন। এর মাধ্যমে তারা বিদ্যমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।

আমাদের সমাজ কাঠামো ভীষণভাবে পুরুষতান্ত্রিক তথা, নারীর প্রতি কর্তৃত্ববাদী। পরিবার থেকে প্রশাসনের প্রায় সর্বত্রই দেখা যায় একটি বড় অংশ নারীকে নিয়ন্ত্রণে রাখায় বিশ্বাসী এবং তারা তা চর্চাও করেন। যেমন, পুরুষ সঙ্গী পছন্দ করার বিষয়টি যে নারীর একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার তা আমাদের দেশের অনেকে জানেন না, বুঝেন না বা বুঝলেও মানতে চান না। এটা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। অন্যভাবে বলা যায়, এটা নারীর ওপর আধিপত্যবাদ।

এই কর্তৃত্ববাদী পুরুষের মানসিকতা ও চর্চা হচ্ছে পরীমনির মতো সাধারণ পরিবারের ও অল্পবয়সী চলচ্চিত্র শিল্পীদের তাদের কথা মতো চলতে বাধ্য করা। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে চলচ্চিত্র শিল্পে কোনো কোনো অর্থলগ্নকারী ও তাদের দোসরদের ক্ষমতার দাপট। কারো অন্যায় হস্তক্ষেপ বা চাহিদায় কখনো কোনো শিল্প বিকশিত হতে পারে না।

গত ৫০ বছরে দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা শিল্প হচ্ছে চলচ্চিত্র। শিল্প-সংস্কৃতির এই হতাশাজনক অবস্থা সম্পর্কে অনেকের বক্তব্য— নাটক-সিনেমা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাতে বন্দী। এই সিন্ডিকেট চলচ্চিত্র-নাটকের অনেক নারী শিল্পীকে নানা ফাঁদে ফেলছে বা ফেলার চেষ্টা করে। অনেকে বিষয়টি চেপে যান বা চেপে যেতে বাধ্য হন। পরীমনি তা করেননি। তিনি মৃত্যুভয়ে ভীত হলেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করেছেন।

দেশের শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনে সম্ভবত পরীমনি প্রথম নারী যিনি ক্ষমতাবান আধিপত্যবাদী এক পুরুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও নিজের অস্তিত্বের জন্যে তার এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক।

ঘটনার শুরু বোট ক্লাবে। পরীমনির অভিযোগ রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী নাসির মাহমুদ তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছিল। এতে তার অহমে যথেষ্ট ধাক্কা লাগে। ক্লাব সংস্কৃতির উচ্চবিত্তদের আঁতেও ঘা লাগে। সাধারণ জনগণের ধারণা পরীমনি বোট ক্লাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। যেমন— ঘটনার খণ্ডিত ভিডিও প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও মিডিয়াতে পরীমনির চরিত্র নিয়ে কুৎসা রটানো হয়েছে এবং তাকে দোষী প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। এরপর দেখা গেছে তার প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নিম্ন আদালতের অন্যায় আচরণ।

এসব হয়তো মূল অভিযোগ আড়ালের অপচেষ্টা ছিল। বলা বাহুল্য, আসল অভিযোগ অন্য খাতে নেওয়ার মূলে ছিল অভিযুক্তদের ক্ষমতার দাপট ও প্রশাসনের দুর্বল ব্যবস্থাপনা। এই গোষ্ঠী দিনে দিনে যেন পুরো ব্যবস্থাকে গ্রাস করছে যা নারীর প্রতি পুরুষের আধিপত্যকে আরও পোক্ত করছে। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ গুলশানে কলেজছাত্রীর মরদেহ উদ্ধার।

পরীমনিও নিজের জীবন শঙ্কায় ভীত হয়েছিলেন। তবে তিনি ঘটনাটি মিডিয়াকে জানানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। তার দ্বিতীয় বৈপ্লবিক কাজটি ছিল বাড়ির দরজায় অবস্থারত পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করা। তিনি বিচলিত হয়েছেন কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে লাইভ ভিডিওতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সাহায্য চেয়েছেন এবং তার অসহায়ত্ব-উদ্বেগ ভক্তদের সঙ্গে শেয়ার করেছেন।

আদালত প্রাঙ্গণে চিৎকার করে আশেপাশের সবাইকে জানিয়েছেন তিনি কোনো অন্যায় করেননি এবং তাকে ফাঁসানো হয়েছে। গ্রেপ্তার থেকে শুরু করে জামিন পর্যন্ত সব সময় তাকে আত্মবিশ্বাসী দেখা গেছে।

কারাগার থেকে ফিরেও দাবি করেছেন তিনি কোনো অন্যায় করেননি। একটা পুরো ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এমন আত্মবিশ্বাসী থাকা পরীমনির দৃঢ় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকেই প্রমাণ করে। এছাড়া, এ ঘটনায় নারীর মর্যাদা, সব নাগরিকের সমান অধিকার ও সুশাসনের বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে যা গুরুত্বপূর্ণ।

যেমন, ইতোমধ্যে পরীমনির অভিযোগের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা জোরদার হয়েছে। পুলিশের অভিযোগপত্র অনুযায়ী বোট ক্লাবে পরীমনি মারধর ও শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছিলেন। 

ঘটনা যাই হোক নাসির মাহমুদের দায়িত্ব পরীমনির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত করা। পরীমনি বার বার বলে আসছেন সেদিন বোট ক্লাবের সিসিটিভির পুরো ভিডিও প্রকাশ করতে। কিন্তু, তা এখনো অপ্রকাশিত। নারী অধিকারে বিশ্বাসী সবার উচিত পরীমনিকে 'ধর্ষণের চেষ্টা'র অভিযোগের বিচার নিশ্চিত করা। অন্য নারী শিল্পীদের স্বস্তির জন্যে ও নিরাপদ কর্ম পরিবেশের জন্যেই এই বিচার জরুরি। বিশাল পুলিশ বহর পরিবেষ্টিত পরীমনিকে হেনস্থায় জনগণের করের কত অর্থ খরচ হয়েছে তা সরকারের প্রকাশ করা উচিত। পাশাপাশি দেশের আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে অপব্যবহারকারী ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা উচিত।

এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহিতার প্রক্রিয়ায় আনার জন্যে উচ্চ-আদালতকে ধন্যবাদ। এটা সুশাসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই উদ্যোগে উচ্চ-আদালতের প্রতি সর্বসাধারণের আস্থা দৃঢ়তর হয়েছে বলে মনে করি। পরীমনিসহ সব নারী, সর্বসাধারণের সুরক্ষার জন্যে এই ভরসার জায়গা থাকাটা খুব জরুরি।

ড. সীনা আকন্দ: লন্ডনের স্থানীয় সরকারে বিহেভিয়ার ম্যানেজমেন্ট ও প্যারেন্টিং এডুকেটর হিসেবে কর্মরত

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Over 60pc voter turnout in first phase

No major incident of violence reported; Modi expected to win rare third term

50m ago