নির্বাচন কমিশন আইন: কেন এতো তাড়াহুড়ো, স্বচ্ছতা কই?

করোনায় যখন দেশের রাজনৈতিক কার্যক্রম একপ্রকার স্থবির, তখন নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে রাজনৈতিকদলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপের উদ্যোগ ঘুমিয়ে পড়া রাজনীতিকে একটু হলেও চাঙ্গা করেছে। রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধিত ২৫টি রাজনৈতিক দল সংলাপে অংশ নেয়। তবে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ ৭টি দল যোগ না দেওয়ায় সংলাপের সফলতা একপ্রকার অনিশ্চয়তার মুখে।
অলংকরণ: আনোয়ার সোহেল

করোনায় যখন দেশের রাজনৈতিক কার্যক্রম একপ্রকার স্থবির, তখন নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে রাজনৈতিকদলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপের উদ্যোগ ঘুমিয়ে পড়া রাজনীতিকে একটু হলেও চাঙ্গা করেছে। রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধিত ২৫টি রাজনৈতিক দল সংলাপে অংশ নেয়। তবে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ ৭টি দল যোগ না দেওয়ায় সংলাপের সফলতা একপ্রকার অনিশ্চয়তার মুখে।

এরইমধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গন আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলো নির্বাচন কমিশনের গঠনের খসড়া আইন যখন মন্ত্রীসভার বৈঠকে পাস হলো। কাকতালীয়ভাবে সেদিনই ছিল রাষ্ট্রপতির ডাকা সংলাপের শেষ দিন (১৭ জানুয়ারি)। শেষ দল হিসেবে সেদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অংশ নেয় সংলাপে। ততক্ষণে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লো যে, চলমান জাতীয় সংসদ অধিবেশনেই পাস হতে যাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত নির্বাচন কমিশন গঠন আইন।

স্বভাবতই সরকার সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য যে, দীর্ঘ ৫০ বছর পর এসে সরকার এই আইন তৈরির উদ্যোগ নিলো। কিন্তু হলো উল্টো। সাধুবাদের বদলে শুরু হলো সমালোচনা।

কেন এই সমালোচনা? কেন সাধুবাদ নয়?

প্রথমত, এই আইনের খসড়া তো আর একদিনে বা রাতারাতি তৈরি হয়নি। তবে কেন এই লুকোচুরি? আইনের খসড়া যদি তৈরি করাই থাকে তবে রাষ্ট্রপতি সংলাপ করলেন কেন? আর এই সংলাপের মানেই বা কী দাঁড়ালো? বরং রাষ্ট্রপতি যদি এই আইনের খসড়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতেন তবে সংলাপ আরও অনেক বেশি অর্থবহ হতো। রাষ্ট্রপতির সংলাপের শেষেই আইনের খসড়াটি সংসদে তোলা হলো। তাহলে কি রাষ্ট্রপতির সংলাপের উদ্যোগ ব্যর্থ হচ্ছে জেনেই সরকারের এই উদ্যোগ?

দ্বিতীয়ত, কেন এতো তাড়াহুড়ো?

সংসদে কার্যত শক্তিশালী কোনো বিরোধীদল নেই। বিএনপির কয়েকজন সংসদ সদস্য থাকলেও যখনই এই বিল পাসের জন্য সংসদে উঠবে, কণ্ঠ ভোটে তখনই পাস হয়ে যাবে। তাই সংসদে কিছু আলোচনা হলেও তা আসলে হালে পানি পাবে না। কারণ আইন পাস করতে কোনো ম্যাজিক লাগে না, লাগে সংসদ সদস্যদের অধিকাংশের রায়। সেখানে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল সর্বেসর্বা। একচেটিয়া আধিপত্য নিয়ে সংসদে রয়েছে আওয়ামী লীগ।

তারচেয়েও বড় কথা, এই আইন পাসের মাধ্যমে যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে, সেই নির্বাচন কমিশনের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচন। তাই সরকারের কাছে নির্বাচন কমিশনে কারা আসবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু বর্তমান সরকারের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত রাকিব ও হুদা কমিশন ব্যাপকভাবে সমালোচিত। তবে নতুন আইন পাস হলে সরকার বলতে পারবে যে, আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। তার ওপর যেহেতু রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে মোটামুটি সব রাজনৈতিক দলই আইন প্রণয়নের কথা বলেছে, তাই সরকার আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বলতে পারবে অধিকাংশ রাজনৈতিকদলগুলোর দাবি মেনেই আইন করা হয়েছে।

তৃতীয়ত ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- স্বচ্ছতা।

যে সার্চ কমিটি গঠিত হবে, সেখানে কি নিরপেক্ষ লোকজন নিয়োগ পাবে? আওয়ামী লীগ সরকার টানা ৩ মেয়াদে ক্ষমতায় এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব পদেই আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল লোকেরা আছেন। তাই যারা সার্চ কমিটিতে নিয়োগ পাবেন তারা মোটামুটি আওয়ামী ভাবাপন্ন হবেন এটা বলাই যায়। তারপর সেই সার্চ কমিটি কাদের নাম প্রস্তাব করবে, তা কেউ জানতে পারবে না। যেহেতু কেউ জানতে পারবে না, তাই কাদের মধ্যে থেকে কাকে নিয়োগ দেওয়া হলো, তা নিয়ে জনগণ অন্ধকারেই থেকে যাবে। তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো- যেহেতু রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া শুধু দুটি নিয়োগ দিতে পারেন, যেটি হলো- প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিতে হলেও রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। আর মূল সমস্যা কিন্তু এখানেই।

এতো কিছুর পরও যে কথা থেকে যায় তা হলো নির্বাচন। বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচন প্রিয়। একইসঙ্গে বাংলাদেশে সবচেয়ে বিতর্কিত ও বিরোধের বিষয়ও হলো নির্বাচন। বাংলাদেশ এখন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে, কিন্তু তার আগেই বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, দলীয় সরকারের অধীনে সার্চ কমিটি প্রণীত নির্বাচন কমিশন দ্বারা অনুষ্ঠিত নির্বাচন। অভিজ্ঞতার ঝুলি যেমন সমৃদ্ধ, তেমনি তিক্ততার পাল্লাও ভারী। বাকি শুধু একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু, সুন্দর ও অবাধ নির্বাচন।

সরকার আইন করতেই পারে এবং তা নিয়মতান্ত্রিকভাবেই হবে, কিন্তু কতোটা গ্রহণযোগ্য হবে তা ভবিষ্যতই বলবে। তবে যে আইনের জন্য বাংলাদেশের মানুষ তীর্থের কাকের মতো দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে অপেক্ষা করেছে, সেই আইন তাড়াহুড়ো করে সংসদে পাস করে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করলে তা কি জনকল্যাণে কোনো কাজে আসবে? নাকি নতুন বিতর্কের জন্ম দেবে, বাড়াবে তিক্ততা ও রাজনৈতিক বিভক্তি?

সরকার বলতেই পারে- আইন চেয়েছিলেন, দিলাম আইন। কিন্তু এই আইন কি রাজনৈতিক দল ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম?

Comments

The Daily Star  | English

Cuet students suspend protests

Say authorities assured them of meeting their major demands

3h ago