বঙ্গবন্ধু ও সহমর্মিতা

Empathy শব্দের অর্থ মানুষের প্রতি দরদি হওয়া, সাহায্য করার ইচ্ছা করা, অপরের বেদনা নিজের ভেতর অনুধাবন করা। এভাবে নিজের সঙ্গে অপরের ব্যবধানকে কমিয়ে আনা- যাতে মানুষের কাছাকাছি পৌঁছানো যায়। বঙ্গবন্ধুর প্রকাশিত রচনাগুলি পড়েছেন বা তার বক্তৃতা শুনেছেন এমন যে কারো কাছেই বঙ্গবন্ধুর এই চারিত্রিক গুণাবলী ধরা দিবে। এই গুণাবলী তাকে বাংলাদেশের সর্বত্র মানুষের কাছাকাছি নিয়ে গেছে এবং নেতৃত্বে আসীন করেছে। বঙ্গবন্ধুর দরদী মনই মানুষের হৃদয় জয় করেছিল।

Empathy শব্দের অর্থ মানুষের প্রতি দরদি হওয়া, সাহায্য করার ইচ্ছা করা, অপরের বেদনা নিজের ভেতর অনুধাবন করা। এভাবে নিজের সঙ্গে অপরের ব্যবধানকে কমিয়ে আনা- যাতে মানুষের কাছাকাছি পৌঁছানো যায়। বঙ্গবন্ধুর প্রকাশিত রচনাগুলি পড়েছেন বা তার বক্তৃতা শুনেছেন এমন যে কারো কাছেই বঙ্গবন্ধুর এই চারিত্রিক গুণাবলী ধরা দিবে। এই গুণাবলী তাকে বাংলাদেশের সর্বত্র মানুষের কাছাকাছি নিয়ে গেছে এবং নেতৃত্বে আসীন করেছে। বঙ্গবন্ধুর দরদী মনই মানুষের হৃদয় জয় করেছিল।

বঙ্গবন্ধুর রচনাগুলোয় সহানুভূতিশীল অনুভূতির অফুরন্ত প্রমাণ আছে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে মিলবে মানুষের ও প্রকৃতির প্রতি সহানুভূতির মানসিকতা ও যত্ন নেওয়ার উদাহরণ। আমরা সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত এবং গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলো মধ্যে একটা পেয়েছিলাম ৩ মে ১৯৭৩ সালে তার ব্যক্তিগত নোটবুকে। ইংরেজিতে তিনি যখন লিখেছিলেন- 'একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।' ব্যক্তিগত নোটবুকে এই লেখাগুলোই তাকে সবচেয়ে হৃদয়বান ব্যক্তি ও সমস্ত নেতার অভিভাবক বা পিতৃপুরুষরূপে সামনে এনেছে।

'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে আমরা দেখতে পাই, ১৭ বছর বয়সী যুবক তার শিক্ষকের পরামর্শে গোপালগঞ্জের মুসলিম ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতে উদ্যোগী হয়েছেন। ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে, বঙ্গবন্ধু কলকাতা শহরের পাশাপাশি নিজ শহর গোপালগঞ্জে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের কষ্ট দূর করতে চেষ্টা করেছেন। বেশ কয়েকটি 'লঙ্গরখানা' খোলার প্রচেষ্টায় সহপাঠীদের সঙ্গে উদ্যোগী হন। সেই সময়ই তিনি অনুভব করেছিলেন, মুসলিম লীগ ধনীদের পয়সায় পরিচালিত হচ্ছে। ফলে প্রথমদিকে তিনি মুসলিম লীগের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু, পরবর্তীকালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সংস্পর্শে এসে মুসলিম লীগে যোগদান করেন, কারণ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন একজন সহানুভূতিশীল উদার মনের মানুষ।

১৯৪৬ সালের কলকাতার দাঙ্গায় আমরা বঙ্গবন্ধুকে আক্রান্ত মুসলমানদের যেভাবে রক্ষা করতে দেখেছি, দাঙ্গায় আটকে পড়া হিন্দুদেরও সেভাবে উদ্ধার করতে দেখেছি। তিনি তিরস্কার করেছেন সেইসব মানুষদের যারা দাঙ্গার সময়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সহিংস হয়েছে তথা মানবিক গুণাবলী হারিয়েছে। কলকাতার পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে তিনি দ্রুত বিহার রিফিউজি ক্যাম্পে চলে যান এবং সেখানে ত্রাণ বিতরণে যুক্ত হন। এখানেও বরাবরের মতোই তার সহানুভূতিশীল হৃদয় তাকে পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতে উৎসাহিত করেছে।

কলকাতা ও বিহারের দাঙ্গার কঠিন সময় থেকে এবং দেশভাগের ফলে ঘটে যাওয়া রক্তাক্ত ঘটনাগুলোর শেষে যে শিক্ষা বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন তা পরবর্তীকালে তিনি সবার কাছে পৌঁছে দেন। এই শিক্ষাই ১৯৪৭ সালে ঢাকায় চলে আসার পর তার অন্যতম রাজনৈতিক দর্শনে পরিণত হয়, যেটা হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। তিনি লিখেছেন, 'আমাদের সময়ের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় হলো, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা।'

ঢাকায় এসে আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধু কীভাবে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ছাত্র রাজনীতিতে থাকাকালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার আন্দোলনে যুক্ত থাকার পাশাপাশি তিনি ফরিদপুর, কুমিল্লা, ঢাকা ও খুলনায় শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনেও শামিল হন।

সে সময় অভিবাসী ও মৌসুমি শ্রমিকদের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও সরকার নির্বিচারে 'করডন' সিস্টেম প্রয়োগ করেছিল। সরকারের এই অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে তিনি বঞ্চিত দরিদ্র মানুষের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মুসলিম লীগ নানান স্বেচ্ছাচারী পদক্ষেপের মাধ্যমে জনগণ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বাংলা ভাষার জন্য মুসলিম লীগের কোনো আবেগ অথবা অনুভূতি নেই। বঙ্গবন্ধু যখন বুঝতে পারলেন, বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের কষ্ট লাঘব করার জন্য মুসলিম লীগ কিছুই করবে না, তিনি দল ত্যাগ করেন। বঞ্চিত মানুষদের অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। প্রকৃতপক্ষে, জনগণের মানুষ বঙ্গবন্ধু; তিনি কীভাবে মুসলিম লীগারদের সঙ্গে থাকতে পারতেন?

সেই সহমর্মিতা-সহানুভূতি; এখানে এবং সর্বত্র; বঙ্গবন্ধুকে ভালো কাজে অনুপ্রাণিত করেছে এবং তার রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলো পরিচালনা করেছে। বঞ্চিত জনগণের জন্য সর্বদা ত্যাগ করতে রাজি ছিলেন। যেমনটি তিনি লিখেছেন, 'আমি এই সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছি যে, রাজনীতি করতে হলে, জনগণকে খুশি করতে হলে, বিশাল ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।' নিজের সহজাত প্রবৃত্তি এবং মুসলিম লীগের ব্যর্থতা পর্যবেক্ষণ করে তার মতো একজন বাঙালি ও সত্যিকার অর্থেই সফল নেতা সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, 'ভালো আচরণ, ভালোবাসা এবং সহানুভূতি দিয়ে মানুষের মন জয় করা যায়; ঘৃণা বা জোর করে, অত্যাচার বা নিপীড়ন করে নয়।'

'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র একটি আকর্ষণীয় অনুচ্ছেদ হলো, বঙ্গবন্ধুর ইকো-ক্রিটিক্যাল চেতনার বহিঃপ্রকাশ। ১৯৫২ সালে তিনি যখন প্রথম করাচি ভ্রমণ করেন তখন তার সামনে ছড়িয়ে থাকা পশ্চিম পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ মরুভূমির 'নির্মম প্রাকৃতিক দৃশ্য' দেখে তার মনে হয়েছিল, 'আমরা জন্মগ্রহণ করেছি সবুজের দেশে, যেদিকে তাকাই সবুজের মেলা। মরুভূমির এই পাষাণ বালু আমাদের পছন্দ হবে কেন? প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মতো উড়ে বেড়ায়। আর পলিমাটির বাংলার মানুষের মন, ওই রকমই নরম, ওই রকমই সবুজ। প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম, সৌন্দর্যই আমরা ভালোবাসি।' এই ধরনের মন, প্রকৃতির প্রতি এই ভালোবাসার প্রকাশ ভূমি ও ভূমির মানুষের প্রতি সহানুভূতি জাগিয়ে তোলে।

বঙ্গবন্ধু স্পষ্টতই নিঃস্পৃহ আবেগপ্রবণ ও দেশপ্রেমিক ছিলেন। কতটা আবেগপ্রবণ ও দরদী, তার একটা উদাহরণ বইটির শেষে পাওয়া যাবে। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে তার নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণা চলাকালীন একজন দরিদ্র বৃদ্ধ নারীর সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার একটি ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন। ওই নারী কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন কারণ তিনি শুনেছিলেন বঙ্গবন্ধু তার এলাকায় আসবেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে হাত ধরে টেনে নিয়ে তার কুঁড়েঘরের মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিলেন। এক বাটি দুধ, একটা পান আর চার আনা পয়সা দিলেন আসন্ন নির্বাচনে খরচ করার জন্য। দুধটুকু খেয়ে সব কথা শুনে বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, 'আমি যখন ওনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি, আমার চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল। সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।'

বঙ্গবন্ধুর প্রারম্ভিক জীবন এবং ওই সময়কে বোঝার জন্য 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' একটি মূল্যবান উৎস। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং দরদী হৃদয়কে উপলব্ধি করতে হলে তার প্রকাশিত অন্যান্য রচনাগুলোও পাঠ করা জরুরি। তার চেতনা ও মহানুভবতা সম্পর্কে আরও জানতে হলে, 'কারাগারের রোজনামচা' পড়া অপরিহার্য।

'কারাগারের রোজনামচায়' পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেল, রাজনীতিবিদ ও তাদের পূর্ব পাকিস্তানি দোসররা; যারা বঙ্গবন্ধুকে রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ করতে চেয়েছিল; যাদের কারণে তিনি কারাভোগ করেছিলেন; দীর্ঘ কারাবাসের সেই জীবনের বিভিন্ন সময়ের চিত্র পাওয়া যায়। যেখানে তার পরোপকারী মন ও আলোকিত ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠে।

'কারাগারের রোজনামচা'য় প্রকাশিত ৪টি নোটবুকের মধ্যে প্রথমটিতে কারাগার ও কারাজীবনের বিস্তারিত বর্ণনা আছে। যে কেউ বইটি পড়লে আলোকিত হবেন। সেখানে দেখা যায় কারাগারের ভেতরে কয়েদিদের মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে কতটা পর্যবেক্ষক, চিন্তাশীল, অন্তর্দৃষ্টি পূর্ণ এবং কখনো কখনো হাস্যরসাত্মক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পাশাপাশি, কারাগারের অযাচিত নিয়ম শৃঙ্খলা ও ক্ষমতা প্রয়োগকারী রাষ্ট্রযন্ত্রের সমালোচনা করেছেন তিনি। পাঠ করলে যে কেউ খেয়াল করবেন, কয়েদিদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর সহমর্মিতা। বিশেষত জেলে বন্দী থাকা ওই পাগলের কথা। বঙ্গবন্ধু স্পষ্টতই লিখেছেন, 'সমাজ মানুষকে বন্দী করে রাখাকে সহজ মনে করে কিন্তু উচিত ছিল মানুষকে ভালো করে তোলার চেষ্টা করা, শাস্তি দেওয়া নয়।'

এখানে লক্ষণীয় যে, বঙ্গবন্ধু কারারক্ষীদের প্রতি হতাশ ছিলেন, কারণ তারা কয়েদিদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং দুর্ব্যবহার করত। তাই কারারক্ষীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কয়েদিদের শান্ত করতে অন্যান্য মানবিক পদ্ধতি ব্যবহার করার সুপারিশ করেছিলেন। বন্দীদের সঙ্গে কথা বলা, তাদের পরামর্শ দেওয়া- এমনসব পদক্ষেপের মাধ্যমে বন্দীদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করার জন্য তিনি এই নোটবুক ও অন্যান্য নোটবুকে লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুর সহানুভূতিশীল বিবরণ পাঠ করলে ভালোভাবেই বোঝা যায়, 'একজন মানুষ; বন্দী হওয়ার জন্য জন্মায়নি। অন্যায় ও অসম্মানজনক সিস্টেমগুলোই তাদেরকে বন্দী করে রাখে।'

'কারাগারের রোজনামচা'র বাকি ৩টি নোটবুক মূলত ষাটের দশকের শেষদিকে বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনকে তুলে ধরেছে, যখন পূর্ব পাকিস্তানিরা তার দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং আত্মত্যাগের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ধীরে ধীরে বাংলাদেশি হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এই নোটবুকগুলোরও সর্বত্র পাঠকরা একজন যত্নশীল, পরোপকারী, সহানুভূতিশীল ব্যক্তির দেখা পেতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু অন্যের কষ্ট লাঘবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবসময়ই এগিয়ে যেতেন। নোটবুকের ৯ জুন ১৯৬৬ সালের দিনটিতে আছে, পুলিশের মারাত্মক পিটুনিতে জখম হয়ে জেলে নিক্ষিপ্ত হওয়া কয়েকজন যুবকের জন্য তার উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। যেসব কারারক্ষী বঙ্গবন্ধুকে সম্মান করত তাদের তিনি বোঝানোর চেষ্টা করলেন যাতে এই যুবকদের শারীরিকভাবে নির্যাতন বন্ধ করা হয় এবং তাদের গোসল ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু কারা অন্তরীণ থাকা অবস্থায় বাইরের খবরাখবর জানার প্রধান মাধ্যম ছিল পত্রিকা। জেলে তিনি যতই পত্রিকা পড়তেন ততই তিনি তার জনগণের দুর্দশার কথা ভাবতেন। সে বছর ব্যাপক বন্যা হয়েছিল। বন্যা নিয়ে একটি রিপোর্ট পত্রিকায় পড়ে বাঙালির দুর্দশার কথা ভেবে বঙ্গবন্ধু হতাশ হয়েছিলেন এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন সরকারের প্রতি নিজের ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করেছিলেন। 'কেন সরকার দেশবাসীকে অনাহারে রেখেছে এবং বন্যার ব্যাপারে উদাসীন রয়েছে?' 'সরকার বিড়ি আমদানি বন্ধ করে কেন বিড়ি শ্রমিকদের বেকারত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে?' জেলখানায় তার স্ত্রী বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার নিয়ে এলে, তিনি সেগুলো অন্য কয়েদিদের সঙ্গে ভাগ করে খেতেন। ১৯৬৭ সালের ২৮-৩০ এপ্রিলের ডায়েরিতে দেখা যায়, তিনি তার জেল কোটা সুবিধা ব্যবহার করে বাড়ি থেকে অতিরিক্ত খাবার আনাচ্ছেন। এমনকি রান্না করা এক পাতিল খিচুড়ি তিনি তার আশেপাশের কয়েদিদের এবং কারারক্ষীদের মাঝে বিতরণ করেছেন।

'কারাগারের রোজনামচা'র একটি চিত্তাকর্ষক দিক হলো বঙ্গবন্ধুর পাখিপ্রেম। আগের মেয়াদে কারাভোগ করার সময় দুটি হলুদ পাখি তখন তিনি নিয়মিত দেখতে পেতেন। কিন্তু ১৮ জুন ১৯৬৬ সালে এই মেয়াদে, কারাভোগের সময় এসে এদেরকে তিনি যখন দেখেননি- তিনি তার সম্পর্কে পাখিদের অনুভূতির কথা কল্পনা করছিলেন। মাঝের বেশ কয়েক বছর বঙ্গবন্ধু কারাগারে ছিলেন না। পাখিরা তাই তাকে পায়নি। তিনি এ কারণে লিখেছেন, 'মনে হলো ওরা আমার উপর অভিমান করে চলে গেছে।'

এর কিছু পরে আমরা দেখি বঙ্গবন্ধুর আনন্দ। একটি মুরগি ও তার ছানা এবং একটি কবুতরের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়েছে। দিনের বেলায় যখন কারা প্রকোষ্ঠের বাইরে আসার অনুমতি দেওয়া হয় তখন পরিবেশ সচেতন বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেন, 'গাছপালা, হলদে পাখি, চড়ুই পাখি আর কাকই তো আমার বন্ধু এই নির্জন কারা প্রকোষ্ঠে।' প্রহরী এবং অন্যরা যেন কবুতরদের বিরক্ত না করে সেজন্য তিনি তাদের দেখে রাখতেন। একমাত্র শত্রু ছিল কাক, যারা তাকে বিরক্ত করত। যদিও কাক শত্রু তবুও তার মনে হলো আমরা কাকের কাছ থেকে একটি শিক্ষা নিতে পারি। যখন তিনি দেখেন ৩টি ছোট কাক একত্রে মিলে একটি বড় আগ্রাসী দাঁড় কাককে হটিয়ে দেয়। শিক্ষাটা হলো, 'বাঙালি একতাবদ্ধ হয়ে যদি দাঁড় কাকদের মতো শোষকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত তবে নিশ্চয়ই তারাও জয়লাভ করত।'

বঙ্গবন্ধুর সহমর্মিতা ও তার যত্নশীল স্বভাব এবং যেকোনো উপায়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর ক্ষমতা প্রচুর পরিমাণে তার লেখায় দেখা যায়, এর সর্বশেষ প্রকাশিত 'আমার দেখা নয়াচীন' বইতে। গণচীনে তিনি পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য গিয়েছিলেন। গণচীনের বিপ্লবী নেতা ও তৎকালীন চেয়ারম্যান মাও সেতুংয়ের আমন্ত্রণে এক নৈশভোজে যোগ দেওয়ার পর মাও সেতুং সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ভাবনার কথা তিনি বইতে উল্লেখ করেছেন।

তিনি লিখেছেন, 'কেন চীনের ৬০০ মিলিয়ন মানুষ মাওকে এত ভালোবাসে?' উত্তরও বঙ্গবন্ধুই দিচ্ছেন এই ভাবে, 'তিনি তাদের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তার জনগণ তাকে ভালোবাসে এবং বিশ্বাস করে। কারণ মাও সেতুং এমন একজন যে তার দেশ এবং তার জনগণকে ভালোবাসে।' বইটির অন্য এক জায়গায় আছে, বঙ্গবন্ধু চীনের শ্রমিকদের আবাসস্থল পরিদর্শন কালে এক নব দম্পতিকে উইশ করার জন্য তিনি তার প্রিয় আংটিটি উপহার হিসেবে দিয়ে দেন। কারণ বঙ্গবন্ধু খালি হাতে কারো বাড়িতে অতিথি হয়ে যেতে পারেন না।

চীন সফরের সর্বত্র বঙ্গবন্ধু ভাবতেন কীভাবে চীনের বিপ্লবী সরকারের সাফল্য থেকে শিক্ষা নিয়ে তার নিজের দেশকে পরিবর্তন করা যায়। যখন তিনি হাস্যোজ্জ্বল সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী চীনা শিশুদের দেখলেন, তখন তাৎক্ষণিকভাবে 'তার দেশের দুর্ভাগা শিশুদের' কথা মনে হলো। যখন তিনি নবজাগৃত চীনের নারীদের কথা ভাবেন তখনই তার মনে হতে থাকে, 'আমার জন্মভূমি এমন একটি জায়গা, যেখানে একসময় অনাহারে নারীদের মৃত্যু হতো।'

নানজিং এ তিনি তার প্রতিনিধি দলের বাচ্চাদের সঙ্গে খেলায় মেতে উঠেন, এমনকি তাতে, তাদের দলের সফর বিলম্বিত হয়। আসলে, তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব, যার কাছে ছেলে-বুড়ো সবাই সহজেই পৌঁছাতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু তাই এইখানে লিখেছেন, 'আমি শিশুদের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসি।'

যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনে চীন যে সাফল্য দেখিয়েছে তা দেখে বঙ্গবন্ধু দেশের এমন সব নারীদের কথা ভাবতে থাকেন।

এখানে আমরা স্মরণ করতে পারি, কীভাবে বঙ্গবন্ধু তার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা এড়িয়ে গিয়েছিলেন; যাতে তিনি ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সেবায় ত্রাণ বিতরণ কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারেন। যৌতুকের টাকা জোগাড় করতে না পেরে যেসব বাবা-মা তাদের মেয়েদের বিয়ে দিতে পারছেন না সেইসব মেয়েদের দুর্দশার কথা ভেবে বঙ্গবন্ধু চিন্তিত হয়ে পড়েন। সিদ্ধান্ত নেন যে, দেশে ফিরে সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করবেন।

প্রকৃতপক্ষে, ১৯৫২ সালের চীন সফরের বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠা চীনা নারীদের নিয়ে লেখা। কারণ চীনা নারীদের ভাগ্য পরিবর্তন থেকে শিক্ষা নিয়ে কীভাবে বাঙালি নারীদের ভাগ্য পরিবর্তন করা যায়, তার প্রতিফলন সেখানে রয়েছে। নারীদের বিষয়ে বিশ্বাস করতেন 'একটি জাতির অর্ধেক জনগোষ্ঠী সন্তান জন্ম দেওয়া ছাড়া আর কিছুই না করে; তাহলে সেই জাতি কখনোই বিশ্ব দরবারে মর্যাদা লাভ করতে পারবে না।

নোটবুকের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর ৩টি বই রচনা করেছিলেন তার নানা মেয়াদে কারাবাসের সময়। সেখানে বঙ্গবন্ধু তার সময়ের চিত্র তুলে ধরেছেন। এমন একজন ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করেছেন যার অপরকে ভালোবাসার ও অপরের প্রতি সহমর্মিতার অসাধারণ হৃদয় ছিল। মানব কিংবা অ-মানব; সমস্ত জীবের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার প্রবণতা তার ছিল। অন্যের প্রতি যত্নশীল হওয়ার স্বভাবই বারবার তার বইতে পাই। সঙ্গে দেখতে পাই কীভাবে তিনি নিপীড়িতদের পাশে বারবার দাঁড়িয়েছেন এবং বঞ্চিত ও দুঃখী মানুষের অধিকার আদায়ে নিজেকে নিযুক্ত করেছেন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে; এমনকি কারাগারে থাকাকালে পশুপাখিদের দুর্দশায় অনুভব করার চেষ্টারত থাকতে দেখেছি। পরিবারের পুত্র, স্বামী কিংবা পিতা হয়েও পরিবারের সবাইকে ছেড়ে, অন্যদের সাহায্য করতে এগিয়ে গেছেন এবং বাংলাদেশের পরাধীন ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বারবার কারাগারে গিয়েছেন।

এইভাবে আমরা মনে রাখি সহানুভূতিশীল এবং বড় মনের একজন মানুষকে। অথচ তার পরিবারের ২ সদস্য ছাড়া সবাইকে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। যারা এটা করেছিল যাদের মনে নিশ্চয়ই বিন্দুমাত্র Empathy ছিল না। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে আমরা আমাদের জাতিকে সর্বাধিক উন্নতির দিকে নিয়ে যাই।

অধ্যাপক ফকরুল আলম: অনুবাদক ও পরিচালক 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড লিবার্টি'

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন হাসান নিটোল

Comments

The Daily Star  | English

Schools to remain shut till April 27 due to heatwave

The government has decided to keep all schools shut from April 21 to 27 due to heatwave sweeping over the country

1h ago