04:07 PM , Dec 07, 2016
04:07 PM , Dec 07, 2016 / LAST MODIFIED: 04:07 PM , Dec 07, 2016

মতামত: সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ জনপ্রশাসনও জরুরী

মনোয়ারুল হক

মতামত: সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ জনপ্রশাসনও জরুরী

আজকের পত্রিকা থেকে জানা গেল আগামী কয়েকদিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে নির্বাচন কমিশন গঠন করার বিষয়ে আলোচনা করবেন।

বর্তমানের নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য অনুসন্ধান কমিটি দিয়ে তল্লাশি চালিয়ে নির্বাচন কমিশন সদস্য ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করা হয়। আর সেই নাটকের যবনিকা হতে যাচ্ছে আগামী মাসে। এই সব নির্বাচন কমিশন সদস্য এতই যোগ্য যে হাইকোর্টের এক আদেশে বিদায়ের আগে সশরীরে হাজির হয়ে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছেন। এ ঘটনা পৃথিবীতে বিরল।

আমাদের সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর মতামতের প্রতিফলন ঘটান। সংসদের বক্তৃতাসহ সবগুলি সাংবিধানিক পদে নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নথি অনুসারে সম্মতি দেওয়াই আমাদের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব এবং এর বাইরে কিছুই করার নেই। বিচারপতি নিয়োগ কিংবা সরকারি কর্ম কমিশন সদস্য, নির্বাচন কমিশন সদস্য সবই চূড়ান্ত মনোনয়ন প্রদান করেন রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর মত অনুসারে।

দলীয় সংসদ সদস্যদের ভোটে আমাদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

বর্তমানের এই সাংবিধানিক বিধান ১৯৯১ সালের পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যৌথভাবে পাশ করেছিল। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে এবং পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি চালু করে। সেই সংবিধান সংশোধনের সময় উল্লেখ করা হয় কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রীর লিখিত সুপারিশে রাষ্ট্রপতি সংসদ বাতিল করতে পারবেন।

এই হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা। এ কথা দেশের সকল রাজনৈতিক দল জানে। তার পরও রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচন কমিশন গঠন করার প্রশ্নে কেন ধরনা দেওয়া? নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ থাকলেই কি নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব?

এক্ষেত্রে যে বিষয়টা জরুরী তা লক্ষ্য করা দরকার। দেশের যে কোন নির্বাচনে মাঠ পর্যায়ের দায়িত্ব পালন করেন দেশের প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা ও পুলিশ প্রশাসন। প্রতিটি নির্বাচন কেন্দ্রের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকে পুলিশ প্রশাসন আর কেন্দ্রের ভিতরে দায়িত্ব পালন করেন স্থানীয় প্রশাসনের মনোনীত ব্যক্তি বর্গ। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী যারা নির্বাচন পরিচালনা করেন তারা যদি নিরপেক্ষতা রক্ষা না করেন তা হলে নির্বাচন নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। স্থানীয় প্রশাসন কিংবা পুলিশ প্রশাসনের নিরপেক্ষ থাকার জন্য আমাদের সংবিধানের কোন বিধান নেই।

১৯৭২ সালের সংবিধান রচনা কালেই বিষয়টা উপেক্ষিত হয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানে উল্লেখ আছে:

--সিভিল সার্ভিস আইন করিতে হইবে

স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও সেই আইন আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা এরশাদের জাতীয় পার্টি কেউই করেনি। যে কারণে প্রজাতন্ত্রের কোন প্রশাসনিক কর্মকর্তা কিংবা পুলিশ প্রশাসনের পক্ষে নিরপেক্ষ থেকে কাজ করা সম্ভব হয় না। নির্বাচন হোক বা প্রশাসনিক সাধারণ বিষয় হোক যে কোন বিষয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নির্দেশের বাইরে কোন দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয় না। প্রশাসনের কর্মকর্তা কিংবা পুলিশ অগ্রাধিকার বাইরে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসাবে দায়িত্বে পালন করতে চাইলে রাজনৈতিক দলের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে প্রথমে ওএসডি ( officer on special duty) অর্থাৎ কর্মবিহীন করে বসিয়ে রাখা হয়।

এখানে জানা দরকার ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে কর্মচারীদের (OSD) করা সম্ভব নয়। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জন্য আইনি বিধান ভারতের স্বাধীনতার কিছু সময় পরেই করা হয়েছে।

এর সাথে আছে প্রশাসনের যে কোন কর্মকর্তাকে মধ্য বয়সে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর বিধান। যে কোন কর্মচারীর চাকরির বয়স যদি ২৫ বছর হয় তবে সরকার চাইলে তাকে অবসরে পাঠাতে পারবে। এ ধরনের কোন বিধান ভারতের কর্মচারীদের ক্ষেত্রে নেই।

ভারতে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা যে কোন রাজ্যর নির্বাচনকালীন অথবা জাতীয় নির্বাচনের সময় ওই রাজ্যের যে কোন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী যারা নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালন করেন তারা নির্বাচনের সময় যদি নিরপেক্ষভাবে কাজ না করেন তাহলে তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে সেই ঘটনা নির্বাচন কমিশনের রিপোর্টে উল্লেখ করা থাকে ও প্রয়োজনে এর থেকে ও বেশি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন। আর তা ওই কর্মকর্তার বাকি কর্মজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। এমনকি প্রমোশন বন্ধ হয়ে যায়।

(ভারতের উদাহরণ দেওয়া হলো এ কারণে যে ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ, তাদের ব্যবস্থা কি তা জানার জন্য।)

এই বিধানের মাধ্যমে গত ২৬ বছরে রাজনৈতিক দল বিশেষভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকার, প্রশাসনের বহু কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর অথবা কর্মবিহীন করে রেখেছে।

৯০ সাল থেকে এভাবেই চলছে দেশ। এই সময় বিএনপি দুইবারে ১০ বছর ক্ষমতায় থেকেও কোন দিন সংবিধানের ওই দিক নির্দেশনা কার্যকর করার চেষ্টা করেনি। বর্তমান সরকার এই আইন করার উদ্যোগ গ্রহণ করার পরও আইনটি তৈরি করেনি। গত সাত বছরে একাধিকবার আইনটির খসড়া মন্ত্রিসভায় উত্থাপিত হওয়ার পর ফেরত পাঠানো হয়েছে আরও পরিবর্তনের জন্য।

মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের স্বাধীন, নিরপেক্ষভাবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসাবে কাজ করার রক্ষাকবচ এই আইন যতদিন না হবে ততদিন ভোট কেন্দ্র দখল ও বিরোধী দলের পোলিং এজেন্টদের ভোট কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে জাল ভোট প্রদান অব্যাহত থাকবে, যে অভিজ্ঞতা প্রায় সকল নির্বাচনে আমাদের আছে।

এই অবস্থা পাল্টানোর জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল কিন্তু আওয়ামী লীগ ২০০১ সালের অভিজ্ঞতার ফলে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে সে আইন বাতিল করেছে আর বিএনপি সেই ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। ২০০১ সালের বিচারপতি লতিফুর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক ঘণ্টার মধ্য ১৪ জন সচিবকে পাল্টে দিয়ে যে সচিবদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তারা সবাই বিএনপিপন্থি হিসাবেই পরিচিত ছিলেন! এরা মাঠ কর্মীদের পাল্টে দিয়ে একই ভাবে বিএনপির পক্ষে মাঠ পর্যায়ে অবস্থান তৈরি করেছিল।

একই অবস্থা ঘটেছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনে। সেই সময়ের সেনা সমর্থিত সরকার একই ভাবে আওয়ামী লীগের অনুকূলে মাঠ তৈরি করে দিয়েছিল।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার নয়, সরকারি কর্মচারীদের চাকরির আইন দরকার প্রথমে। আরও দরকার উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের আইন।

এরা নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলবে আর ভোট ব্যবস্থা কীভাবে নিজেদের অনুকূলে ধরে রাখা যায় সেই দিকে লক্ষ্য রাখবে।

পাঠকের মন্তব্য

অন্যান্য সংবাদ