ইত্তেফাকের প্রকাশনা ‘প্রথম পাতা ১৯৫৩-১৯৭২’

আমাদের জাতিসত্তা গঠনে 'দৈনিক ইত্তেফাক'-এর অবদানের কথা সর্বজনবিদিত। পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া বিশ্বের এই অঞ্চলের সাংবাদিকতার প্রবাদপুরুষ হিসেবে বিবেচিত। আমরা যারা তার পদাঙ্ক অনুসরণের চেষ্টা করেছি, তাদের জন্য তিনি নিরন্তর অনুপ্রেরণা ও গর্বের উৎস। পত্রিকার একেবারে শুরু থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত দৈনিক ইত্তেফাক পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায্য দাবিগুলো সামনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে কাজ করে গেছে এবং তৎকালীন নেতৃত্বের বৈষম্যমূলক নীতি সবার সামনে উন্মোচন করেছে।
ছবি: স্টার

আমাদের জাতিসত্তা গঠনে 'দৈনিক ইত্তেফাক'-এর অবদানের কথা সর্বজনবিদিত। পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া বিশ্বের এই অঞ্চলের সাংবাদিকতার প্রবাদপুরুষ হিসেবে বিবেচিত। আমরা যারা তার পদাঙ্ক অনুসরণের চেষ্টা করেছি, তাদের জন্য তিনি নিরন্তর অনুপ্রেরণা ও গর্বের উৎস। পত্রিকার একেবারে শুরু থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত দৈনিক ইত্তেফাক পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায্য দাবিগুলো সামনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে কাজ করে গেছে এবং তৎকালীন নেতৃত্বের বৈষম্যমূলক নীতি সবার সামনে উন্মোচন করেছে।

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। ছবি: সংগৃহীত

সংবাদপত্রটি বাংলাদেশের ৫০তম জন্মবার্ষিকীতে একটি স্মারক সংখ্যা প্রকাশ করেছে, যার শিরোনাম 'দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতা ১৯৫৩-১৯৭২।' এই সংখ্যায় দিনক্রম অনুযায়ী পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠাগুলোকে একসঙ্গে সামনে আনা হয়েছে। প্রকারান্তরে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিনগুলোকে পত্রিকার পাতায় নতুন রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো পত্রিকা প্রথমবারের মতো একইসঙ্গে ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান ও বিশেষ করে সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই রসগ্রাহী পাঠ্য উপস্থাপন করেছে। এই উদ্যোগকে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। 

ইতিহাস পড়া এক বিষয়, কিন্তু সেই ইতিহাসকে প্রকাশিত পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার মাধ্যমে, প্রতিদিন উন্মোচিত হতে দেখা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। প্রতিদিনের পত্রিকায় একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর বিশেষ নজর দেওয়া হতো এবং সেদিনের ঘটনা উপস্থাপন করা হতো, কিন্তু কেউ আগে থেকে জানতো না পরের দিনের লেখার বিষয় কী হবে। পরের ঘটনাগুলো আগে থেকে জানা না থাকায় পাঠকের কাছে প্রতিটি প্রথম পাতা একটি বিশেষ অর্থ নিয়ে আসে এবং সে সময়ের ঘটনাগুলোকে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করতে সহায়তা করে। বিষয়টি আরও চিত্তাকর্ষক, কারণ এই সংখ্যায় উল্লেখিত সময়কালে বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা ঘটে। যা মুক্তিযুদ্ধের নেপথ্যের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের চিন্তা-চেতনাকে আরও সমৃদ্ধ করে। 

১৯৪৯ সালের ১৫ আগস্ট মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি ও ইয়ার মোহাম্মদ খানকে প্রকাশক করে প্রত্রিকাটি সাপ্তাহিক আকারে যাত্রা শুরু করে। পর্দার আড়ালে প্রকৃত কর্মী ছিলেন মানিক মিয়া এবং তিনি ১৯৫১ সালের আগস্টে আনুষ্ঠানিকভাবে পত্রিকার দায়িত্ব বুঝে নেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সক্রিয় সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণায় ১৯৫৩ সালে পত্রিকাটিকে দৈনিকে রূপান্তরিত করা হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনকে মাথায় রেখে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বলে জানান, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। যিনি মানিক মিয়ার সন্তান, পত্রিকাটির দীর্ঘদিনের সম্পাদক এবং বর্তমানে ইত্তেফাক গ্রুপ অফ পাবলিকেশন্সের চেয়ারম্যান। তিনি মুখবন্ধে লিখেছেন, 'চার প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব, শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া 'ইত্তেফাকের আদর্শিক ভিত্তি তৈরি করছেন, যার ওপর ভিত্তি করে প্রকাশনা শুরুর প্রথম দিন থেকে পত্রিকাটি পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষীদের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত থেকেছে।   

নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে তার প্রথম এবং একমাত্র সফরে এসে নির্বুদ্ধিতা ও হঠকারিতার সংমিশ্রণে দেশের জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশের মাতৃভাষাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেন এবং ঔদ্ধত্যের সঙ্গে ঘোষণা দেন, 'উর্দু এবং শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।' একটি মৌলিক, প্রাথমিক ও জীবন-মরণের ইস্যুতে এরকম মনোভাব থেকে সহজেই বোঝা যায় দেশের পূর্ব অংশের মানুষের নায্যতাকে প্রাধান্য ও গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে কতটা অবহেলা করা হচ্ছিল। এ কারণে পূর্ব বাংলার (তখনো এ নামেই ডাকা হতো) জনমানুষের কণ্ঠস্বরকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি ছিল। সাপ্তাহিক এবং পরবর্তীতে 'দৈনিক ইত্তেফাক' সাহসিকতা, ধারাবাহিকতা, দায়াবদ্ধতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করেছিল। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, পত্রিকাটি প্রকাশিত ও পরিচালিত হয়েছে সীমিত পূঁজি ও সম্পদ ব্যবহার করে। 

আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিন পর নাম বদলে আওয়ামী লীগ রাখা হয় এবং দলটি খুব অল্প সময়ের মধ্যে  জনপ্রিয়তা অর্জন করে, যার ফলে সাপ্তাহিক পত্রিকাটিকে দৈনিকে রূপান্তর করার বিষয়টি অবশ্যম্ভাবী, একই সঙ্গে খুবই জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। 

১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম সংখ্যা ছিল ৪ পৃষ্ঠার এবং প্রথমেই ছিল আট কলামের একটি সংবাদ। যার শিরোনাম 'গণবিক্ষোভের মুখে মুসলিম লীগের নাভিশ্বাস।' এ ছাড়া, মানুষ কীভাবে নির্বাচনী প্রচারণার সময় মুসলিম লীগ নেতাদের প্রতি দুয়োধ্বনি দিচ্ছিল এবং তাদের উদ্দেশে পচা ডিম ছুড়ে মারছিল সে বিষয়ে একটি খবর এবং কীভাবে মুসলিম লীগের নেতা ও কর্মীরা দলত্যাগ করছেন, সে বিষয়ে আরেকটি প্রতিবেদন ছিল। এই প্রতিবেদনের উৎস ছিল ফরিদপুর, বরিশাল, সিলেট, চাঁদপুর, মানিকগঞ্জ, খুলনা, কুষ্টিয়া, বগুড়া, টাঙ্গাইল, পাবনা, কুমিল্লা ও যশোর। যা পত্রিকার সম্পদ সীমাবদ্ধতা ও সেই যুগের প্রেক্ষাপটে অসাধারণ ব্যাপ্তি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। সেদিনের সংস্করণে দুটি বিদেশি সংবাদও ছিল। একটির শিরোনাম ছিল 'ভিয়েতনামের সংগ্রাম' এবং দ্বিতীয়টি 'ফ্রান্সে ডাক ও বিমানখাতে ধর্মঘট।' দুটি বিজ্ঞাপনও ছাপা হয়েছিল, যার একটি ছিল 'শুল সুধা' নামে হজমে সহায়ক পণ্য এবং দুগ্ধজাত পণ্য 'মিল্কো'র প্রচারণামূলক আরেকটি বিজ্ঞাপন। পত্রিকাটির বিক্রয় মূল্য ছিল ১০ পয়সা। 

পাকিস্তান আন্দোলনের তিন কর্ণধার শের-ই বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক প্রজা পার্টি, গণতান্ত্রিক দল ও নেজামে ইসলামের জোট যুক্তফ্রন্টের ১৯৫২ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় একটি অসাধারণ মুহূর্তের জন্ম দেয়। যুক্তফ্রন্ট ৩০৯ আসনের সংসদে ২২৩টি আসনে জয়লাভ করে, যেখানে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ শুধু ৯টি আসন পায়। সবচেয়ে লজ্জাজনক বিষয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ও মুসলিম লীগের অভিজ্ঞ নেতা নুরুল আমিনের ২৭ বছর বয়সী ছাত্রনেতা খালেক নেওয়াজ খানের কাছে পরাজয় বরণ। ওই বিপর্যয়ের মাধ্যমে মুসলীম লীগের অপমৃত্যুর সূচনা হয়। ১৯০৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী দলটি পাকিস্তান আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিল। ইতিহাসে খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা গেছে একটি নতুন দেশের জন্ম দেওয়া রাজনৈতিক দলকে সে দেশেরই মাটিতে মাত্র ৭ বছরের মাথায় বিলীন হয়ে যেতে। একটি উজ্জ্বল ও ঐতিহাসিক ভবিষ্যতের আভাস দিয়ে জোটের সবচেয়ে বড় দল হিসেবে ১৪৩ আসন নিয়ে সবার নজরে আসে আওয়ামী মুসলিম লীগ।  

এই নির্বাচনী বিজয় থেকে পাওয়া রাজনৈতিক বার্তা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয় পাকিস্তানি নেতারা। তারা জনগণের রায়কে অবজ্ঞা করে এবং এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক সরকারকে নাকচ করে দেয়। একই ধরনের আরও অসংখ্য ঘটনা ঘটতে থাকে পরবর্তী দিনগুলোতে। পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল গোলাম মুহাম্মদ যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা বাতিল করেন এবং ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা স্বত্বেও এ কে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনেন। এই ঘটনাকে পাকিস্তানের ইতিহাসের মোড় ঘোরানো ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এখান থেকে তিনটি বিষয় পরিষ্কার হয়: পাকিস্তানি নেতাদের জনগণের ইচ্ছার প্রতি অসম্মান, বাঙ্গালীদের মতামতের প্রতি তাচ্ছিল্যের মনোভাব এবং পূর্ব বাংলার নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ। 

যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের মাধ্যমে তাদের ২১ দফা দাবি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে, যা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২১ দফা নামে পরিচিত এই দাবির মাধ্যমে সুবিশাল জয় অর্জিত হয় এবং প্রথমবারের মতো পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সার্বজনীন চাহিদা হিসেবে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। খুবই সংক্ষিপ্ত এবং সহজ ভাষায় লিখিত ২১ দফা দাবির এই নজিরবিহীন প্রকাশনা খুব সহজেই জনগণের কাছে পৌঁছে যায় এবং সমগ্র প্রদেশ জুড়ে তা দ্রুত সমর্থন পেতে থাকে। 

নির্বাচন, ২১ দফা দাবিকে জনপ্রিয় করা, যুক্তফ্রন্টের নেতাদের বার্তাকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং সাধারণ মানুষকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচরণ সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করার ক্ষেত্রে ইত্তেফাকের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। এতে ইত্তেফাক পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অবিসংবাদিত কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পত্রিকার সম্পাদক একজন গুরুত্বপূর্ণ, প্রজ্ঞাবান ও শক্তিশালী সাংবাদিক হিসেবে সমগ্র পাকিস্তানজুড়ে পরিচিত হন। 

মানিক মিয়ার মতো দূরদর্শিতা, শক্তিশালী লেখনী এবং পাঠক ও জনমানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারার ক্ষমতা আজও অন্য কোনো সাংবাদিকের লেখনীতে দেখা যায়নি। তিনি একইসঙ্গে এই পেশায় নতুন ধরনের মর্যাদা নিয়ে এসেছেন এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে পত্রিকার স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। খুব সম্ভবত আর্কাইভ সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতার কারণে 'প্রথম পৃষ্ঠাগুলো ১৯৫৩-১৯৭২' প্রকাশনায় পত্রিকার প্রথম সংখ্যার পর ১৯৫৬ সালের সংখ্যা ছাপাতে হয়েছে। বস্তুত, সকল সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠাগুলো ছাপানো হয়নি। উল্লেখ্য, ইত্তেফাকের সমগ্র ভবন এবং তার মধ্যে থাকা ছাপাখানা ও অন্যান্য যন্ত্রসহ সব আর্কাইভ উপকরণ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার সময় পুড়িয়ে দেওয়া হয়। 

জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক সরকারের ক্ষমতা দখল এবং একইসঙ্গে যুক্তফ্রন্টের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করার ঘটনায় একটি গণতান্ত্রিক পাকিস্তান গঠন এবং সঙ্গে পাকিস্তানের উন্নয়নে বাঙালিদের স্বপ্নপূরণের সম্ভাবনার অকাল মৃত্যু ঘটে। সে সময় যুক্তফ্রন্টের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, আবুল মনসুর আহমেদ ও মানিক মিয়াসহ আরও অনেকে গ্রেপ্তার হন। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব খানের শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, যা পশ্চিম পাকিস্তানে দেখা যায়নি। পরিশেষে, মূলত শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলনের শুরুর কথা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং গণআন্দোলনের মুখে মামলা প্রত্যাহার, আইয়ুব খানের পতন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মাধ্যমে সামরিক আইনের প্রত্যাবর্তন, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু—এ সব ঘটনার বিবরণ প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ইত্তেফাক সব সময় সাহসী ও নির্ভীক থেকেছে। সাহসী সম্পাদকীয় এবং তথ্যবহুল প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রকৃত অর্থেই এটি হয়ে দাঁড়ায় জনগণের পত্রিকা। মানিক মিয়ার রাজনৈতিক কলাম, 'রাজনৈতিক মঞ্চ' সব ধরনের রাজনৈতিক আলোচনার জন্য তথ্যের সূত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তার লেখনী ছিল শক্তিশালী এবং যে বিষয় তিনি বলতে চাইতেন, তা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ভাষা-বাক্যের ব্যবহার ছিল অতুলনীয়। অসামান্য দক্ষতায় তিনি নিজের মনের ভাবনাগুলোকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতেন।  

জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের আমলে এবং পরবর্তীকালে, স্বাধীনতা অর্জনের যাত্রাপথে ইত্তেফাকের ভূমিকা ছিল সাহসী, ধারাবাহিক এবং পেশাদার। মানিক মিয়া প্রাদেশিক সার্বভৌমত্ব ও বাঙ্গালীর অধিকার নিয়ে প্রচারণা চালাতে থাকেন এবং সামরিক বা আধা-সামরিক শাসনের সময় স্বাধীন সাংবাদিকতা যেসব সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়, সেগুলোকে তার প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে মোকাবিলা করেছেন। ১৯৬২ সালে সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করায় পাকিস্তানজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং মানিক মিয়াকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়। ৬ দফা আন্দোলনকে সমর্থন করার অভিযোগে তাকে ১৯৬৬ সালে আরও একবার গ্রেপ্তার করা হয়। ১০ মাস কারা ভোগ করার পর স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তিনি আর কখনোই পুরোপুরি সুস্থ হননি এবং ১৯৬৯ সালের ১ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কাজের জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থানরত অবস্থায় মাত্র ৫৮ বছর বয়সে তিনি মারা যান।  

বর্তমান সময়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, ৫০ ও ৬০-এর দশকে ইত্তেফাকের শাসকগেষ্ঠীর সমালোচনা, অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ও নায্যতার পক্ষে আপসহীন ভিন্নধারার সাংবাদিকতার পুনরাবৃত্তি কি আজকের যুগে সম্ভব? এ ধরনের সাংবাদিকতা কি প্রাসঙ্গিক? বাংলাদেশে কি এ ধরনের সাংবাদিকতার প্রয়োজন আছে? ভিন্নমত কি গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়, যা এই দুটি বিষয়কে এমন একটি রূপ দেয়, যেন তারা একই মুদ্রার দুই পিঠ এবং একটিকে ছাড়া অন্যটির অস্তিত্ব থাকতে পারে না? ইত্তেফাক পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের বঞ্চনা, তাদের বিরুদ্ধে শোষণ, দুই প্রদেশের মধ্যে ক্রমশ বাড়তে থাকা অসমতা এবং জনমানুষের বঞ্চনা; বিশেষ করে বাঙালির প্রতি বৈষম্যের কথা বলেছে। পাকিস্তান সরকার ইত্তেফাকের যৌক্তিক অবস্থান অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়ে নিজেদের ক্ষতি করেছে এবং ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইত্তেফাক অর্থনীতির ত্রুটিগুলো সম্পর্কে মানুষকে জানাত, দিনে দিনে দুই প্রদেশের মধ্যে গড়ে ওঠা অসমতা ও আয় বৈষম্য-বঞ্চনা বিষয়ে সতর্ক করত। সত্য প্রকাশ করত। এক মুহূর্তে জন্য ভাবুন, ইত্তেফাকের এই ভূমিকার জন্য পত্রিকাটিকে দমন বা তাচ্ছিল্য না করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যদি বিষয়গুলোকে আমলে নিতেন, তাহলে কি তারা উন্নত সমৃদ্ধ একটি দেশ গঠন করতে পারতেন? 

ইত্তেফাক শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখা একটি জাতিকে উদ্দীপ্ত করে এবং তাদের স্বাধীনতা অর্জনের প্রক্রিয়ার অংশীজন হয়ে ওঠে। আজকের সাংবাদিকতা একটি স্বাধীন দেশের মানুষের জন্যে। স্বাধীন দেশের মানুষ দুর্নীতি, সুশাসনহীন আইনের অপব্যবহারের কাছে বন্দি। ন্যায়বিচার ও সামাজিক নায্যতা প্রতিষ্ঠা ছাড়া কি দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া সম্ভব? সমাজ কি সৃজনশীল হতে পারে, যদি  প্রশ্ন করা না যায়? যদি গণতন্ত্র আমাদের লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে কাউকে ভিন্নমত পোষণ করার সুযোগ না দিয়ে কীভাবে আমরা সে লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারব? 

সুতরাং বর্তমানের সাংবাদিকদের অতীতের ইত্তেফাকের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। 

 

 

পাদটীকা

আমি এই ঐতিহ্যবাহী পত্রিকার তরুণ ও প্রগতিশীল নির্বাহী পরিচালক ও প্রকাশক তারিন হোসেনকে অভিনন্দন জানাতে চাই, কিন্তু তা সুনির্দিষ্টভাবে এই প্রকাশনার জন্য নয় (আগেও অন্যান্য ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রকাশনা হয়েছে), বরং এ ধরনের একটি উন্নতমানের প্রকাশনার জন্য তিনি যে সাহস ও বুদ্ধিমত্তা দেখিয়েছেন, তার জন্য। আমার মতে, এ ধরনের একটি প্রকল্প নিয়ে চিন্তা করা খুবই ঝামেলাপূর্ণ এবং তিনি ও তার দল তা দক্ষতার সঙ্গে শেষ করেছেন। ইত্তেফাকের এই বিশেষ সংখ্যায় যে সময়টা তুলে ধরা হয়েছে, তা ইতিহাস সমৃদ্ধ এবং জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন দিনগুলোর প্রথম পাতা এতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে আর কোনটা বাদ দিতে হবে সে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা অবশ্যই খুব হৃদয় বিদারক ছিল। এই প্রকাশনা বাংলাদেশের সংবাদপত্রের জগতে একটি অসামান্য অবদান এবং অন্যান্য পত্রিকার উচিৎ এই চমৎকার উদাহরণটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে অনুকরণ করা। ইত্তেফাকের সকল কর্মীদের প্রতি আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন রইল। 

 

 

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

 

 

Comments

The Daily Star  | English

JnU student's suicide: Assistant proctor sent to jail after remand

Jagannath University (JnU) assistant proctor Din Islam was sent to jail today on completion of his remand in the case filed over instigating death by suicide of law student Fairuz Abantika

27m ago