আফগান নারীদের চলমান জেলখানার জীবন ও স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট

ফেসবুকের মাধ্যমে আদিবা নামের এক আফগান তরুণীকে চিনতাম, যিনি মাঝে-মধ্যে আফগানিস্তানের সুন্দর জায়গাগুলোর ছবি পোস্ট করতেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-মণ্ডিত এলাকাগুলোর সেসব ছবি দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম।
ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

ফেসবুকের মাধ্যমে আদিবা নামের এক আফগান তরুণীকে চিনতাম, যিনি মাঝে-মধ্যে আফগানিস্তানের সুন্দর জায়গাগুলোর ছবি পোস্ট করতেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-মণ্ডিত এলাকাগুলোর সেসব ছবি দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম।

আমার কাছে আফগানিস্তান মানে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি তালেবানি রাষ্ট্র। সেখানে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে জনগণকে বিশেষ করে নারীদের বাস করতে হয়। এমনকি, আমেরিকার নজরদারির মধ্যেও।

আদিবা একবার আফগানিস্তানের বামিয়ান উপত্যকায় ষষ্ঠ শতকে নির্মিত গৌতম বুদ্ধের দীর্ঘতম ভাস্কর্যের ছবি দিয়েছিলেন। জানতে চেয়েছিলাম, ২০০১ সালে তালেবানরা বোমা মেরে এটি উড়িয়ে দেওয়ার পর ঐ জায়গাটায় এখন কী আছে?

আদিবা সেখানকার একটি হতদরিদ্র অবস্থার ছবি পাঠিয়ে আমাকে বলেছিলেন, 'দেখো, কী অবস্থা হয়েছে এখন। ঐতিহ্য আর ইতিহাসকে বোমা মারার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ইতিহাস সেদিনই সেখানেই চাপা পড়ে গিয়েছিল। পাশাপাশি আমাদের ভবিষ্যতও।'

আফগানিস্তানের তালেবানরা নারীর জন্য ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়েছিল। তালেবান শাসনে আফগান নারীরা কেমন ছিলেন বা থাকতে পারেন তা স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার কৈশোরের এক স্মৃতি থেকে।

আমাদের ভবনের নিচতলায় এক ভদ্রলোক থাকতেন। তার দুই মেয়ে ছিল। তারা ছিল অসূর্যস্পশ্যা। অর্থাৎ, তাদের শরীরে কোনোদিন সূর্যের আলো লাগেনি। কোনোদিন তারা ঘরের বাইরে বের হননি, কেউ তাদের দেখেননি। একবার আগ্রহ করে আমি আমার মায়ের সঙ্গে ওনাদের দেখতে গিয়েছিলাম।

দুই তরুণীকে দেখে প্রথমে চমকে উঠি। কারণ, কোনো মানুষের এমন মৃতবৎ চেহারা আগে দেখিনি। কেমন যেন ফ্যাকাশে গায়ের রং, চোখ দুটো মৃত মানুষের মতো, চুল ছিল অনুজ্জ্বল। দুই বোনের চেহারা এত মলিন ছিল যে তা দেখে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল।

কথা বলে বুঝলাম বাইরের জগত সম্পর্কে জানার প্রবল আকুতি তাদের মধ্যে। জানতে চাইলো— কলোনিতে কী হয়, আমরা কী কী করি, মাঠে কী খেলি? স্কুলে কী করি?  ইত্যাদি। তাদের ঘরে টিভি, রেডিও, পত্রিকা, ফোন কিছুই ছিল না। অন্ধকার ঘরে লাইট জ্বলছিল দুপুর ৩টার দিকে। অথচ আমাদের কলোনিতে ছিল আলো-বাতাসের বন্যা। ওদের জানালা ছিল সিলগালা দিয়ে বন্ধ করা।

এরপর একদিন বাড়ির সামনের পুরো জায়গাটা কাপড়ে ঢেকে ঐ মেয়েদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। শুনেছিলাম তাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে। মানে তারা এক অনুজ্জ্বল পরিবেশ থেকে, আরেকটি অনুজ্জ্বল পরিবেশে চলে গিয়েছিল। ওরা এই পৃথিবীতে জন্ম নিলেও পৃথিবীর দরজা তাদের সামনে বন্ধ ছিল। ঠিক এভাবেই বিশ্বের সব দরজা আবার বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে ভয় পাচ্ছেন আফগান নারীরা।

ভয় পাওয়ারও যথেষ্ট কারণ আছে। আফগানিস্তানে আমেরিকার মিশনের পতনের পর যে অবস্থা আমরা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে কোনো মুভির শুটিং চলছে। বাস্তবে একটি দেশের ভাগ্যে এত দ্রুত এমন দুর্গতি হয় কিভাবে? এই অবস্থা দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে তাহলে গত ২০ বছর ধরে আমেরিকা আফগানিস্তানে কী মিশন চালাল?

এই দীর্ঘ মিশনকে সন্ত্রাস-নির্মূলকারী প্রচেষ্টা এবং এই অঞ্চলে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল আমেরিকা ও এর মিত্র জোট। অথচ এত কাঠ-খড় পুড়িয়ে ২০ বছরের বেশি সময় পর আবারও তালেবান যুগে প্রবেশ করলো আফগানিস্তান।

অন্যদিকে, আমেরিকা তাদের গর্ব বিসর্জন দিয়ে দুই ট্রিলিয়নের বেশি ডলার আফগানিস্তানে খরচ করে করে ২০ বছর পর এক প্রকার পালিয়েই গেল।

ব্রাউন ইউনিভার্সিটির কস্টস অব ওয়ার প্রজেক্ট জানিয়েছে, এই খরচ ২ দশমিক ২৬ ট্রিলিয়ন ডলার। মার্কিনিদের জীবনহানির চেয়ে অবশ্য অর্থ-ব্যয়ের এই সংখ্যা অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্র ধার করে আফগান যুদ্ধে খরচ যুগিয়েছে।

নারী হিসেবে শুধু ভাবছি আফগানিস্তানের সেসব নারী-শিশুর কথা যারা গত ২০ বছর ধরে স্বাধীনভাবে বড় হয়েছে, পড়াশোনা করেছে, চাকরি করেছে, বেড়াতে বেড়িয়েছে। সেই মেয়েদের চোখের ওপর এমনভাবে পর্দা টেনে দেওয়া হবে যে তারা আর আকাশ দেখতে পারবে না। কারণ, তালেবানরা এর আগে যেখানে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে, সেখানে নারীদের শিক্ষা, কাজ ও চলাফেরার স্বাধীনতা সীমিত করে দেওয়া হয়েছে।

যদিও তালেবানের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করে বলা হয়েছে, আফগান নারীরা চাইলে হিজাব পরে বাড়ির বাইরে বের হতে পারবেন। এমনকি, চাকরি ও পড়াশোনাও করতে পারবেন। আল-জাজিরা'র সংবাদেও বলেছে, নারীদের সরকার গঠনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে তালেবান কর্তৃপক্ষ। তারা বলেন, 'শরীয়া আইন অনুসারে নারী সরকারি কাঠামোতে অংশ নিবেন।' কিন্তু, অধিকাংশ মানুষই তা বিশ্বাস করতে পারছেন না। কেননা, তালেবান ইতিহাস বিপরীত কথা বলে।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবান শাসনামলে নারীদের বোরকা পরা বাধ্যতামূলক ছিল। বোরকা ছাড়া ঘর থেকে বের হলে কঠোর শাস্তি পেতে হতো। এই বোরকা দেখতে ছিল একটা চলমান কয়েদখানার মতোই। আপাদমস্তক তাঁবু দিয়ে ঢাকা, শুধু জালের মতো ডিজাইন দিয়ে চোখটা খোলা।

একজন নারীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে এমন পোশাক চাপিয়ে দেওয়াটাই কি যথেষ্ট শাস্তি নয়?

তালেবানরা অতীতে নারীর প্রতি এত অন্যায় ও অমানবিক আচরণ করেছে যে কাবুলে অভিভাবকরা তাদের ৩০ বছরের কমবয়সী নারীদের নিয়ে ভয় পাচ্ছেন। কারণ, তারা তালেবান শাসন দেখেননি। তাদের অনেকেই বোরকা পরতে চাচ্ছেন না। এ নিয়ে পরিবারগুলো খুবই উদ্বিগ্ন। আফগানিস্তানে বর্তমানে ১০ লাখ ৬০ হাজারের বেশি নারী চাকরিতে আছেন, যাদের অধিকাংশই ২০ বছর আগে চাকরিতে ছিলেন না।

তালেবানি শাসনের ভয়াবহ অতীত অভিজ্ঞতা আফগান নারীর ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করে তুলেছে।

১৯৯৮ সালের দিকে এক মা তার অসুস্থ সন্তানকে কোলে নিয়ে একাই বের হয়েছিলেন ডাক্তারের কাছে যাবেন বলে। সেই অপরাধে পথে তালেবানরা তাকে ও তার সন্তানকে গুলি করে আহত করেছিল। সেসময় একজন নারীর বাইরে যাওয়ার অধিকার ছিল না। পরিবারে কোনো পুরুষ সদস্য বাসায় না থাকলে অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গেও তিনি ডাক্তারের কাছে যেতে পারতেন না। নারীর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি— সব নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ঠিক যেন আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগ!

অতীতে তালেবান শাসনের দিনগুলোতে আফগান শিশুরাও ঘুড়ি উড়াতে বা গান গাইতে পারতো না। নারীকে ধর্ষণ, অপহরণ ও জোর করে বিয়ে— কোনটাই বাদ ছিল না। নারী ডাক্তার, নার্স, শিক্ষিকারা চাকরি হারিয়েছিলেন। মেয়েরা স্বামী, সন্তান, পিতা হারিয়ে একদিকে যেমন তালেবানদের নিয়ম অনুযায়ী অভিভাবকহীন হয়েছিল, অন্যদিকে সংসারে আয়-রোজগার বন্ধ হওয়াতে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের কাজের কোনো সুযোগ ছিল না বলে বেড়ে গিয়েছিল অভাব, অনাহার, শিশু ও মাতৃ-মৃত্যুর হার। এতে করে স্বভাবতই বেড়েছিল হতাশা ও আত্মহত্যার প্রবণতা।

তালেবানরা আসার আগে আফগানিস্তানে নারীর সম্মান ছিল। সমতার ভিত্তিতে তাদের অধিকার ও আইনগত সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। আমেরিকা ও মিত্র জোট আফগানিস্তানে অবস্থানকালে নারী সেই স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছিল সত্য কিন্তু সেই স্বাধীনতা আফগানরা কিভাবে ধরে রাখতে পারবে, এর কোনো পরিকল্পনা ছিল না। এই পরিকল্পনাহীনতার ফল আরও দ্বিগুণ হয়ে আফগান নারীকেই বয়ে বেড়াতে হবে।

আফগান নারীদের একজন বললেন, 'আফগান সমাজের পাখা দুইটা, একটি ছেঁটে দিলে সমাজটি কি বাঁচবে?'

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন কোনো কূল-কিনারা না পেয়ে বলেছেন, 'আফগানিস্তান নয়, আল-কায়দার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েছিল আমেরিকা। আমেরিকার সেনাবাহিনী প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ সামলানোর জন্য পড়ে থাকতে পারে না।' কিন্তু, আমেরিকা ট্রিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করে সেই আল-কায়দাকে কি পরাজিত করতে পেরেছে?

মার্কিনিরা কি পেরেছে আফগান নারীকে প্রকৃত আলোর সন্ধান দিতে? বরং এমন একটা অবস্থায় তারা চলে গেল যা নারীকে নিরুপায় বোধ করতে বাধ্য করেছে।

মার্কিন সরকারের যুক্তি হচ্ছে 'প্রায় ২০ বছরের যুদ্ধ আমাদের বন্ধ করতেই হবে, আমরা তাই করছি।' সেখানে কর্মরত একজন মানবাধিকার কর্মী বলেছেন, 'আফগান জনগণের জীবনমান নিয়ে ভাবা বা নারীকে আলোর পথযাত্রী করাটা কোনোদিনই আমেরিকার উদ্দেশ্য ছিল না, আমরাই বুঝতে ভুল বুঝেছি।

শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
Bank Asia plans to acquire Bank Alfalah

Bank Asia moves a step closer to Bank Alfalah acquisition

A day earlier, Karachi-based Bank Alfalah disclosed the information on the Pakistan Stock exchange.

4h ago