এটাই সু চি’র আসল চেহারা

মিয়ানমারের জনগণের উদ্দেশে দেওয়া অং সান সু চি’র ভাষণের খসড়া কারা তৈরি করেছেন? তার নির্দেশে তার দপ্তরের কর্মকর্তারা? নাকি সামরিক বাহিনীর কর্তা ব্যক্তিরা নিজেদের পছন্দমত শব্দে খসড়া তৈরি করে দিয়েছেন? আর হাতে কপি পেয়ে তিনি সেটা পাঠ করেছেন। তোতা পাখির মতো শেখা বুলি আউড়ে গেছেন। সে জন্যই কোনো কিছু না জানার ভান করে গোটা বিশ্বকে বলতে পেরেছেন “রাখাইন থেকে মুসলিমরা কেন পালিয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছে, তা খুঁজে বের করতে চাই।”
অং সাং সু চি, ছবি: এএফপি

মিয়ানমারের জনগণের উদ্দেশে দেওয়া অং সান সু চি’র ভাষণের খসড়া কারা তৈরি করেছেন? তার নির্দেশে তার দপ্তরের কর্মকর্তারা? নাকি সামরিক বাহিনীর কর্তা ব্যক্তিরা নিজেদের পছন্দমত শব্দে খসড়া তৈরি করে দিয়েছেন? আর হাতে কপি পেয়ে তিনি সেটা পাঠ করেছেন। তোতা পাখির মতো শেখা বুলি আউড়ে গেছেন। সে জন্যই কি কোনো কিছু না জানার ভান করে গোটা বিশ্বকে বলতে পেরেছেন “রাখাইন থেকে মুসলিমরা কেন পালিয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছে, তা খুঁজে বের করতে চাই”? 

দেড় বছর ধরে তার দল ক্ষমতায়। তার সরকারের আমলে গত বছরেও রাখাইনে এক দফা রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ চালিয়েছে সামরিক বাহিনী। সে বারও কয়েকশ রোহিঙ্গা খুন হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে ঘড় বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে প্রায় এক লাখ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

এই দফায় নৃশংসতা অনেক গুণ বেশি। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব মতে, কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছে। অসংখ্য ঘর বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী ধর্ষিত হয়েছে। সু চি’র সরকারের হিসাব মতেই প্রায় দুইশ রোহিঙ্গা গ্রাম মানুষ শূন্য হয়ে পড়েছে। চার লাখের বেশি মানুষ প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। গত বছরের মত এবারেও এই সব বর্বর কর্মকাণ্ডের হোতা হল সু চি’র দেশের সামরিক বাহিনী, যারা কয়েক দশক ধরে রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। গোটা দুনিয়াবাসী এসব খবর জানেন। জানেন না একজন, তিনি হলেন অং সান সু চি! 

আরও পড়ুন: সু চি'র ভাষণ রোহিঙ্গাদের জন্য নয়

রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নিধনের চলমান সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নিন্দা এবং সমালোচনার ঝড়ের মুখে সু চি নীরবতা ভেঙে আজ যে ভাষণ দিয়েছেন তাতে নিধনযজ্ঞ পরিচালনাকারী সামরিক বাহিনীর সমালোচনা তো দূরের কথা, তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও নীরব থেকেছেন। কোনো কিছু না জানার ভান করে বলেছেন, “রাখাইন থেকে মুসলিমরা কেন পালিয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছে, তা খুঁজে বের করতে চাই?” রোহিঙ্গাদের নিজস্ব বাসভুমি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কারণ তার কাছে কি আসলেই রহস্যময়? না কি সামরিক বাহিনীকে খুশি করে ক্ষমতায় টিকে থাকতেই সব কিছু জেনেও না জানার ভান করেছেন?

রাখাইন থেকে মুসলমানদের পালিয়ে যাওয়ার কারণ খুঁজে বের করতে কী করবেন সু চি এবং তার সরকার? লোক দেখানো একটা কমিশন করবেন। তবে সেই কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে কী থাকবে সেটা এখনই অনুমান করা যায়। গত বছর সহিংসতার পরেও সু চি’র সরকারের উপরাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটা কমিশন হয়েছিল। ওই কমিশনের সদস্যরা রোহিঙ্গাদের হত্যা নিপীড়নের কোনো সত্যতা খুঁজে পায়নি। বরং, তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর দায়ে অভিযুক্ত করেছিল। এবারও যদি কমিশন গঠন করা হয় তাহলে ফলাফল নতুন কিছু হবার সম্ভাবনা নেই। তার সরকারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে একটা প্রচারণা শুরু করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ এবং গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া নৃশংসতার চিত্রকে অপপ্রচার হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা: রাজা থেকে শরণার্থী

রোহিঙ্গাদের প্রতি সু চি’র বিদ্বেষ নতুন নয়। রাখাইনের মুসলমান সংখ্যালঘুদের রোহিঙ্গা বলাটাও তার দেশে নিষিদ্ধ। তিনি নিজে একজন কূটনীতিককে রোহিঙ্গা শব্দ ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছেন। তার সরকার আদেশ জারি করে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে রোহিঙ্গা শব্দের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। এসব কাজে সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গাবিরোধী নীতিরই প্রতিফলন ঘটেছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কিছু দিন আগে ঘোষণা করেছেন যে, দ্বতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের অসমাপ্ত কাজ এবার সম্পন্ন করতে চান। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নিধন সম্পন্ন করা। আজ পুরো ভাষণে রোহিঙ্গা শব্দটি একবারের জন্যও উচ্চারণ করেননি সু চি। রোহিঙ্গাদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের বিষয় টাও তার ভাষণে গুরুত্ব পায়নি।

এমন পরিস্থতিতে ‘রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাওয়ার কারণ খুঁজে বের করতে’ সু চি’র সরকার একটা কমিশন করতেই পারেন। তবে যে কোন তদন্তে সামরিক বাহিনীর দমন নিপীড়ন প্রসঙ্গ অবধারিতভাবে আসবেই। সামরিক বাহিনী গত কয়েক দশক ধরে যা করেছে, সে সব উপেক্ষা করে রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমি ছেড়ে শরণার্থী হবার কারণ খুঁজে বের করা অরণ্যে রোদন হবে। তাই সু চি’র সরকারের সম্ভাব্য কমিশন কি সত্য প্রকাশ করতে পারবে?

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের রাখাইন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের বিষয়ে মিয়ানমার সরকার ভীত নয় বলে উল্লেখ করেছেন সু চি। তার বোধ হয় ‘গোল্ড ফিশ’ মেমরি, তাই সব কিছু সহজে ভুলে যান। গত বছর অক্টোবরে রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা, নির্যাতন এবং ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত হয় সে দেশের সামরিক বাহিনী। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের এই বছর ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া এক প্রতিবেদনেও এমন অভিযোগ করা হয়েছে, এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এসব অভিযোগের তদন্ত করতে এই বছর মে মাসে জাতিসংঘ একটা তদন্ত কমিশন গঠন করে। কিন্তু সু চি’র সরকার কমিশনকে মিয়ানমারে প্রবেশ করতে দেয়নি। এবারও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এমনকি রাখাইনে মানবিক সাহায্য পাঠাতেও বাধা দেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রাখাইন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আসার আহ্বান জানালেন। এ ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন, যদিও অতীতে বাধা দেয়া হয়েছে। এমনকি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে তাঁর সরকার কাজ করবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন। তবে তার এই আশ্বাসের ভেতর একটা শুভংকরের ফাঁকি আছে। রাখাইন রাজ্যর শান্তি এবং উন্নয়নের স্বার্থে আনান কমিশনের প্রতিটা সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এবং তার সরকার কিন্তু রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যর শান্তি ও উন্নয়নের পথে অন্তরায় হিসাবে মনে করে। তাই আনান কমিশনের সুপারিশ বেছে বেছে বাস্তবায়ন করা হতে পারে।  রোহিঙ্গাদের পক্ষে যায় এমন সুপারিশ, যেমন তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া, বাস্তবায়ন না হবার সম্ভাবনাই বেশি।  

বিশ্বব্যাপী নিন্দা এবং সমালোচনার ঝড়ের মুখে সু চি নীরবতা ভেঙেছেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন শুরু হয়েছে, সেখানেও মিয়ানমারের কড়া সমালোচনা হতে পারে। তাই এটা বলা যায় যে, আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র সমালোচনার কারণে সু চি’র মুখ থেকে কিছু ভালো কথা এবং আশ্বাসবাণীও বের হয়েছে। এটা তার দেশের সামরিক বাহিনী এবং তার সরকারের নতুন কৌশল। 

তার এসব আশ্বাসের মেয়াদ কত দিন থাকবে তা বলা মুশকিল। বিশ্বব্যাপী নিন্দা এবং সমালোচনার ঝড় কমলে যে কোনো সময় তার মতিগতি বদলে যেতে পারে। তাই নতুন বুলি নিয়ে আসার আগেই জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উচিত তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে অতি শিগগির রাখাইনে তদন্ত দল পাঠানো, সামরিক বাহিনীর পরিচালিত হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করে রাখাইনে পদ্ধতিগত ভাবে যারা দীর্ঘ সময় ধরে মানবতাবিরধী অপরাধ করে চলেছে বিশ্ববাসীর সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দেওয়া, তাদেরকে বিচারের সম্মুখীন করা। কেননা, মানবতাবিরধী অপরাধ বিশ্বের যে প্রান্তেই সংগঠিত হোক না কেন সেটা গোটা বিশ্বের মানবতার বিরুদ্ধেই অপরাধ। বিশ্ব মানবাতার স্বার্থে এসব অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেই হবে। 

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হয়েও কেউ শুধু ক্ষমতার লোভে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতার দায়ে অভিযুক্ত হবেন এমনটা সভ্য সমাজে কল্পনাতীত। 

Comments

The Daily Star  | English

Cuet students suspend protests

Say authorities assured them of meeting their major demands

34m ago