কিনে আনা স্কুল বেঞ্চ ও মাটিকাটা শ্রমিক প্রধান শিক্ষকের গল্প

মাঝেমাঝে জীবনের গল্পগুলো এত কষ্টকর হয়ে ওঠে যে দম বন্ধ হয়ে আসে। স্কুল শিক্ষিকা মায়িশা ফারাহের জীবনের গল্প ঠিক এমনই। অনেক কষ্ট করে যখন তিনি আর তার স্বামী কিছুটা সচ্ছলতার মুখ দেখেছিলেন, ঠিক সেইসময় করোনার ধাক্কায় তাদের দুজনেরই আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেল।
প্রতীকি ছবি। ছবি: সংগৃহীত

মাঝেমাঝে জীবনের গল্পগুলো এত কষ্টকর হয়ে ওঠে যে দম বন্ধ হয়ে আসে। স্কুল শিক্ষিকা মায়িশা ফারাহের জীবনের গল্প ঠিক এমনই। অনেক কষ্ট করে যখন তিনি আর তার স্বামী কিছুটা সচ্ছলতার মুখ দেখেছিলেন, ঠিক সেইসময় করোনার ধাক্কায় তাদের দুজনেরই আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেল।

জীবিকা বন্ধ হয়ে গেলেও জীবন থেমে থাকে না, আর পেটের খিদেও মরে যায় না। পরিবারের ক্ষুধার্ত মুখগুলোও সামনে এসে দাঁড়ায়। লজ্জায় কারও কাছে হাত পাততেও পারেননি, চেয়ে খাবারও যোগাড় করতে পারেননি। এরকম এক সময়ে স্বামী করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তারপর সব লজ্জা, সংকোচ বিসর্জন দিয়ে স্কুল শিক্ষিকা মায়িশা আকবরিয়া লিমিটেডে পরিচ্ছন্নতা কর্মীর খাতায় নাম লেখান।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ৫০০ দিন পার হয়েছে গত জুলাই মাসে। এরমধ্যে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে তিন হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল। একদিকে শিক্ষার্থীরা ঘরবন্দি হয়ে হতাশায় ভুগছে, শিখতে পারছে না। অন্যদিকে স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা অর্থনৈতিক দুর্দশায় মায়িশার মতোই দিশেহারা।

৯ থেকে ১০ মাস আগে অনলাইনে দেখলাম, একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পরিচালক তাদের সব বেঞ্চ, বোর্ড ও অন্যান্য সরঞ্জাম বিক্রি করে দিচ্ছেন। এগুলো বিক্রি করে শিক্ষকদের কিছু পাওনা মেটানোর চেষ্টা করছেন। কারণ এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা সবাই মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। এমনি এমনি বেতন দেওয়ার সক্ষমতা তাদের অভিভাবকের নেই।

সেখান থেকে আমি একটি কাজে দুটি বেঞ্চ কেনার পর দেখলাম, বাচ্চারা সেখানে ছবি এঁকে রেখেছে, নাম লিখেছে, ছড়া লিখেছে। আহারে ওদের প্রিয় বসার টেবিল আজ আমার কাছে। কী দুঃখজনক অনুভূতি। করোনা এসে কী অদ্ভুত জীবন উপহার দিয়েছে আমাদের। অভাব, দুঃখ, অশিক্ষা, বাল্যবিয়ে, সামাজিক অস্থিরতা, হতাশা, পারিবারিক সহিংসতা, দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা এবং সর্বোপরি হঠাৎ মৃত্যু।

শুধু কী মায়িশাই শিক্ষক থেকে পরিচ্ছন্নতা কর্মী হলেন? না। শিক্ষক থেকে মাটিকাটা শ্রমিক হয়েছেন আরও কয়েকজন শিক্ষক। দেড় বছর ধরে বেতন বন্ধ উলিপুরের দই খাওয়ার চর নিম্ন মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ে (নন এমপিও)। এই বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম পেটের জ্বালা মেটাতে নাম লিখিয়েছিলেন সরকারের কর্মসৃজন প্রকল্পে মাটিকাটা শ্রমিক হিসেবে। মানসম্মান সব ভুলে তিনিসহ তার স্কুলের পাঁচ জন শিক্ষক ৮০ দিন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তায় মাটি কাটার কাজ করেছেন। কারণ খিদার জ্বালা বড় জ্বালা।

কিন্তু এতকিছু করেও কী তারা পেরেছেন শ্রমের পুরো টাকাটি ঘরে নিতে? না, পারেননি। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে চার হাজার টাকা করে কেটে নিয়েছে চেয়ারম্যানের ক্যাডার বাহিনী। অনেক মিনতি করেছেন, অন্তত দুই হাজার টাকা করে কম নেন। কিন্তু শোনেনি। নিরুপায় এই শিক্ষক অভিযোগ করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য  ও কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসকের কাছে। প্রধান শিক্ষক কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, 'আমরা এখন ভয় পাচ্ছি। কারণ ওরা আমাদের ক্ষতি করতে পারে। নিপীড়িত মানুষ হিসেবে আমরা সুবিচার পাবো কি?'

ভাবলে অবাক লাগে, এত অভাব, অনটন, দুর্যোগ, মৃত্যুর মিছিলেও মানুষ আজও অমানুষই রয়ে গেল। খেটে খাওয়া মানুষের দুটি টাকা থেকে এক টাকার ভাগ তাদের নিতেই হবে। দরিদ্র মানুষের হক মেরে খেতেই হবে।

শিক্ষাখাতে যে ধাক্কাটি লেগেছে, এর আঘাত খুব তীব্র হতে বাধ্য। আমরা সবাই আশংকা করছি, কিন্তু প্রকৃত মূল্য এর চেয়ে অনেক বেশি। শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাস, বাড়ির কাজ সিস্টেম, কোনোটিই খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি।

সিলেবাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তৈরি বাড়ির কাজগুলো বিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানো হলেও শিক্ষার্থীরা পড়বে কীভাবে? কে তাদের পড়া বোঝাবে? হঠাৎ মাঝখান থেকে একটা, দুইটা পরিচ্ছেদ পড়েই বা কী হবে?

পড়াশোনার মতো মানুষ গঠনের হাতিয়ার কখনো আধাআধিভাবে হয় না। স্কুল-কলেজ বন্ধ, পড়া হয়নি, ক্লাস হয়নি, এ কথা বলে আমরা একবার অটোপাসের ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু বারবার তো এই পদ্ধতি চলতে পারে না। তাহলে কী হবে? সারা দেশের এতগুলো শিক্ষার্থী কী অনলাইনে পরীক্ষায় বসতে পারবে? সেই সাপোর্ট কি ডিজিটাল বাংলাদেশের আছে? আর পড়া না হলে বাচ্চাগুলো কিসের ওপর ভিত্তি করে পরীক্ষা দেবে? জানি না, খুব হতাশ লাগছে।

অনেকে বলছেন, টিকা গ্রহণকারীদের জন্য নির্ধারিত বয়সের বাধা উঠিয়ে দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়ে বিদ্যালয়ে পাঠানো যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। কিন্তু স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কী হবে? স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের আর্থিক দুর্দশার সমাধান কী? মহামারি যতদিন চলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও কি ততদিন বন্ধ থাকবে?

প্রাক প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বাংলাদেশে পৌনে ছয় কোটি শিক্ষার্থী। এত শিক্ষার্থীকে সহসা কি আমরা টিকা দিতে পারবো? গ্রামেগঞ্জে কি এত সহজে টিকা পাঠানো ও বাচ্চাকে টিকা দেওয়ানোর ব্যাপারটা মানুষকে বোঝানো সহজ হবে? প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। এগুলো নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনা দেখছি না।

দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য সরকারসহ নানা মহলে বিভিন্ন উদ্যোগ চোখে পড়ছে। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা আনয়নকারী পোশাক শিল্পকে বাঁচানোর জন্য পুরো করোনাকাল প্রণোদনা ভাতা দিয়েই গেল সরকার। বারবার খবর প্রকাশিত হচ্ছে, এত বিপর্যয়ের মধ্যেও আমাদের রেমিটেন্স বাড়ছে। যদিও যেসব রেমিটেন্স যোদ্ধারা দেশে ফিরে এসেছেন, তাদের অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে কিছু দাবি আদায়ে। কৃষিখাত এই করোনাকালে একমাত্র নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দেশের মানুষের অন্নের ব্যবস্থা করেছে।

শুধু যে অভাব-অনটনই বেড়েছে করোনাকালে, তা নয়। বেড়েছে কোটিপতির সংখ্যাও। দেশের অর্থ বিদেশে পাচারের হারও বেড়েছে। এক শ্রেণীর মানুষ এর মধ্যেও ব্যবসা করে লাভবান হয়েছে। বিভিন্নখাত নিয়ে সরকার ভাবছে ঠিকই, কিন্তু একটি দেশের মেরুদণ্ড যে শিক্ষাখাত, তাকে নিয়ে তো কারো কোনো মাথাব্যথা দেখছি না। শিক্ষাখাত পুনরুদ্ধারে বাজেটে বড় ধরণের কোনো বরাদ্দও রাখা হয়নি।

শিক্ষকরা যে কাজ হারিয়ে শ্রেণীকক্ষ ছেড়ে পরিচ্ছন্নতা কর্মী বা সবজি বিক্রেতা বা মাটিকাটা শ্রমিক হচ্ছেন, তাতে কী আমাদের কিছু আসে যায় না? কোনো কাজই ছোট নয়। কিন্তু একজন শিক্ষক যখন পেটের দায়ে মাটি কাটেন, তা মেনে নেওয়া যায় না। তিনি এই কাজে অভ্যস্ত নন। এই কাজ ওনার নিজের কাছেও অস্বস্তিকর হওয়ার কথা। এর ওপর আবার সেই কাজেরও মজুরি ছিনিয়ে নিচ্ছে চেয়ারম্যান।

অথচ আমরা স্পষ্ট চোখে দেখতে পারছি, স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়াতে বাক্সপেটরা বেঁধে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, আয়া, দারোয়ান সবাই গ্রামে গিয়ে ভিড় করেছেন। বন্ধ স্কুলগুলোতে শেঁওলা জমতে শুরু করেছে। শান্তি ও মারুফার মতো অসংখ্য মেয়ের ১৩ বা ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কাদের, মঞ্জু ও শিশিরের মতো কিশোররা স্কুল বন্ধ বলে শহরে এসে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ঢুকে গেছে। এরা কি আর কখনও শ্রেণীকক্ষে ফিরে যেতে পারবে? স্কুল চালু হলে এরা কে, কবে, কিভাবে ফিরে আসবে আমরা জানি না।

শুধু যে স্কুলের বাচ্চারা ক্ষতির মুখে পড়ছে, তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা, মাদকের ব্যবহার, মাদক ব্যবসা ও আত্মহত্যার প্রবণতা। প্রত্যেকেই দিন গুনছে ক্লাসে ফিরে আসার জন্য। কিন্তু তাদের মধ্যেও ঝরে পড়বে অনেকে, অনেকভাবে। শিক্ষা ব্যবস্থার এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে অপেক্ষা করতে হবে কয়েক বছর। এর মধ্যে হারিয়ে যাবে অনেক শিশু, কিশোর ও তরুণ।

সরকার কি পারতো না বন্ধ হয়ে যাওয়া কিন্ডারগার্টেনগুলো ও এমপিওভুক্ত নয় এমন স্কুল কলেজের শিক্ষকদের জন্য কিছু প্রণোদনা বরাদ্দ রাখতে? শিক্ষা খাতে কোনও ধরনের সহায়তা বা সমস্যার কথা কেউ খুব একটা বলছেন না কেন? কেন আমরা কোনো একটা উপায় খুঁজে বের করতে পারছি না? জরুরি ভিত্তিতে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য নানা ব্যবস্থা নিতে হবে শিক্ষার সুরক্ষার জন্য। এভাবে শুধু অটোপাসের ওপর বসে থাকা যাবে না।

করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ যতো বাড়বে, ততোই বাড়বে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। প্রায় দুবছর পড়াশোনা বন্ধ থাকা মানে, একটা ভয়াবহ ব্ল্যাকহোল বা শূন্যতা তৈরি হওয়া। যেখানে আমাদের সন্তানরা পড়ে যাচ্ছে, হয়তো তাদের অনেককেই আমরা আর খুঁজে পাব না। জানি না আমার বাসায় অনলাইনে কিনে আনা সেই বেঞ্চটার মতো অন্য কোনো বেঞ্চে বাচ্চারা বসে হৈচৈ করে আর পড়তে পারবে কিনা।

শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

Comments

The Daily Star  | English

Cuet students suspend protests

Say authorities assured them of meeting their major demands

57m ago