‘আম গাছে কখনো কাঁঠাল হয় না’

যখন প্রতি বছরের মতো এবারও ভাঙা প্রতিমা, আগুন পোড়া ঘর, রক্ত জমা হিন্দু শরীর দেখে বাঙালি মুসলিমের অবাক ভ্যাবাচেকা মন আকাশ থেকে মাটিতে আছাড় খেয়ে বলছে—‘এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়’, তখন চাঁদপুর জেলার এক গভীর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধার কথা কানের কাছে আয়াতের মতো বাজছে, ‘আম গাছে কখনো কাঁঠাল হয় না’।
ছবি: রাশেদ সুমন

যখন প্রতি বছরের মতো এবারও ভাঙা প্রতিমা, আগুন পোড়া ঘর, রক্ত জমা হিন্দু শরীর দেখে বাঙালি মুসলিমের অবাক ভ্যাবাচেকা মন আকাশ থেকে মাটিতে আছাড় খেয়ে বলছে—'এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়', তখন চাঁদপুর জেলার এক গভীর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধার কথা কানের কাছে আয়াতের মতো বাজছে, 'আম গাছে কখনো কাঁঠাল হয় না'।

তাই বলছিলাম, অবাক হবেন না। ঘৃণা আর বিভেদের বীজ বুনে যে দেশের বয়স বাড়ে, তার বুকে মৃত্যু উপত্যকারই ঘর বাধার কথা, জীবনগঙ্গার না। এ‌টা সত্যি কঠিন সত্যি। অথচ এর চেয়ে সহজ সত্যি আর কিছু নেই।

কিন্তু এই সত্যিটা মানবো না বলে আমরা গভীর পণ করে আছি। একটা প্রবল সম্প্রদায় ও সচ্ছল শ্রেণি পরিচয়ের আরামে থেকে আমরা যারা এই সহিংসতাকে দূর থেকে বোঝাপড়া করার ফুরসত ও সুবিধা পাচ্ছি তারা অনেকেই তর্কটা করছি মূলত দুটি বিপরীত মেরুতে পা রেখে, কিছু মানুষের উগ্র সাম্প্রদায়িকতার কেচ্ছার বিপরীতে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও রাজনৈতিক ফায়দার যুক্তি দাঁড় করিয়ে। অথচ প্রশ্ন তো এই হামলা কতজন ধর্মান্ধ মুসলিমের কয় কেজি শুদ্ধ সাম্প্রদায়িকতার কয় মণ ফসল তা ওজন করা কেন্দ্র করে নয়। কিংবা প্রশ্ন শুধু এটাও নয় যে, এই হামলায় কয় গ্রাম রাজনৈতিক স্বার্থ, কয় ছটাক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা 'সহজ' 'সরল' মুসলিমের দাসত্ব এবং কয় তোলা আন্তর্জাতিক মহলের হাতছানি রয়েছে। বরং প্রশ্ন হলো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা, দেশ-বিদেশের স্বার্থ সিদ্ধির রাজনীতি, আর্থসামাজিক সম্পর্ক ও পরিচিতি নির্মাণের দেনদরবারের কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এমন চরিত্র ও ছাঁচের সমাজ ও 'জনগণ' তৈরি হয় যারা সক্রিয় কিংবা নিষ্ক্রিয়, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এ ধরনের হামলার জমিন প্রস্তুত করে। তাই প্রশ্নটা যেমন রাষ্ট্রের দিকে তাক করা, তেমনি জনপরিসরের আর্থ-সামাজিক সংস্কৃতির দিকেও ছুঁড়ে দেওয়া। প্রশ্নটা যেমন ইতিহাসের দিকে তাকানো, তেমনি আজকের মুহূর্তের হাত ধরা।

রাজনীতির শিরা-উপশিরাকে কাটছাঁট করে এ ধরনের হামলাকে শুধুই 'সাম্প্রদায়িক' ধর্মান্ধ কিছু মানুষের মুহূর্তের স্বতঃস্ফূর্ত উন্মাদনা হিসেবে দেখার যে 'প্রগতিশীল' চোখ তা ভীষণ উগ্র ও একপেশে। সাম্প্রদায়িকতা সবসময়ই রাজনৈতিক। কক্সবাজারের রামু থেকে পাবনার সাঁথিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থেকে সুনামগঞ্জের শাল্লা ছাড়াও আরও নানান ঘটনায় আমরা দেখেছি কীভাবে ক্ষমতাশীল দলের মধ্যেকার স্থানীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব, জমিজমা কেন্দ্রিক কোন্দল, প্রতিবেশী দেশগুলোর মুসলিম-বিদ্বেষ এবং হিন্দু-মুসলিমদের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে জড়ো করার আন্তর্জাতিক হিসাব-নিকাশ এইসব সাম্প্রদায়িক হামলার নকশা তৈরি করে, কলাকুশলী ভাড়া করে এবং প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় নাটক মঞ্চস্থ করে। আজকের এই হামলাও এই ছকের বাইরে নয়। রাষ্ট্রের নজরদারির এত হাতি-ঘোড়া প্রযুক্তি থাকার পরও এবং যেকোনো বিপক্ষ আওয়াজ, শক্তিকে মুহূর্তে হাপিস করার এতো উজির-গোলামের সার্বক্ষণিক টহল থাকার পরও ৪-৫ দিন ধরে দেশব্যাপী এত সংগঠিত হামলা হতে দেওয়া এবং নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা বা না চাওয়া সেই রাজনৈতিক ছকেরই প্রমাণ দেয়।

কিন্তু তাই বলে এই হামলাকে শুধুই রাজনৈতিক ছকে মাপলে আমাদের জল-পানিতে যে প্রতিদিনকার সাম্প্রদায়িকতা লেপ্টে থাকে তাকে অস্বীকার করা হয়। যতই রাজনৈতিক ইন্ধন থাকুক, যতই সাধারণ মানুষ ক্ষমতাশীলদের হাতের পুতুল হয়ে প্রতিমা ভাঙুক, প্রশ্ন হলো—এতো সহজে মানুষ পুতুল হতে প্রস্তুত থাকে কেন? কেন মানুষের মনের জমিন বহুকাল থেকে তৈরি হয়ে থাকে পূজাকে 'অচ্ছুৎ' 'অন্য' হিসেবে দেখতে? কীভাবে মানুষ জানে যে, ভাঙলে মসজিদ না দেবীর হাত ভাঙতে হয়, বুদ্ধের মাথা গুড়াতে হয়, পোড়ালে অমুসলিমের ঘর কয়লা করতে হয়? হাজারো মানুষের মিছিলে হতে পারে ১০ জন ভাড়া করা দলীয় কর্মী প্রান্তিকের জানমালের ওপর হাত তোলে, কিন্তু সেই হাজারো মানুষ কেন খুনিদের সেই হাত না ঠেকিয়ে তাতে ছুরি এগিয়ে দেয়? হামলার বাইরে দাঁড়ানো যে কোটি মুসলিম হামলাকারীদের 'ছিঃ ছিঃ' করে, তারাও কেন 'তবুও হিন্দুরা এ দেশে ভালো আছে' এমন চিন্তা, বোধ, তৃপ্তি দ্বারা প্রতিদিন চালিত হয়? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিম জানতে চাইনি কোনো দিন। আমরা স্বীকার করিনি যে আমরা বেশিরভাগ জনগণই মূলত সাম্প্রদায়িক হয়ে আছি। আমরা বহুদিন ধরে সাম্প্রদায়িক হয়ে বেঁচে থেকে সাম্প্রদায়িকতাকে দেখে গেছি দূর গ্রামের মাদ্রাসার গরিব খেটে খাওয়া অশিক্ষিত মানুষের হুজুগে উন্মাদনা হিসেবে। অথচ আমরা আয়নায় নিজেকে দেখিনি।

সাম্প্রদায়িকতা আসমানি কিতাব না। এটি হুট করে আসমান থেকে নাজিল হওয়ার বিষয় নয়। এটি প্রকৃতি প্রদত্ত কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়, যা কিছু অশিক্ষিত মানুষ জন্ম-জন্মান্তরে রক্তে বয়ে নিয়ে বেড়ায়। জাতবোধ বহু অতীতের বিষয়। কিন্তু সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িকতা বলতে আজ আমরা যা বুঝি তার বীজ বোনা হয়েছিল উপনিবেশিক আমলে এবং সাম্প্রদায়িকতার এই বোধটা ছিল আধুনিক জাতি গঠনের অপরিহার্য উপাদান। দুই উপনিবেশিক শাসকেরা মুসলিমের বিপরীতে হিন্দুর যে পরিচয় দাঁড় করিয়েছিল সেই সাম্প্রদায়িক পরিচিতিকে আমাদের পূর্বপুরুষেরা খারিজ করেননি। বরং আমাদের শরীরে, পোশাকে, ঘরের সজ্জায়, সাহিত্যের পাতায় তারা সেই পরিচিতিকে ধারণ করেছেন। 'নিজ বনাম অপর' এর বাইনারি পরিচিতির ওপর ভর করেই আমাদের জাতীয়তাবাদী বোধের জন্ম হয়েছে। তারই হাত ধরে উপনিবেশ ভেঙে স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে। পাকিস্তানি শাসনামলে ইসলাম যেহেতু রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শ ও শাসনের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, সেহেতু বাংলাদেশ গড়ে উঠেছিল বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাষা পরিচিতির বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে। যে জাতীয়তাবাদ ধর্মনিরপেক্ষ হলেও জাতিনিরপেক্ষ ছিল না। বাংলাদেশের সূচনাটি ছিল তাই এ দেশে বসবাসরত অমুসলিম, অবাঙালি মানুষদের জাতিগত পরিচয় অস্বীকার করে। সেই সূচনাতে আমরা কয়জন আপত্তি করেছি?

একটি সার্বভৌম ভূখণ্ড পাওয়াকে বিজয়ের শেষ ধাপ ধরে নিয়ে আমরা দেশের জনগণ যে যার আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়েছি। আমরা বুঝিনি মানচিত্রের স্বাধীনতা আর জনগণের স্বাধীনতা এক বিষয় নয়। আমরা মানচিত্রের ছবি দেশের আনাচে কানাচে টানিয়েছি, কিন্তু সেই আনাচ কানাচকে একে অন্যের প্রতি সহনশীল, সংবেদনশীল হিসেবে গড়িনি। নিজেদেরকে এবং চারপাশকে গড়ার কথা ছিল দেশের সুবিধাভোগী থেকে শুরু করে প্রান্তের মানুষটারও। কিন্তু প্রবল ধর্মের, জাতির এবং শ্রেণির শিক্ষিত মানুষ হিসেবে আমাদের হাতে যে সুযোগ, ক্ষমতা, রসদ ছিল সমাজটাকে আদল দেওয়ার তা প্রান্তিক জাতি, শ্রেণি, ধর্মের মানুষের ছিল না। আমরা সেই সুযোগ ও ক্ষমতা তাদের দিতেও চাইনি। ফলে সামাজিক সংহতি, সুসম্পর্ক ও সুনাগরিক তৈরির বেশিরভাগ দায় আমাদের সুবিধাভোগীদের কাঁধে ছিল। আমরা সেই দায় বহু আগেই কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলেছি।

প্রথমত, আমরা সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিসর থেকে চোখ সরিয়ে সকল মুশকিল আসানের সূত্র খুঁজেছি রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা, সংবিধান ও আইনের দলিলে। রাষ্ট্র, সংবিধান, আইন, সমাজ কীভাবে জাপটাজাপটি করে থাকে তা বোঝা দরকার। কিন্তু এদের মধ্যকার প্রত্যয় ও চর্চাগত পার্থক্য বোঝাও খুব জরুরি, যা আমরা করিনি। ধর্ম নিরপেক্ষতাকে তাই আমরা শুধু সংবিধানের ভাষায় আটকে রাখতে চেয়েছি, সামাজিক পরিসরের দৈনন্দিন চর্চায় নয়। অথচ ইতিহাসে দেখা গেছে যেই দেশে ধর্ম একটা বিশ্বাস এবং মতাদর্শ হিসেবে চালিত হয় সেই দেশে জনবিচ্ছিন্ন সেক্যুলারিজমের সাংবিধানিক আরোপ ধর্মীয় প্রান্তিক গোষ্ঠীকে খুব একটা বাঁচাতে পারে না, বরং প্রান্তে ঠেলে।

বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম ছিল না। ৭১ এর স্বাধীন ভূখণ্ডে সংবিধানের পাতা ব্যতীত 'ধর্ম নিরপেক্ষতার' চর্চা ও বোঝাপড়া ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ জনপরিসর কোথাও ছিল না।

৪৭ এর দেশভাগের রক্তারক্তিতে হিন্দু-মুসলিম দুই দলই দেখেছে কত সহজে ধর্মের নামে বন্ধুর হাতেও নিজের রক্ত লাগে। সেই স্মৃতি নিয়ে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম দেখেছে কোন ছুতোয় হিন্দুকে ভিটে ছাড়া করা যায়, কত আরামে হিন্দু নারীর গায়ে হাত বসানো যায়, কোন গুটি চেলে হিন্দু পরিবারগুলোকে লুট করে নিঃস্ব বানানো যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই দগদগে ক্ষত সারাবার জন্য প্রান্তিক ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের সামাজিক নিরাপত্তা বলয় জোরদার করার দিকে আমরা কেউ-ই মন দেইনি। একটি সেক্যুলার দেশে মুসলিম ও অমুসলিমের পারস্পরিক পরিচিতি কীভাবে নির্মাণ করা যায় এবং ভিন্ন বিশ্বাস, চর্চা, চিন্তাকে কীভাবে জনপরিসরে সমান মর্যাদায় দৃশ্যমান করা যায় সে বিষয়ে সুশীল সমাজ ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিসেবে আমাদের বড় একটা অংশ বরাবর উদাসীন থেকেছে। ফলে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যে সীমাহীন অস্থিরতা ও অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছিল তা মুসলিম ও অমুসলিমের সম্পর্কের চিড় ও অবিশ্বাস দিন দিন বাড়িয়েছে, এক বিন্দুও কমায়নি। তাই সেক্যুলার বাংলাদেশের জমিনেই প্রশাসনিকভাবে হিন্দু পরিবারগুলোর জমি, বসত ভিটে অধিগ্রহণের শিকার হয়েছে। রোজদিন হয় মালতি মাসির গরুটা চুরি গেছে, নয় তো হরি কাকার পাকা ধান ভোরের আলোতে হাপিস হয়েছে, কিংবা সন্ধ্যা পূজায় প্রদীপ জ্বালাতে গিয়ে পশ্চিম পাড়ার পার্বতী কাকী তুলসী গাছটা মাটিতে লুটাতে দেখেছে। এসব পাশ কাটিয়ে আমরা তবুও সংবিধানের সেক্যুলারিজমে মাথা রেখে শান্তিতে ঘুমিয়েছি।

আবার যখন ১৯৭৮ সালে সংবিধান থেকে সেক্যুলারিজম বাদ দেওয়া হয়েছে এবং ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়েছে তখনও আমরা রাষ্ট্র ও আইনের শাসননামায় সমাধান খুঁজেছি। গত কয়েক দশকে যেমন রাজনীতির মাঠ থেকে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিদের মুছে ফেলে সরকার তার রাজনৈতিক ডিসকোর্সে ধর্মকে নিয়ে এসেছে এবং ধর্মীয় নেতাদের বৈধতা দিয়েছে, তেমনি ইসলামপন্থী সংগঠন ও আন্দোলনগুলো সমাজে ধর্মের প্রভাব বাড়িয়েছে। ধর্মকেন্দ্রিক এই রাজনীতিকে ও রাজনীতির মাঠের শূন্যতাকে আমরা মোকাবিলা করতে চেয়েছি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি তুলে। কিন্তু আমরা বুঝতে চাইনি যে রাষ্ট্র সবসময়ই অধিপতিশীলের। সেক্যুলারিজমের মতো শুধু গণতন্ত্র দিয়েও সাম্প্রদায়িকতা চাপা দেওয়া যায় না, অমুসলিমের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় না। গণতন্ত্রের মূল আদর্শ হলো জনগণের সার্বভৌমত্ব, জনগণই এখানে সর্বেসর্বা। যদি দেশের বেশিরভাগ জনগণ মনে করে যে এ দেশ হিন্দুর না, তবে গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি মেনেই তারা হিন্দু তাড়াতে পারে দেশ থেকে। ফলে জরুরি ছিল গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠার দাবির পাশাপাশি সমাজকে আদল দেওয়া, জনগণকে সহনশীল, সুনাগরিক, অসাম্প্রদায়িক হিসেবে গড়ে তোলা, যা আমরা করিনি।

দ্বিতীয়ত, আমরা যে শুধু সামাজিক সংহতি তৈরি করিনি তা নয়, বরং আমরা দেশের প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার একটা সংস্কৃতি তৈরি করেছি এবং করছি। এক দিকে নির্দিষ্ট শ্রেণি অবস্থানের সুবিধা ভোগ করে আমরা প্রমিত বাংলা এবং ক্ষেত্র বিশেষে ইংরেজিতে কথা বলি, আমাদের পরিপাটি বসার ঘরের বুকশেলফে যেই সাহিত্য শোভা পায়, দেওয়ালে যেই বিমূর্ত ছবি ঝোলানো থাকে, বাতাসে যেই গানেরা সাঁতার কাটে সেই ভাষা, রং, সুর এ দেশের প্রান্তিক জাতি, ধর্ম ও শ্রেণির মানুষের জীবন, ক্লান্তি, স্বপ্ন, লড়াইকে ধরতে পারে না। আমাদের চোখে কবিতা চাকমার 'জ্বলি ন' উধিম কিত্তেই!' বড় বেশি 'অন্য' ঠেকে, মমতাজের 'বন্ধু তুই লোকাল বাস' বড় অশ্লীল শোনায়। আমাদের এই 'ভদ্র' সমাজের বাইরের মানুষকে আমরা আঁকি 'অভদ্র', 'ক্ষ্যাত', 'কুরুচিকর', 'ধর্মান্ধ', 'মূর্খ' হিসেবে। আমরা ফ্রান্সে মুসলিম নারীর স্কার্ফ পরা নিষিদ্ধ হলে 'তীব্র নিন্দা' জানাই। আবু লুগোধের 'Do Muslim Women Need Saving?' পড়তে পড়তে পশ্চিমা সাদা নারীবাদের চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করি। কিন্তু দেশীয় বোরকা পরা নারী দেখা মাত্র আগে পিছে কিছু না দেখে তাকে 'উদ্ধার' করে তার 'ক্ষমতায়ন' ঘটাতে চাই। আমরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক কীভাবে শিক্ষার্থীদের সাম্প্রদায়িক করে তোলে সেই জ্যামিতি কষি না। আমাদের চোখ এড়িয়ে যায় কীভাবে সাত বছরের শিশুকে স্কুলের খেলার মাঠেই হিন্দু বলে 'লাল পিঁপড়ার' গালি খেতে হয়। অথচ আমরা মগজে সকল সাম্প্রদায়িকতাকে গুণ দেই হেফাজত আর মাদ্রাসা দিয়ে। আমরা নিজেদের বাচ্চাদের জন্য একটি সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ার স্বপ্ন দেখি, কিন্তু মাদ্রাসাকে কীভাবে একটি ধর্মীয় সহানুভূতিশীল, সৃষ্টিশীল কারিকুলামে সাজানো যায় সেই পথ খুঁজি না। আমরা বহু সুশীলরা নরেন্দ্র মোদি দেশে আসলে বড় জোর নাক সিঁটকাই, কিন্তু তার প্রতিবাদ করে হেফাজতের ১৭ জন মানুষ গুলি খেয়ে খুন হওয়ার পরেও সরকারকে লিখিত বিবৃতি দেই 'হেফাজতের বিরুদ্ধে আরও কঠিন ব্যবস্থা' নেওয়ার জন্য। খুনের চাইতেও বেশি কঠিন ব্যবস্থা হলো আরও বেশি খুন করা। আমাদের অনেকেই সেই খুনে শুধু সম্মতি নয় আবেদন জানায়। এই যে জন বিচ্ছিন্নতা, নির্দিষ্ট ধরনের ইসলামে ফোবিয়া, খুন হওয়া লাশের ধর্ম ও দল খোঁজা—এসব সাম্প্রদায়িকতা নয়? এর অর্থ এই নয় যে প্রান্তিকের সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে 'আহা বেচারা অবুঝ' বলে বিচারহীনতায় ধামা চাপা দিতে হবে। কিন্তু আমাদের এই ঘৃণা, বিচ্ছিন্নতা কি বহু প্রান্তিক মুসলিমকে 'কট্টর', সাম্প্রদায়িক হিসেবে গড়ে ওঠার পথ করে দেয় না?

কিংবা 'ধর্মান্ধ' হেফাজতি ও মাদ্রাসার ছাত্রদের হররোজ দোষারোপ করতে থাকা এই ভীষণ 'প্রগতিশীল' আমরাই কি দিনের পর দিন চোখের সামনে ঘটা রোজকার সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেই না? আমরা নির্লজ্জের মতো বন্ধুকে না জানিয়ে গরু খাইয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে পিঠ চাপড়াই। দুর্গা পূজায় আযানের আগ-পিছে ভুল করে শাঁখ বাজালে 'নন-সেন্স' বলে আপন মনেই গালি দেই। অমুসলিম শিক্ষার্থীর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে শিক্ষকের তামাসায় মজা পাই। মিডিয়াতে অমুসলিম ও অবাঙালির অদৃশ্যতা কিংবা বিকৃত পরিবেশনকে স্বাভাবিক চোখে দেখি। বাস-যাত্রায় ইসলামের বাণী আমাদের কানে দৃষ্টিকটু লাগে না। হিন্দু সহকর্মীকে আমরা নির্দ্বিধায় 'মালু' বলে ডাকতে শুনি এবং বলি। একদিনের ঈদে আমরা নূন্যতম তিন দিনের সরকারি ছুটি বিন্দাস হয়ে ভোগ করি হিন্দুদের পাঁচ দিনের পূজায় এক দিনের ছুটির বিপরীতে। তবুও আমরা সাম্প্রদায়িক নই?

আমরা গাছতলায় বসে বর্ষ বরণের গান গেয়ে, মঙ্গল শোভাযাত্রা করে, শাখা-সিঁদুর, ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ঠাকুর দেখতে গিয়ে, শিবু কাকুর বাড়িতে পূজার নাড়ুটা খেয়ে, সুবীর নামের সবচেয়ে মনের বন্ধুটার সঙ্গে ঈদের ছুটি কাটিয়ে, অথবা প্রথম জীবনে প্রথম প্রেমে মীরা সেনের মাঝে ডুব সাঁতার কেটে নিজেকে অসাম্প্রদায়িক সাজাই। প্রতি বছর নিয়ম করে যে হামলা হয় পূজা মণ্ডপে, হিন্দু পাড়ায়—সেই হামলা দেখে আমরা আমাদের বাৎসরিক শোক উদযাপন করি বাৎসরিক বয়ান দিয়ে, 'আমি লজ্জিত'। কিন্তু লজ্জা পাওয়াকে টপকিয়ে আমরা সাম্প্রদায়িকতার শিকড় খুঁজে দেখি না, অমুসলিমের রোজকার অপমানে প্রতিবাদ ও সুবিচারের আওয়াজ তুলতে চাই না। আমাদের আরাম-আয়েশের কুসুম নরম সোহাগী জীবন থেকে বের হয়ে এসে আমরা সামাজিক সংহতি তৈরি করতে চাই না। আমাদের এই লজ্জা, শোক প্রকাশ তাই বড্ড বেশি অযথা ঘ্যানঘ্যানানি, লোক দেখানি। তাছাড়া শুধুমাত্র মুসলিম বলেই এই হামলার লজ্জার দায় দেশের সব মুসলিমের ওপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বর্তায় না। বরং প্রশ্ন হলো যেই দায়টা সত্যি সত্যিই আমাদের আমরা তা মেনে নিতে প্রস্তুত কিনা।

চাঁদপুরের সেই মুক্তিযোদ্ধার হররোজ প্রশ্ন ছিল— 'দেশটাকে গড়ে তোলার সংগ্রামে কেউ শামিল হল না কেন? দুদিন আগেইতো এই দেশের মানুষ দেশের জন্য মরতে প্রস্তুত ছিল?' আমরা বরং এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভীষণ লজ্জা পাই। এমন লজ্জা পাই যাতে শিরদাঁড়া সোজা করে আমরা জনবিচ্ছিন্নতা থেকে বেরিয়ে এসে বৃহত্তর ঐক্যে দেশটাকে গড়ার উপায় খুঁজি। আমরা যেন শাসনে-আইনে, সম্পর্কে-পরিচিতিতে এমন সমাজ গড়ার চেষ্টা করি যে সমাজ বাংলাদেশের আস্তিক, নাস্তিক, বাঙালি-অবাঙালি, সকল লিঙ্গীয় ও যৌন চর্চার মানুষকে ধারণ করতে পারে। আমরা যেন আম গাছের তলায় বসে কাঁঠালের স্বপ্ন দেখে জীবন পার না করি। আমাদের শোক-লজ্জা যাতে আমাদের শক্তি দেয় আম গাছটা উপড়ে ফেলে একটা সত্যিকারের কাঁঠাল গাছ লাগানোর। একমাত্র তখনই এই লজ্জা-শোক হবে ভীষণ দামি, অন্যথায় সবই ধূলা আর কয়লা।

 

তথ্যসূত্র:

১. 'আম গাছে কাঁঠাল ধরে না': একজন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধার ইতিহাসের হিসেব নিকেশ, সায়দিয়া গুলরুখ, ২০১৭

২. The construction of Communalism in Colonial North India, Gyanendra Pandey, 1990.

৩. Antagonistic Tolerance: Competitive Sharing of Religious Sites in South Asia and the Balkans, Robert Hayden, 2014.

৪. রাজনীতিতে ধর্মের ফিরে আসা, আলী রিয়াজ, ২০২১

৫. জ্বলি ন' উধিম কিত্তেই? চাকমা কবিতা, ১৯৯২

 

আনমনা প্রিয়দর্শিনী: লেখক, গবেষক ও পিএইচডি ক্যান্ডিডেট, ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ, যুক্তরাষ্ট্র

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

LNG Processing: Capacity to outpace demand

Bangladesh will end up with surplus LNG regasification capacity by the end of this decade, said the UK-based BMI Research -- a development that will ultimately cost the exchequer in fees similar to capacity charges for power plants.

8h ago