চা-শ্রমিকদের জন্যে উদ্ভট মজুরি কাঠামোর বিশ্লেষণ

ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গত ১৩ জুন এক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে চা-বাগানের শ্রমিকদের জন্যে খসড়া মজুরি কাঠামো ঘোষণা করেছে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে গঠিত হয়েছে মজুরি বোর্ড। চা-বাগানে সাপ্তাহিক ও মাসিক মজুরির ভিত্তিতে শ্রমিক রয়েছে। দৈনিক ভিত্তিতে যারা কাজ করে, তাদের মজুরি নিয়ে নানা বিতর্ক আছে।
চা-পাতা সংগ্রহে যাচ্ছেন নারী শ্রমিকেরা। ছবি: ফিলিপ গাইন

ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গত ১৩ জুন এক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে চা-বাগানের শ্রমিকদের জন্যে খসড়া মজুরি কাঠামো ঘোষণা করেছে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে গঠিত হয়েছে মজুরি বোর্ড। চা-বাগানে সাপ্তাহিক ও মাসিক মজুরির ভিত্তিতে শ্রমিক রয়েছে। দৈনিক ভিত্তিতে যারা কাজ করে, তাদের মজুরি নিয়ে নানা বিতর্ক আছে।

মজুরি বোর্ডের প্রধান একজন জ্যেষ্ঠ জেলা জজ। তিনি চলতি বছরের ২১ এপ্রিল দায়িত্ব নিয়েছেন। এবার মজুরি বোর্ড ‘এ’ শ্রেণির বাগানের জন্যে একজন চা-শ্রমিকের মজুরি ১২০ টাকা নির্ধারণ করেছে। ‘বি’ শ্রেণির বাগানের জন্যে মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৮ টাকা। আর ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সি’ শ্রেণির বাগানের জন্যে। (একটি বাগানের উৎপাদন ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে সেগুলোর শ্রেণি নির্ধারণ করা হয়। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত শ্রমিকের মজুরি একই রকম)।

ঘোষিত এই খসড়া মজুরি কাঠামো চা-শ্রমিকদের হতাশ করেছে। কারণ, মজুরি বোর্ড ঘোষিত মজুরি চা-শ্রমিকেরা এখনই পান। ২০১৯-২০ সময়ের জন্যে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও চা-বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চুক্তির ওপর ভিত্তি করেই সেই মজুরি তারা এখন পান। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন এক লাখ ৩৮ হাজার ৩৬৪ জন শ্রমিকের সংগঠন। এ বাগানগুলো ছড়িয়ে আছে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জায়গায়। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন চা-শ্রমিকদের একমাত্র ট্রেড ইউনিয়ন। এর কেন্দ্রীয় কার্যালয় মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে। এই কার্যালয়টি লেবার হাউস নামে পরিচিত। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও বিটিএ প্রতি দুই বছর অন্তর মজুরির জন্যে চুক্তি সই করে। আর প্রতিবারই দেখা যায়, চা-শ্রমিকদের মজুরি সামান্য কিছু করে হলেও বাড়ে। ২০১৯-২০ মেয়াদে চুক্তির ফলে এখন চা-শ্রমিকরা যে ১২০ টাকা পাচ্ছেন, তাও এই চুক্তির ফসল। এর আগে ২০১৭-১৮ সালের জন্যে চুক্তি অনুযায়ী একজন শ্রমিক ১০২ টাকা দৈনিক নগদ মজুরি পেতেন।

২০১৯-২০ সালের চুক্তির মেয়াদ ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়ে যায়। প্রথা অনুযায়ী, বিটিএ ও বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন আবার নতুন করে চুক্তি করার কথা ছিল। সেই চুক্তি ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। আর এবার অন্তত আরও ২০ টাকা মজুরি বাড়তে পারত। কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড ছয় মাস আগে শেষ হয়ে যাওয়া চুক্তিতে থাকা মজুরির মতোই নতুন মজুরি প্রস্তাব করল।

গত ১৩ জুন প্রকাশিত গেজেটের দিকে নজর দিলে দেখা যাচ্ছে, সেখানে শ্রমিক ও চা-বাগানের তিন হাজার কর্মচারীর জন্যে জুরি বোর্ড যে কাঠামো প্রস্তাব করেছে, তা মোটেও বাস্তবানুগ নয়। তাদের ঘোষিত এই মজুরি কাঠামো শ্রমিক-বান্ধবও নয়। অনেকেই মনে করেন, মজুরি বোর্ড তার কর্ম পরিধির বাইরে গিয়ে কিছু কিছু জায়গায় অযাচিত হস্তক্ষেপ করেছে।

এখন প্রশ্ন হলো, এখনকার সময়ে ১২০ টাকা মজুরি কতটুকু ন্যায্য? এটা ঠিক যে এই মজুরির বাইরেও একজন চা-শ্রমিক স্বল্পমূল্যে চাল বা আটা পান। প্রতি সপ্তাহে একজন চা-শ্রমিক বা তার পরিবারের সদস্য গড়ে সাত থেকে আট কেজি চাল অথবা আটা পায়। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের হিসাব অনুযায়ী, মজুরির পাশাপাশি এসব সুবিধাসহ একজন চা-শ্রমিক প্রতিদিন ২০০ টাকার সমপরিমাণ মজুরি পান। অর্থাৎ মাসে পান ছয় হাজার টাকা। তবে, চা-বাগান মালিকদের ধারণা এর উল্টো। তারা চা-শ্রমিকদের দেওয়া অন্যান্য সুবিধাকে অর্থের মূল্য বিচার করে একটা হিসাব দেয়। বাংলাদেশ চা-বোর্ডের লেবার, হেলথ ও ওয়েলফেয়ার সাব-কমিটির আহ্বায়ক তাহসিন আহমেদ চৌধুরী গত ২১ মে সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (শেড) আয়োজিত এক সংলাপে বলেন, ‘একজন চা-শ্রমিক সাকুল্যে ৪০৩ টাকার সমপরিমাণ অর্থ প্রতিদিন পান।’

স্বল্পমূল্যে রেশনের পাশাপাশি চা-বাগান মালিকেরা ঘর ভাড়া, চা-পাতা তোলার বিভিন্ন সরঞ্জাম, অতিরিক্ত সময়ের মজুরি, প্রভিডেন্ট ফান্ডে মালিকদের অনুদান, চিকিৎসা ব্যয়, পেনশন, চা-শ্রমিকদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্যে ব্যয়, শ্রমিক কল্যাণ কর্মসূচির ব্যয়, এমনকি সরকারের কাছে থেকে চা-বাগানের জন্যে লিজ নেওয়া জায়গায় চা-শ্রমিকরা শাকসবজি, ফলমূলের চাষ কিংবা শ্রমিকদের গরু-বাছুর চড়ানোর যে কাজ করেন, সেগুলোকেও এই ৪০৩ টাকার মধ্যে ধরেছেন। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বলেন, ‘এই হিসাব উদ্ভট ও খুবই হতাশাজনক। আমরা এই ধরনের হিসাব প্রত্যাখ্যান করি।’

বাংলাদেশের শ্রম আইনের দুই নম্বর ধারার ৪৫ নম্বর উপধারা অনুযায়ী, বাসস্থান, আলো, পানি, চিকিৎসা ও অন্যান্য সুবিধা যা কিনা সরকার বিশেষ বা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে দিয়ে থাকেন, সেগুলো শ্রমিকের মজুরের ভেতরে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। সেই অনুযায়ী, এমনকি পেনশন ও প্রভিডেন্ট ফান্ডে মালিকের অনুদানকেও এর মধ্যে ধরা যাবে না।

চা-বাগানের মালিকেরা যদি শ্রম আইন ও শ্রম বিধিমালা মেনে চলেন, তবে শ্রমিকদের মজুরি থেকে এইসব সুবিধার বিষয়গুলোকে বাদ দিতে হবে। আর যদি তা করা হয়, তখন তারা শ্রমিকের দিনপ্রতি মজুরির যে হিসাব দেন, তা চা শ্রমিক ইউনিয়নের দেওয়া হিসাব অর্থাৎ সবমিলিয়ে ২০০ টাকার চেয়ে বেশি হবে না। চা-শ্রমিক ও চা-শিল্পের উন্নতির স্বার্থেই বাগান মালিকদের অনেক বেশি যৌক্তিক হতে হবে তাদের হিসাবের বিষয়ে।

ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের আরও বেশ কিছু সিদ্ধান্ত চা-শ্রমিকদের হতাশ করেছে। যেমন: প্রথাগতভাবে চা-শ্রমিক ও মালিকেরা প্রতি দুই বছর পর পর মজুরি বাড়ানোর বিষয়ে চুক্তি সই করত। আর তাতে সামান্য পরিমাণে হলেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়ত। কোনোরূপ যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই ন্যূনতম মজুরি বোর্ড এই মেয়াদ তিন বছর পরপর করার জন্যে প্রস্তাব করেছে। এই প্রস্তাব যদি মেনে নেওয়া হয়, তবে তা খুবই অল্প পরিমাণ মজুরি পাওয়া চা-শ্রমিকদের জন্যে একটা বিরাট ক্ষতির কারণ হবে।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও ছয় সদস্যের মজুরি বোর্ডে ইউনিয়নের প্রতিনিধি রাম ভজন কৈরি বলেন, ‘মজুরি বোর্ডের এই সিদ্ধান্ত একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। আমরা এর সংশোধন চাই। মজুরির বিষয়ে প্রতি দুই বছর পর পর আলোচনার যে প্রথা আছে, সেটি অবশ্যই রাখতে হবে।’

চা-বাগানে একজন শ্রমিক মারা গেলে বা অবসর নিলে তার পরিবারের একজন সদস্য বা আত্মীয় সরাসরি ওই শূন্য পদে নিয়োগ পান। ন্যূনতম মজুরি বোর্ড এই নিয়োগের বিষয়টি শুধু চা-শ্রমিকের ছেলে বা মেয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। মজুরি কাঠামোতে দুঃখজনকভাবে শ্রমিকের প্রবেশন পিরিয়ডের সময় ছয় মাস পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রবেশন পিরিয়ডে শ্রমিকের দৈনিক মজুরি হবে ১১০ টাকা এবং মাসিক মজুরি প্রাপ্তদের মজুরি ছয় হাজার টাকা। প্রবেশন পিরিয়ডে থাকা শ্রমিকেরা সফলভাবে তাদের কাজ সম্পন্ন করার পরই গ্রেড অনুযায়ী স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পাবে। চা শ্রমিক ইউনিয়ন মজুরি কাঠামোর এই ধারাটি বাতিলের দাবি করেছে। কারণ, এটি তাদের প্রথা (দস্তুর) বিরোধী। বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালার পঞ্চম তফসিলের নয় নম্বর অধ্যায়ে বলা আছে, চা-বাগানে দীর্ঘদিনের প্রথা এবং সুযোগ-সুবিধা কার্যকর রাখতে হবে। তাই মজুরি কাঠামোতে প্রবেশন পিরিয়ড নিয়ে যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা শ্রম বিধিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

ন্যূনতম মজুরি বোর্ড পেনশন ও গ্রাচুইটির বিষয়ে চা-বাগান মালিকদের অবস্থানকে অন্ধভাবে সমর্থন করেছে। চা-শ্রমিকদের সাপ্তাহিক পেনশনের পরিমাণ ২০০৮ সালে ছিল ২০ টাকা এবং ২০২০ সালে এটি ১৫০ টাকা হয়। চা-বাগান মালিকেরা ২০১৭-১৮ সালে চা শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে তাদের চুক্তির সময় প্রথমবারের মতো শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের গ্রাচুইটি দিতে রাজি হয়। কিন্তু, চা-শ্রমিকরা এটি আর কখনই পাইনি। মালিকেরা তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। গ্রাচুইটির কথা ভুলে গিয়ে মালিকেরা এখন চলমান পেনশন, অর্থাৎ সপ্তাহে ১৫০ টাকা নিয়ে শ্রমিকদেরকে সন্তুষ্ট থাকতে বলছেন। আর এক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড মালিকদের পক্ষ নিয়েছে। তবে, চা-শ্রমিকরা তাদের গ্রাচুইটি পাওয়ার দাবি থেকে সরে আসেনি।

যতক্ষণ পর্যন্ত পেনশন দেওয়ার বিধান থাকবে, ততক্ষণ মালিকদেরকে শ্রম আইন মেনে চলতে হবে। মালিকরা যে দাবি করেন, অর্থাৎ চা-শ্রমিকদের তারা প্রতিদিন ৪০৩ টাকা করে দেন, তা যদি সত্যি বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে প্রতি মাসে একজন শ্রমিকের পেনশনের পরিমাণ কত দাঁড়ায়? এখন চা-শ্রমিকরা প্রতিদিন যে মজুরি পান, অনেকেই সেটিকে তাদের মূল মজুরি বলে গণ্য করেন। তা যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে একজন অবসর নেওয়া শ্রমিকের প্রতিমাসে পেনশন হিসেবে তিন হাজার ছয় শ টাকা (১২০ টাকা করে ৩০ দিন হিসাবে) পাওয়া উচিত এবং তা কখনই ছয় শ টাকা নয় (সপ্তাহে ১৫০ টাকা করে ৪ সপ্তাহ ধরে)।

চা-শ্রমিকরা এখন যে দুটো উৎসব ভাতা পান, সেই সামান্য উৎসব ভাতাও কমানোর সুপারিশ করেছে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড। এর কোনো যৌক্তিকতা নেই। মজুরি বোর্ডের উচিত এখন শ্রমিকেরা যে উৎসব ভাতা পান, তা ঠিক রাখার, নয়তো উৎসব ভাতার পরিমাণ বাড়ানো। এমনিভাবে মজুরি বোর্ড চা বিক্রির দশমিক ৩০ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণে ব্যয় করার যে প্রস্তাব দিয়েছে, সেটি করাও তাদের উচিত হয়নি। মজুরি বোর্ড শ্রম আইন অনুসারে মালিকদেরকে নিট মুনাফার পাঁচ শতাংশ শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয়ের প্রস্তাব করতে পারত। মালিকেরা কোনোদিনই তাদের নিট মুনাফার পাঁচ শতাংশ শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় করেনি। এটাও শ্রম আইনের একটা বড় লঙ্ঘন।

শ্রম আইন ও শ্রম বিধিমালা ইতোমধ্যে যেসব সুবিধা নিশ্চিত করেছে, ন্যূনতম মজুরি বোর্ড অকারণে সেসব গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করেছে। পক্ষান্তরে শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা পেনশন ও গ্রাচুইটির অধিকার খর্ব করার সুপারিশ করেছে।

এগোনোর পথ

নতুন মজুরি কাঠামোর খসড়া তৈরি করে সর্বসাধারণের পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়ার জন্যে ১৪ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়। বেঁধে দেওয়া সেই সময়সীমা শেষ হয়েছে গত ২৬ জুন। এই মজুরি কাঠামোর অন্যতম পক্ষ বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন তাদের অভিযোগ ও সুপারিশগুলো পাঠিয়েছে। সেখানে দৈনিক নগদ মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি সংগঠন ও ব্যক্তি তাদের পর্যবেক্ষণ মতামত ও পরামর্শ পাঠিয়েছেন। ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গত ২৭ জুন মজুরি কাঠামো চূড়ান্ত করতে একটি বৈঠক ডেকেছিল। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাম ভজন কৈরি ওই সভায় যোগ দেননি। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, ‘ন্যূনতম মজুরি বোর্ড আমাদের একটি দাবিও মানেনি। আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে, ন্যূনতম মজুরি বোর্ড আমাদের কোনো দাবি মানবে না।’

গত ২৭ জুনের সভায় কী হলো, তা নিয়ে ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। তবে, একটি সূত্র জানাচ্ছে, খসড়া মজুরি কাঠামোতে কোনোরূপ পরিবর্তন আনা হয়নি। আর তারা এই খসড়া সুপারিশ শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়ে গত ২৮ অথবা ২৯ জুন পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয় ৪৫ দিনের মধ্যে তাদের সুপারিশসহ এই কাঠামোটি আবার ফেরত পাঠাতে পারেন, যদি তারা মনে করেন যে এই মজুরি যথাযথ হয়নি। পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ হলে এবং প্রস্তাবিত মজুরি চূড়ান্ত হলে সরকার এটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার মধ্যেই নতুন করে মজুরি বোর্ড গঠন করতে পারে। এক্ষেত্রে সরকার প্রস্তাবিত মজুরি কাঠামোকে বাদ দিয়ে মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এর সংশোধন বা পরিবর্তন করতে পারে।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন দর কষাকষির ক্ষেত্রে খুবই দুর্বল একটি পক্ষ। বাংলাদেশের চা-শ্রমিকেরা প্রায় সবাই অবাঙালি, নিম্নবর্ণের হিন্দু ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর। মূল ধারার জনগোষ্ঠীর থেকে তারা অনেক পিছিয়ে ও বিচ্ছিন্ন। তবে, মজুরি বাড়ানোর ক্ষেত্রে এখনো দ্বার উন্মুক্ত আছে। তাদের আরও সংগঠিত হতে হবে এবং সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

চা-শ্রমিকদের নিয়ে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘চা-শ্রমিকরা চা-বাগানের গণ্ডির ভেতরে বন্দি। তাদের সামগ্রিক অবস্থা খুবই করুণ এবং তারা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী। চা-বাগানের উৎপাদন বাড়ুক, এটা সবাই চায়। কিন্তু, এখানে লাভ-ক্ষতির হিসাবটা এমনভাবে করা উচিত, যেন শ্রমিকেরা তাদের মালিকের সঙ্গে ন্যায্য অধিকার এবং সুবিধা নিয়ে দর কষাকষি করতে পারে।’

চা-শ্রমিকরা আসলে কতটুকু মজুরি পাচ্ছে, তা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার জন্যে অর্থনীতিবিদদের এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর মাধ্যমে একটি ন্যায্য মূল্যায়ন আসতে পারে। বিশেষজ্ঞরা চা-শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্যে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়টিও গুরুত্বসহকারে বিবেচনার দাবি করেন।

মালিকেরা শ্রমিকদের যে মজুরি দেন বলে দাবি করেন, সেটা তাদের একপেশে হিসাব। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন সাংগঠনিকভাবে মালিকদের এই হিসাবকে ও তথ্য-উপাত্তকে কখনো চ্যালেঞ্জ করেনি। তাই চা-শ্রমিকদের জীবন ধারণের জন্যে কতটুকু মজুরি যুক্তিযুক্ত, তা নির্ধারণ করতে নিরপেক্ষ অর্থনীতিবিদ ও গবেষকদের এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার কোনো বিকল্প নেই। চা-শ্রমিকদের শোভন জীবনযাপনের জন্যে একটি সঠিক মজুরি কাঠামো দেওয়া এখন সময়ের দাবি।

ফিলিপ গাইন, গবেষক ও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (শেড) পরিচালক

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Rana Plaza Tragedy: Trade union scenario in garment sector of Bangladesh

Trade unions surge, but workers' rights still unprotected

Although there has been a fivefold increase in number of unions in 11 years since the country's deadliest industrial incident, most are failing to live up to expectations

4h ago