আইন প্রয়োজন ইসি গঠনে, পাচ্ছি সার্চ কমিটির জন্যে

প্রায় ৫০ বছরের অপেক্ষার পর খুব দ্রুততার সঙ্গে একটি বিষয় বাস্তবায়িত হচ্ছে। কিন্তু কেন? সরকার এতদিন পর্যন্ত বলে এসেছে, জাতীয় সংসদের বর্তমান অধিবেশনে নির্বাচন কমিশন আইন পাস হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাহলে হঠাৎ করে কেন এই মনোভাব পরিবর্তন এবং কেনইবা এত অবিশ্বাস্য তাড়াহুড়া?
ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

প্রায় ৫০ বছরের অপেক্ষার পর খুব দ্রুততার সঙ্গে একটি বিষয় বাস্তবায়িত হচ্ছে। কিন্তু কেন? সরকার এতদিন পর্যন্ত বলে এসেছে, জাতীয় সংসদের বর্তমান অধিবেশনে নির্বাচন কমিশন আইন পাস হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাহলে হঠাৎ করে কেন এই মনোভাব পরিবর্তন এবং কেনইবা এত অবিশ্বাস্য তাড়াহুড়া?

আওয়ামী লীগ সরকার এটার খসড়া তৈরি করে মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়েছে এবং রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে তাকে বিষয়টি জানিয়েছে এবং তিনি সেটিকে স্বাগত জানিয়েছেন। এখন আওয়ামী লিগ সরকার খসড়াটি সংসদে পেশ করবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় সংসদে খুব সম্ভবত সেটি এই অধিবেশনে পাশ করবে। তারপর অবশ্যই সময়মত উদ্যোগ নিয়ে 'সবার প্রত্যাশিত' একটি বিষয়ের নিষ্পত্তির জন্য ক্ষমতাসীন দল সরকারকে অভিনন্দন জানাবে। এরপর আওয়ামী লীগ জাতিকে নির্বাচন কমিশন আইন এনে দেওয়া উপলক্ষে দেশব্যাপী উদযাপনের ব্যবস্থা (করোনাভাইরাসের কারণে হয়তো নাও করতে পারে) করবে।

আইনমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ২৩ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে একটি বিল উত্থাপন করা হবে। এ বিল নিয়ে জনসম্মুখে কোনো আলোচনা হলো না, এই প্রক্রিয়ার মূল অংশগ্রহণকারী অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনা হলো না, জনগণের উদ্দেশ্যে কোনো ঘোষণা দেওয়া হলো না, অংশীজনদের আমন্ত্রণ জানানো হলো না, সংবিধান বিশেষজ্ঞ বা নির্বাচনী আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময় হলো না, গণমাধ্যমে কোনো আলোচনা হলো না, বস্তুত একমাত্র সরকারের একেবারে অন্দরমহলের সদস্যরা ছাড়া আর কারও সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনাই হয়নি— কিন্তু তারপরও সেটি সংসদে বিল হিসেবে উত্থাপিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত। অবশ্যই বিলটি এক ধরনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে। কোনো এক ধরনের শুনানির আয়োজন করা হবে, যেখানে জবানবন্দি দেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু মানুষকে ডাকা হবে। তবে এই প্রক্রিয়া যতই বিস্তৃত হোক না কেন, এ ধরনের বড় উদ্যোগ নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে যে পরিমাণ জনসমর্থন প্রয়োজন এবং সর্বজনবিদিত সমর্থন জোগাড় করতে যে আকারের আলোচনার প্রয়োজন, তা থেকে এই প্রক্রিয়াটি যোজন যোজন দূরে থাকবে।

হ্যাঁ, বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল একটি নির্বাচন কমিশন (ইসি) আইন চেয়েছে, কিন্তু তারা নিশ্চিতভাবেই ইসি আইনের ছদ্মবেশে 'সার্চ কমিটি আইন' চায়নি। আমাদের সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে আইন আমরা কখনোই পাইনি। আমরা চাইলে সামরিক কিংবা সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে গঠিত সরকারকে এজন্য দায়ী করতে পারি, কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকাররা কী করেছে, যারা ১৯৯১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় আছে? গত ৩১ বছরে বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ কেউই এমন কোনো আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়নি। যেটি রাষ্ট্রের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাকে শক্তিশালী করতে পারতো। একে অসংখ্য সমালোচনা ও নিন্দার হাত থেকে বাঁচাতে পারতো এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার নামে ধারাবাহিকভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়া নিকৃষ্ট নির্বাচন থেকে আমাদের বাঁচাতে পারতো।

অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে আমরা একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করেছিলাম। যেটি ১৫ বছর (১৯৯৬-২০১১) চালু থাকার পর বিলোপ করেছি। এখন পর্যন্ত আমরা যথেষ্ট স্বাধীন, নিশ্চিত আইনি ও নৈতিক কাঠামো এবং মর্যাদাসম্পন্ন নির্বাচন কমিশন গঠনের সহজ কাজটি করার মতো সময় বের করতে পারিনি— যে প্রক্রিয়ায় অন্যান্য দেশ বছরের পর বছর ধরে নির্বাচন করে যাচ্ছে। এর পেছনে একটি কারণ আছে, কোনো ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ হারাতে চায়নি। যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রকারান্তরে এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাটির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে চায়নি কেউ। এই সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কে বা কারা সেটি চালাবে, তা ঠিক করে দেওয়ার চেয়ে ভালো আর কী পদ্ধতি থাকতে পারে? এ কারণেই গত ৫ দশকে আমরা কোনো নির্বাচন কমিশন আইন প্রণীত হতে দেখিনি। এই মনোভাবের কী পরিবর্তন হলো?

যদি আমরা মনে করি 'নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো', তাহলে নিঃসন্দেহে সার্চ কমিটি আইন চালুর প্রক্রিয়ায় উল্লসিত হওয়ার মতো 'কিছু' একটা কারণ আছে। তবে এই 'কিছু' যদি প্রত্যাশার চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন কিছু হয়, তাহলে খুব সম্ভবত এটি আলোচ্য সমস্যার সমাধানের বদলে পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তুলবে। সে ক্ষেত্রে সম্ভবত আমাদের উল্লসিত না হয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত।

সংক্ষেপে আমরা জেনে নিই, আসলে কী ঘটছে। নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য আমাদের একটি আইনের প্রয়োজন ছিল, যার জন্য আমাদের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু এখন আমাদের সামনে একটি আইন চালু করার প্রস্তাব আনা হয়েছে, যেটি সংবিধানে চাওয়া হয়নি। তাহলে আমরা কেন সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা পূরণ না করে এমন কিছু করছি, যেটি করার জন্য আমরা দায়বদ্ধ নই।

আমাদের দেশে নির্বাচন নিয়ে কারসাজির যে ইতিহাস আছে, সে প্রেক্ষাপটে স্বভাবতই এই উদ্যোগের পেছনের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন জাগে।

এ ক্ষেত্রে সরকারের উত্তর হচ্ছে, আমরা মূল বিষয়টি অনুধাবন করছি না। ৫০ বছরে যে কাজ হয়নি, সে কাজের দিকে প্রথম উদ্যোগ নেওয়ায় সরকারের প্রশংসা না করে আমরা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। ধারণাটি এরকম, সার্চ কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে উপযুক্ত প্রার্থীদের বিষয়ে সুপারিশ করবে, যার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেবেন।

গণমাধ্যমে যে পরিমাণ তথ্য পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতে বলা যায়, সার্চ কমিটির প্রধান হবেন আপিল বিভাগের একজন বিচারক, যার মনোনয়ন দেবেন প্রধান বিচারপতি। আরেকজন সদস্য হবেন হাইকোর্টের একজন বিচারক। সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) চেয়ারম্যান ও প্রধান হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) তাদের পদাধিকারবলে সদস্য হবেন। পরিশেষে ৬ সদস্যের কমিটি পূর্ণ করতে রাষ্ট্রপতি সেখানে ২ জন সদস্যের মনোনয়ন দেবেন।

কমিটির সদস্য হিসেবে প্রস্তাবিত সম্মানিত ব্যক্তিদের বিষয়ে ন্যূনতম সন্দেহ না রেখে এবং তাদের পেশাদারিত্ব ও যোগ্যতার প্রতি সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মান রেখে বলা যায়, তারা সবাই রাজনীতি ও ব্যাপকভাবে গণমানুষের সঙ্গে কাজের জগতের বাইরের মানুষ। নির্বাচন আয়োজন করা একটি বড় আকারের জনসম্পৃক্ত কাজ। কলেবরের দিক দিয়ে এটিই সম্ভবত সবচেয়ে বড় কাজ এবং এর আয়োজন করা কোনো আমলা বা কর্মকর্তার জন্য মুখের কথা নয়। এই অত্যন্ত যোগ্য মানুষগুলো, যারা তাদের কর্মজীবনের শীর্ষ পর্যায়ে আছেন, ইতোমধ্যেই সঠিক 'চ্যানেল' ও 'সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার' মাধ্যমে কাজ করে অভ্যস্ত। তারা আইনি অথবা আমলাতান্ত্রিক গোলকধাঁধার সমাধানে অত্যন্ত দক্ষ, কিন্তু তারা নির্বাচন আয়োজনের মতো অগোছালো কাজের জন্য প্রশিক্ষিত নন। অর্থাৎ, তারা তাদের নিজেদের মতাদর্শের মানুষের সঙ্গে কাজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন এবং তাদেরকেই নির্বাচন করবেন, এমনটা ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু তাদের ওপর যে গুরুদায়িত্ব অর্পিত হবে, যে দায়িত্ব পালনের জন্য তাদের কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা বা অভ্যস্ততা নেই এবং খুব সম্ভবত তারা এমন একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারবেন না, যেটি জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে। বিচারকরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিপিএসসির চেয়ারম্যান এবং সিএজি প্রতিষ্ঠিত ও নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিজ নিজ কার্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তাদের কাউকেই রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা ও সাধারণ জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন নিয়ে কাজ করতে হয় না এবং ভিন্ন মতাবলম্বী গোষ্ঠীদের মধ্যে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা, নিদেনপক্ষে তাদেরকে একই পতাকার নিচে আনার কাজও তারা করেন না। কিন্তু একটি উচ্চ পর্যায়ের সংবেদনশীল রাজনীতি সংশ্লিষ্ট কাজে এ ধরনের দক্ষতাসম্পন্ন মানুষ কতটুকু উপযুক্ত, তা ভেবে দেখার বিষয়।

এটা বস্তুত ঠুঁটো জগন্নাথ ছাড়া আর কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

তারপর রয়েছে তাদের কার্যপ্রণালী সংক্রান্ত বিষয়গুলো। তারা কতটুকু স্বাধীনতা পাবেন? কতটা খোলাখুলি ও স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করবেন? ধরে নেওয়া যাক, তাদের সব কার্যক্রম জনসাধারণের সামনে উন্মুক্ত থাকবে, তারপরও কীভাবে তারা চূড়ান্ত সুপারিশগুলো দেবেন? সেগুলো কি গোপনে জমা দেওয়া হবে? আমরা মনে করি সার্চ কমিটি সুপারিশ করেছে এরকম পূর্ণাঙ্গ নামের তালিকা ও তাদের কেন সুপারিশ করা হয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জনগণের কাছে প্রকাশ করা উচিত। সেটি না করা হলে আমরা কখনোই জানতে পারব না কমিটি কাদেরকে পছন্দ করেছিল এবং চূড়ান্ত নিয়োগের সময় কাদের এবং কেন বাদ দেওয়া হয়েছিল।

সুপারিশগুলো যখন রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পৌঁছায়, তখন আরও বেশ কিছু নতুন প্রসঙ্গের অবতারণা হয়। সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি সব বিষয়ে (দুটি সর্বজনবিদিত বিষয় ছাড়া) শুধু প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ অনুযায়ী কাজ করতে পারবেন। ভিন্ন দুটি বিষয় হলো, 'সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) ধারা অনুযায়ী কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) ধারা অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।' অর্থাৎ, নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের নাম চূড়ান্ত করার সময় প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রপতির পছন্দ অনুযায়ী কাউকে নিয়োগ দেওয়ার এখতিয়ার নেই, তিনি শুধু প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ অনুযায়ী কাজ করতে পারবেন। সুতরাং, প্রক্রিয়াটি যেরকমই হোক না কেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকেই আসে। কীভাবে তিনি এ ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন, সেটা তার নিজস্ব বিষয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তিনি সাংবিধানিক ক্ষমতার অধিকারী।

পাদটীকা: আইনের মাধ্যমে অতীতের ভূমিকার দায়মুক্তি একটি নিকৃষ্ট আইনি চর্চা। যেটি সাধারণত সামরিক একনায়ক এবং স্বৈরাচারী শাসকরা তাদের অতীতের অপকর্মকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য ব্যবহার করে থাকেন। অতীতের নির্বাচন কমিশনাররা কী এমন কিছু করেছেন, যার জন্য তাদেরকে দায়মুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে? এমন কোনো অবৈধ কাজ কী সংঘটিত হয়েছে, যেগুলোকে এখন আইনি ভিত্তি দেওয়া দরকার? আমার অনুরোধ, সে পথে যাবেন না। এটা খুবই খারাপ উদাহরণ তৈরি করে।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
books on Bangladesh Liberation War

The war that we need to know so much more about

Our Liberation War is something we are proud to talk about, read about, and reminisce about but have not done much research on.

10h ago