সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: কর্তৃপক্ষ দায়ী নহে!

আমাদের কর্তৃপক্ষরা শুধু কর্তৃত্ব করবেন। কর্তৃত্ব করতে করতেই তারা হয়রান। জবাবদিহি করবে কখন? জবাবদিহি করতে গেলে কাজের ব্যাঘাত ঘটবে নিশ্চয়।
রাজধানীতে চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগে শনিবার শাহবাগে দুই মেয়রকে লাল কার্ড দেখানো হয়। ছবি: পলাশ খান

আমজনতা হল দুই টাকার নোটের মত। চাহিবামাত্র ইহার বাহককে দুই টাকা দিতে কেউ বাধ্য নহে! তাই মাথায় যত প্রশ্নই আসুক, দিবে না কেউ জবাব তার।

ব্যস্ততার এই যুগে কর্তৃপক্ষ জবাব দিতে বাধ্য নন। কর্তৃপক্ষ কর্তৃত্ব করতে ভালোবাসেন। কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করবে এমন কর্তৃত্ব, মানে ক্ষমতা, কার আছে?  কর্তারা কাজ করতেই বড্ড ভালোবাসেন, জবাব দেওয়ার ফুরসত নেই তাদের। বাসায় কর্তা ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করুন, কেন তিনি অমন করলেন? কেন অমন করলেন না? ধমক খেয়ে থেমে যেতে হবে। সংসারে আপনি জনতার অংশ। কর্তৃত্বের অংশ নন। সমাজ, রাষ্ট্রেও আপনি আমি জনতা; যারা কর্তৃত্ব বলয়ের বাইরে। তাদেরকে কেন্দ্র করে কিছুই ঘোরে না, তারা নিজেরাই ঘোরে, চরকির মতো ঘোরে। হাওয়া পেলেও ঘোরে, না পেলেও ঘোরে। দখিনা বাতাস আর দমকা হাওয়া ঝড়ের তফাৎ জানার অবকাশ নেই। তাদের এমন ঘূর্ণায়মান যাপিত জীবনের জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন। তাই কোনো কিছুর জবাব না চেয়ে আম জনতার ঘূর্ণায়মান থাকাই শান্তিময়। জানতে চাওয়াটাই সকল অশান্তির মূল!

অনেক কিছুর ব্যাপারে আম জনতাকে সাবধান করা হয়। যেমন, বাস-ট্রাক-রেল স্টেশনে, লঞ্চ-ফেরি টার্মিনালে স্পষ্ট করে লেখা থাকে, মালামাল নিজ দায়িত্বে রাখুন। হারিয়ে যাওয়া মালের জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন। আপনাকে সতর্ক করতে বাসের ভেতরেও লেখা থাকে, ভিড়ের মধ্য পকেট সাবধান! টাকা খোয়া গেলে কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।

সম্রাট অশোকের শাসনামলে যা হয়েছে সে আশার গুড়ে এখন বালি। রাজ্যের ভেতর তখন কোন ব্যবসায়ীর মালামাল চুরি গেলে সম্রাট অশোক সেটাকে নিজের ব্যর্থতা মেনে নিয়ে ক্ষতিপূরণ দিতেন। কিন্তু সেসব এখন ইতিহাস। খোয়া যাওয়া, চুরি যাওয়া মালের ক্ষতিপূরণ দিতে এখন কর্তৃপক্ষ বাধ্য নন। সাবধান করেই কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব সেরেছে। সাবধান না হলে আপনি মরেছেন! যেমন, ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর-বিড়ি সিগারেটের প্যাকেটে এমন সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দেখেও যারা ধূমপান করেন, স্বাস্থহানি ঘটান তাদের জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।

তাই কদিন আগে একজন রাজনীতিবিদের বাসায় আমন্ত্রিত কয়েকজন রাজনীতিক কেন পুলিশের দ্বারা হেনস্তা হলেন; কেন নিজের বাসায় দাওয়াত দিয়েও দাওয়াতকারী তার মেহমানদের সম্মান রক্ষা করতে পারলেন না-সে জবাব দিতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য নন। আমন্ত্রণ জানানোর আগে কি কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল? নিশ্চয় না। তাহলে আমন্ত্রণের পর ঘটে যাওয়া কোনো অঘটন বা দুর্ঘটনার জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন। উক্ত রাজনীতিবিদকে নিজ দায়িত্বে মেহমানদের আমন্ত্রণ জানানো উচিত ছিল। তার নিজের ভুলের মাশুল কর্তৃপক্ষ দিবেন কেন?

মশার কামড়ে চিকুনগুনিয়ায় ব্যথায় জর্জরিত হয়ে সারা শরীরে গিটে গিটে ব্যথায় যতই আহ উহু করুন না কেন আপনার ব্যথায় ব্যথিত হবার দায় কর্তৃপক্ষের নেই। আপনার ব্যথাভরা জীবনের জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন। কেনই বা হবে? নিজের বাসা বাড়ি বা অফিসে মশাদেরকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিতে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েছেন? নেননি। অনুমোদনবিহীন কোনো কাজের দায়ভার কর্তৃপক্ষ নিবেন না।

শহর জুড়ে মশা উড়ছে, মশা ঘুরছে দলে দলে সেসব ভিন্ন ব্যাপার। এই উদাহরণ টেনে কর্তৃপক্ষে লাল কার্ড দেখিয়ে লাভ নেই। মিছিল-প্রতিবাদে রাজপথ গরম করলে নিজেদেরকেই সে তাপ সহ্য করতে হবে। ঘরের বাইরে, অফিসের বাইরে মশার কামড় থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখার দায়িত্ব আপনার নিজের, আপনার জানের প্রতি মায়া মহব্বত আপনাকেই করতে হবে। নিজে করতে ব্যর্থ হলে তার জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।   

ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে থাকুন তার জন্যও কর্তৃপক্ষ দায়ী নন। নিজের চলা ফেরার দায়ভার নিজেকে বহন করা শিখতে হবে। আপনার শরীরের ভার যেমন আপনার দুই পা বহন করে, ঠিক তেমন। ঘর থেকে বের হবার আগে নিজেকেই ভেবে-চিন্তে বেরুতে হবে। নিজের ভুল সিদ্ধান্তের দায় কর্তৃপক্ষের উপর চাপাতে পারেন না।

বৃষ্টি নামলে রাস্তা পানিতে তলিয়ে যাবেই; সেটার জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন। পানিতে হারিয়ে যাওয়া রাস্তা খুঁজে সাঁতার কাটার দায়িত্ব আপনার নিজের, কর্তৃপক্ষ আপনাকে পথ দেখতে বাধ্য নন। সাঁতার না জানা কেউ সাঁতরাতে গিয়ে ডুবে গেলে, হারিয়ে গেলে কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।

যান মাল সব সময় নিজ দায়িত্বে রাখা আপনার কর্তব্য। সে দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের উপর চাপানো অন্যায়। ভাঙাচোরা রাস্তায় চলতে গিয়ে ঝাঁকুনিতে শরীরের হাড়গোড় নড়ে চড়ে গেলে, তার জন্য আপনার দুর্বল শরীর দায়ী; কর্তৃপক্ষ নন।

বাস উল্টালে মানুষ উল্টাবে; লঞ্চ ডুবলে মানুষ ডুববে—তার দায়ভার বাসের এবং লঞ্চের। যা ধারণ করতে পারে না, তা বহন করে কেন? এ জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।

হাওরে বাঁধ ভাঙলে ফসল ডুববে, পাহাড় ধসে পড়লে মানুষ চাপা পড়বে—এসব প্রকৃতির নিয়ম। এর জন্য দায়ী দুর্বল বাঁধ আর পাহাড়। তেমনি বন্যা হলে ফসল ডুববে, ঘর বাড়ি ভাসবে, মানুষ সাঁতরাবে, না খেয়ে না দিয়ে অনেকে দিনাতিপাত করবে—সে সবের জন্য দায়ী অতিরিক্ত পানি ধারণ ক্ষমতাহীন নদ-নদী; কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।

আমাদের কর্তৃপক্ষরা শুধু কর্তৃত্ব করবে। কর্তৃত্ব করতে করতেই তারা হয়রান। জবাবদিহি করবে কখন? জবাবদিহি করতে গেলে কাজের ব্যাঘাত ঘটবে নিশ্চয়। কাজ ব্যাহত হলে আমজনতা তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। তাতে আমজনতারই ক্ষতি।

কোনো কিছুর জন্য কর্তৃপক্ষকে দায়ী করার মানসিকতা সেকেলে। একালে এ মানসিকতা অচল। আমাদের মানসিকতায় পরিবর্তন ঘটাতে হবে। মনের ভিতর, চোখের পাতায় আমজনতাকে মোটা হরফে একটা সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ লিখে রাখতে হবে: কোন কিছুর জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নন! পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার এটা একটা সুযোগ বটে।

বিঃদ্রঃ এই লেখা শেয়ার করে কেউ ৫৭ ধারায় মামলা খেলে কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।

Comments

The Daily Star  | English

Foreign airlines’ $323m stuck in Bangladesh

The amount of foreign airlines’ money stuck in Bangladesh has increased to $323 million from $214 million in less than a year, according to the International Air Transport Association (IATA).

14h ago