ন্যায়বিচারের নারী

ইতিহাস সম্পর্কে আমার জ্ঞান খুব সামান্যই। ১৯৯৭ সালে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে আমার সংক্ষিপ্ত সময়ের ইতিহাস চর্চা শুরু হয়। প্রথম বর্ষে ‘প্রাচীন সভ্যতা’ নামে একটি কোর্স ছিল। এটি পড়ানোর একপর্যায়ে কোর্স শিক্ষক ম্যাডাম আমাদের থেমিসের কথা বললেন।...
Lady of Justice
সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত ভাস্কর্য। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

ইতিহাস সম্পর্কে আমার জ্ঞান খুব সামান্যই। ১৯৯৭ সালে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে আমার সংক্ষিপ্ত সময়ের ইতিহাস চর্চা শুরু হয়। প্রথম বর্ষে ‘প্রাচীন সভ্যতা’ নামে একটি কোর্স ছিল। এটি পড়ানোর একপর্যায়ে কোর্স শিক্ষক ম্যাডাম আমাদের থেমিসের কথা বললেন। তাঁর বর্ণনা বেশ আকর্ষণীয় ছিল। থেমিস তাঁর কাছে শুধুমাত্র একজন গ্রিক দেবী নয়, তিনি থেমিসকে উপস্থাপন করেছিলেন নারীর ক্ষমতায়ণ ও পুরুষের তুলনায় নারীর বিচার ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে। সেদিনের পর থেকে থেমিস নিয়ে আর কখনো ভাবা হয়নি। একই সঙ্গে পরীক্ষা পাশের প্রয়োজন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বাকি সময়ে ইতিহাস চর্চাও খুব একটা করা হয়ে ওঠেনি!

আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে, বাংলাদেশে থেমিস খুব একটা পরিচিত ছিলো না। সুপ্রিম কোর্টের প্রাঙ্গণ থেকে থেমিসের ভাস্কর্য সরানোর বিষয়ে হেফাজতের দাবির আগ পর্যন্ত সে অপরিচিতই ছিল অধিকাংশের কাছে। এই ভাস্কর্যটি দেখে আমার মনে হয়েছে এটি আসলে থেমিস নয়। থেমিসের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ভাস্কর এটিকে বাঙালি রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। উল্লেখ্য যে এই ভাস্কর্যের নারী শাড়ি পরিহিত, অনেকটা বিশ্বজনীন কোনো বিষয়ের স্থানীয়করণের মতো ব্যাপার।

ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লা ও তরবারি হাতে চোখবাঁধা নারীর ভাস্কর্য বিশ্বে সুপরিচিত। এমন একটি ভাস্কর্যের ভাবনা কোথা থেকে এসেছে তা পরিষ্কার জানা যায় না। তবে বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনে এ ধরনের ভাস্কর্য দেখা যায়। প্রাচীন মিশরে মা’আত নামে একজন দেবী পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন সুবিচার, নৈতিকতা, আইন ও সুশাসনের প্রতীক। মা’আতের এক হাতে ছিল তরবারি আর মাথায় ছিল পালক গোঁজা। তবে তাঁর হাতে কোনো নিত্তির কথা জানা যায় না। তিনি ওসিরিসকে মৃতদের আত্মার বিচারকাজে সহযোগিতা করতেন। সুতরাং বলা যায় বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাঁর সুস্পষ্ট একটি যোগসূত্র ছিল। আর তাই এ কথা বলা অমূলক হবে না যে ম্যাজিস্ট্রেট শব্দটির (ল্যাটিনে ম্যজিস্ট্রাটুস) উৎপত্তি মা’আত থেকেও হতে পারে।

মিসরের এই মা’আত গ্রিকদের কাছে পরিচিত ছিল থেমিস হিসেবে। তবে তাঁর কাজ কিছুটা ভিন্ন হলেও মা’আতের সঙ্গে তাঁর মিল পাওয়া যায়। থেমিসের কাজ ছিল মানুষ ও গোত্রীয় বিভিন্ন বিষয় বিশেষ করে আইনসভা সংক্রান্ত বিষয়াদি দেখভাল করা। তবে তাকে কখনোই চোখ বাঁধা অবস্থায় দেখা যায়নি। থেমিসের ভবিষ্যৎ বলতে পারার বিশেষ পারদর্শিতা ছিলো বলে তাঁর চোখ বাধার প্রয়োজন ছিল না। ডেলফিতে থেমিসের অনেক দৈববাণী রয়েছে। দৈববাণী করার ক্ষমতা ও আইন সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর দক্ষতার কারণে এই দেবী কালক্রমে ঐশ্বরিক সুবিচারের দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে থেমিসের হাতে কোনো তরবারির অস্তিত্বের কথা জানা যায় না। সুতরাং সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত ভাস্কর্যটি যে থেমিসের তা পুরোপুরি ঠিক নয়।

অন্যদিকে রোমানদের সুবিচারের দেবী ছিলেন জাস্টিশিয়া। এই দেবীর যে ভাস্কর্য রয়েছে তাতে কখনো তাকে চোখ বাঁধা, এক হাতে তরবারি এবং অন্য হাতে ভারসাম্যপূর্ণ নিক্তি হাতে দেখা যায়। আবার এক হাতে কুড়াল সদৃশ একটি বস্তু ও অন্য হাতে আগুন নিয়ে জাস্টশিয়ারই আরেক রূপ রয়েছে। এই বিশেষ ধরনের কুড়ালের অর্থ হচ্ছে জাস্টশিয়ার যে বিচারিক ক্ষমতা আছে তা বোঝানো। আর আগুনের অর্থ হচ্ছে সত্য। প্রাচীন রোমানদের জীবনে জাস্টিশিয়ার বাস্তব অস্তিত্ব ছিল। তাদের বিচার ব্যবস্থায় লিক্টরকে (আজকের বিচারিক আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের মতো) নামে এক বিশেষ পদ ছিল। এই লিক্টর জাস্টশিয়ার ব্যবহৃত বিশেষ কুড়াল নিয়ে চলাচল করতেন। এই কুড়ালের অন্য কোনো ব্যবহার না থাকলেও এটি ছিল বিচারিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রতীক।

সময়ের পরিক্রমায়, ন্যায়বিচারের সঙ্গে নিক্তি ও তরবারি সম্পর্কিত হয়ে গেছে। নিক্তি দিয়ে বোঝানো হয় নিরপেক্ষতা এবং তরবারি দিয়ে বোঝানো হয় শক্তি। ষোলো শতকের বিভিন্ন বিচার সংক্রান্ত শিল্পকর্ম ও সাহিত্যে জাস্টিশিয়ার ব্যাপক প্রভাব দেখা যায়। তবে ঠিক কী কারণে এমনটি হলো তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে, মূল কথা হলো বিচারের ক্ষেত্রে তিনি দোষী-নির্দোষ কারো পক্ষই নেন না তা বোঝানোর জন্যই শিল্পী এমনটি করেছেন। আজ সারা বিশ্বে তরবারি ও ভারসাম্যপূর্ণ নিক্তি হাতে চোখ বাঁধা নারীর ভাস্কর্য বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আগ্রহী পাঠকেরা এই লিংকে গিয়ে বিশ্বব্যাপী এ ধরনের ভাস্কর্য ও চিত্রকর্ম দেখে নিতে পারেন http://mdean.tripod.com/justice.html

এসব বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত ভাস্কর্যটি সরানোর প্রয়োজনীয়তা আছে কি নেই তা নির্ধারণ করা। বরং এই ভাস্কর্যটি কীভাবে ন্যায়বিচারের বিশ্বজনীন প্রতীক হিসেবে গৃহীত হলো তা খুঁজে দেখা। তবে ভাস্কর্য নিয়ে এই যে বিতর্ক সে প্রসঙ্গে একটি কথা না বললেই নয়। পুনঃস্থাপিত ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুসারে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। কিন্তু এটি কোনোভাবেই ভালো লক্ষণ নয় যে কোনো ধরনের স্থানীয় বা জাতীয় পরিষদে প্রতিনিধিত্ব নেই এমনকি যা একটি রাজনৈতিক দলও নয়, এমন একটি সংগঠন আমাদের বিচারব্যবস্থার প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করছে এবং এর কার্যক্রমকে সমালোচনা করছে। এই ভাস্কর্যটি একদিনেই স্থাপন করা হয়নি। ধরে নেওয়া যেতে পারে যে যথাযথ অনুমোদন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছে। পাঠকের হয়তো মনে আছে ২০০৮ সালে লালনের প্রতিনিধিত্বকারী ভাস্কর্য “অচিন পাখি” গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশ বিমানের প্রতীক “বলাকা” ভাস্কর্যটিও ভাঙচুর করা হয়েছিল। এহেন হীন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্তদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছিল কিনা তা আজও পরিষ্কার নয়। এই বিচারহীনতার সঙ্গে ফতোয়া নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায় (ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া বৈধ, কোনো ব্যক্তির জীবনে ক্ষতির কারণ হয় বা শাস্তি হিসেবে ফতোয়া অবৈধ) এই বিশেষ গোষ্ঠীকে অনুপ্রাণিত করে থাকতে পারে তাদের এই সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডকে।

মূর্তি পূজা ইসলামে নিষিদ্ধ – এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু কোনো প্রতীক ব্যবহার বা শিল্পীর কোনো সৃষ্টি, যাকে কেউ পূজা করছে না, তা তো নিষিদ্ধ নয়। ধর্মীয় আচরণ ও শিল্পের মধ্যে পার্থক্য আমাদের বুঝতে হবে। ভাস্কর্য হচ্ছে শিল্পকর্ম যা শিল্পী কোনো কিছু থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে সৃষ্টি করেন। কখনো কখনো একটি শিল্পকর্ম বিশ্বজনীন হয়ে উঠে। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের ভাস্কর্যটির ক্ষেত্রে ঠিক তাই হয়েছে। এটি সত্য ও ন্যায়বিচারের প্রতীক মাত্র। ভাস্কর্য, শিল্প ও সাহিত্য বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সুপ্রিম কোর্টের খুব কাছেই আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মারক হিসেবে রয়েছে “অপরাজেয় বাংলা”, “স্বোপার্জিত স্বাধীনতা”, “স্বাধীনতা সংগ্রাম” এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক “রাজু ভাস্কর্য”। এই ভাস্কর্যগুলো ১৯৫২, ১৯৭১ এবং ১৯৯০ সালের আমাদের গৌরবময় ইতিহাসকে সরাসরি প্রতিনিধিত্ব করে। ভবিষ্যতে এগুলো অপসারণের দাবি কেউ করবেন না এই নিশ্চয়তা কে দিতে পারেন? সবশেষে, ইতিহাসে পড়েছি বলে আজ আর কোনো অনুশোচনা নেই। আমি মনে করি আমাদের সকলেরই নিরপেক্ষভাবে সামান্য হলেও ইতিহাস চর্চা করা প্রয়োজন। এ চর্চা হয়তো আমাদের গোঁড়ামি ও সংস্কার থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দেবে।

 

লেখাটির মূল ইংরেজি সংস্করণ দ্য ডেইলি স্টারে প্রথম ছাপা হয় ১৭ এপ্রিল, ২০১৭

Click here to read the English version of this news

Comments

The Daily Star  | English

Anontex Loans: Trouble deepens for Janata as BB digs up scams

Bangladesh Bank has ordered Janata Bank to cancel the Tk 3,359 crore interest waiver facility the lender had allowed to AnonTex Group, after an audit found forgeries and scams involving the loans.

21m ago