ছাত্রলীগে অর্থই অনর্থের মূল

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ লিখে গুগলে খোঁজ করলে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্র সংগঠনটির যেসব কর্মকাণ্ডের ছবি সামনে আসে তা এক কথায় ভয়াবহ। বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও নিউজ পোর্টালে ছাত্রলীগ নিয়ে যেসব ছবি প্রকাশিত হয় সেগুলোকেই গুগল একত্র করে দেখায়।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ লিখে গুগলে খোঁজ করলে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্র সংগঠনটির কর্মকাণ্ডের ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়। বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও নিউজ পোর্টালে ছাত্রলীগ নিয়ে যেসব ছবি প্রকাশিত হয় সেগুলোকেই গুগল একত্র করে দেখায়।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, গত আট বছরে ছাত্রলীগের বিভিন্ন সংঘর্ষের ঘটনায় ১২৫ জনের বেশি নিহত হয়েছেন। গতকাল সিলেটে ছাত্রলীগের হানাহানির সর্বশেষ বলি হয়েছেন তাদের নিজেদেরই এক কর্মী।

গত আট বছরে ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্ট মারামারিতে যারা নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে ৭১ জনই সংগঠনটির নিজেদের কর্মী। এদের মধ্যে আবার ৬০ জন নিহত হয়েছেন নিজেদের বিভিন্ন উপদলের কোন্দলে। প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা গেছেন ছাত্রলীগের ১১ নেতাকর্মী। নিহত বাকি ৫৪ জন শিশু, সাধারণ মানুষ ও অন্য ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পরই বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ। নিজেদের কর্মকাণ্ডের কারণে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় একসময়ের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনটি। সে বছর এপ্রিল মাসে বিরক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধানের পদ থেকে সরে যান।

কিন্তু তাতেও বেআইনি কর্মকাণ্ড থেকে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা নিবৃত্ত না হওয়ায় পরের বছর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে টেন্ডারবাজি ও অন্য যেকোনো অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র সংগঠনটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ পাঠানো হয়। ছাত্র সংগঠনটি ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত হলেও কোনোরকম ছাড় না দিতেও বলা হয় সেই নির্দেশে।

সংঘর্ষের অনেকগুলো ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অর্থ উপার্জন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার প্রায় সবগুলো সংঘর্ষেরই মূল কারণ। সংগঠনটির নেতাকর্মীদের বিভিন্ন অপকর্মে যুক্ত হওয়া থেকে দূরে রাখতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাদেরকে প্রয়োজনে চাকরি এমনকি টাকা দেওয়ারও প্রস্তাব করেছিলেন। তবে তাতেও যে কাজ হয়েছে তা কিন্তু বলা যাবে না।

অতীতে অপরাধে যুক্ত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সতর্ক করা হলেও তাদের মধ্যে খুব কম জনই সাজা পেয়েছেন। এ থেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন শুধুমাত্র সতর্ক করে তাদেরকে শোধরানো সম্ভব নয়।

মূল কারণ টাকা

১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনর্যাত্রা হলেও সে সময়ের পর থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং ও বিএনপির জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কর্মকাণ্ডের কারণে পুরো ছাত্র রাজনীতিরই বদনাম হয়েছে।

স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বল্প সময় বাদে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ পালাক্রমে দেশের শাসন ক্ষমতায় এসেছে। এখন আদর্শের চেয়ে এই দল দুটির ছাত্র সংগঠনের কাছে টাকা বেশি গুরুত্ব পায়। যেকোনো উপায়ে টাকা আয়ের পেছনে দৌড়ানোয় ছাত্রনেতাদের জীবনধারাতেও পরিবর্তন এসেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধুর ক্যান্টিনের পরিচালক অরুণ দে গত কয়েক দশকে ছাত্রনেতাদের জীবনধারায় পরিবর্তনের বিষয়টি কাছ থেকে দেখেছেন। ১৯৭৫ সাল থেকে ঐতিহাসিক এই ক্যান্টিনটি তিনি চালাচ্ছেন।

বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এই ক্যান্টিনে ছাত্র নেতারা একসময় রিকশা অথবা পায়ে হেঁটে আসতেন। অনেক সময় রিকশা ভাড়া পরিশোধ করার মতো টাকাও থাকতো না তাদের। কিন্তু এখন তারা গাড়ি নিয়ে আসেন। সম্প্রতি, দ্য ডেইলি স্টারকে এসব কথা বলেন অরুণ দে।

অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ সভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদকরা (জিএস) ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতারা একত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতেন। কিন্তু এখনকার ছবিটা ভিন্ন। এখন হয় তাদের নিজস্ব বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থাকে নয়তো এ ধরনের কোন বাসায় তারা ভাড়া থাকেন, যোগ করেন অরুণ।

অরুণের বাবা মধুসুদন দে যিনি মধু দা নামেই সমধিক পরিচিত, ঢাবির ক্যান্টিনটি গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের শেষ দিক থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত চালিয়েছেন। তার নামে নামকরণ করা এই ক্যান্টিন দেশের জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আন্দোলন থেকে শুরু করে অনেক ছাত্র আন্দোলনের সাক্ষী। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী মধু দা’কে হত্যা করেছিল।

অরুণ বলেন, “খালেদা জিয়া ক্ষমতা গ্রহণের পর (১৯৯১ সালে) ব্যাপকভাবে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। এখন আর কোন আদর্শ নেই।” তার মতে ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় পুরো দৃশ্যপটেই ছিল ছাত্রদলের হানাহানি। গত আট বছর থেকে সেই জায়গাটি নিয়েছে ছাত্রলীগ। সংগঠন দুটির নেতাদের একাংশের বিরুদ্ধে বেআইনি পন্থায় অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। নেতাদের বিলাসী জীবন নিয়ে এখন সংগঠনগুলোর ভেতর থেকেই প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়েছে। ছাত্রলীগেরই কিছু কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা তাদের সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের আয়ের উৎস নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন।

সম্প্রতি সংগঠনটির সভায় এক নেতা অভিযোগ করে বলেন, ছাত্রলীগ সভাপতি প্রতি মাসে ৫৫ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দেন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে থাকা একজন অভিযোগ করে বলেন, ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল টাওয়ারের নির্মাণ কাজ থেকে সাত লাখ টাকা আদায় করেছেন। এই টাকার ভাগ পাননি বলে ওই সভায় এক নেতা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উভয়েই এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও এর ফলে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণ সম্পর্কে এ থেকে একটা ধারণা পাওয়া যায়।

১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন আব্দুর রহমান। ছাত্রলীগে অর্ন্তদ্বন্দ্বের কারণ জানতে চাওয়া হলে বর্তমানে আওয়ামী লীগের এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এক কথায় বলেন, “যখন আদর্শের রাজনীতির জায়গাটি ক্ষমতা ও অর্থের রাজনীতি দখল করে নেয় তখন সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।”

তাদের সময় ছাত্রলীগের কোন অন্তর্কোন্দল ছিল না জানিয়ে তিনি নিজেই স্বীকার করেন ছাত্রলীগের ভেতর এখন সর্বত্রই এই অবস্থা বিরাজ করছে।

১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন নুরে আলম সিদ্দিকি। তিনি বলেন, ছাত্র রাজনীতি থেকে এখন আদর্শ হারিয়ে গেছে। সবাই টাকা আয়ে ব্যস্ত। টাকার জন্যই তারা নিজেদের মধ্যে কোন্দলে জড়ায়।

সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ কিভাবে ছাত্ররাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছে সে ব্যাপারে সম্প্রতি কথা বলেছেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। তিনি স্মরণ করে বলেন, ষাটের দশকে দেশের মানুষের অধিকার রক্ষার জন্যই ছাত্ররা রাজনীতিতে আসতেন। কিন্তু এখনকার ছাত্রনেতারা নিজেদের স্বার্থ নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন।

অতীতের গৌরবে কালো ছাপ

২০০৯ সাল থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা যেসব বেআইনি কর্মকাণ্ডের জন্ম দিয়েছে তা সংগঠনটির অতীত গৌরব এবং অর্জনের ওপর কালিমা ফেলেছে।

এ সময়ের মধ্যে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছে; জড়িয়েছে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিতে। অন্য শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজেও লিপ্ত হয়েছে তারা। বিরোধীদের হল ও ক্যাম্পাস থেকে বের করে তো দিচ্ছেই এমনকি, শিক্ষকদেরও ওপরও হামলা করতে ছাড়েনি এই সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা।

অথচ ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনায় সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে তারা।

ধরা-ছোঁয়ার বাইরে

২০০৯ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছরই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসের ভেতরে ও বাইরে খুন হচ্ছেন। সমালোচনার মুখে সংঘর্ষ ও অপকর্মের অভিযোগে কয়েকজন ছাত্রনেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

যেমন, মাগুরায় একজন গর্ভবতী নারী গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় সংগঠনটির কয়েকজন নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু, আরও অনেক ঘটনায় কোন আশানুরূপ ফল দেখা যায়নি। এমনকি, পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ করার পরও কোন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

গতকাল ১৭ জুলাই ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, অপকর্মের জন্যে তারা কেবল একজনকে বহিষ্কারই করতে পারেন। তিনি বলেন, “সংগঠন থেকে বহিষ্কার করার পর প্রশাসনের জন্যে সহজ হয় অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার।”

কিন্তু, বাস্তবে দেখা যায় ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার হওয়ার পরও অভিযুক্ত অনেকের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

Click here to read the English version of this news

Comments

The Daily Star  | English

Create right conditions for Rohingya repatriation: G7

Foreign ministers from the Group of Seven (G7) countries have stressed the need to create conditions for the voluntary, safe, dignified, and sustainable return of all Rohingya refugees and displaced persons to Myanmar

6h ago